শাহরুখ খানকে মেয়েরা কেন পছন্দ করেন?
বলিউড ইন্ডাস্ট্রির নাম উচ্চারণের সাথে সাথেই যার নাম প্রায় সমার্থক শব্দ হিসেবে চলে আসে, তিনি বলিউডের খানদের একজন, শাহরুখ খান। ৫৬ বছর বয়সে এসেও শাহরুখ খান এক জ্বলজ্বলে নাম, যার রোশনাই আজও মলিন হয়নি। হিন্দি সিনেমাপ্রেমী অথচ শাহরুখ খানকে ভালোবাসেন না, এমন মানুষ পাওয়া কঠিন। কিন্তু শাহরুখ খানকে ঠিক কি কারণে ভালোবাসেন কোটি কোটি ভক্তরা? কেন তার নাম শুনলেই হৃদয়ে কাঁপন ধরে? তা কি নিছক বিনোদন দেওয়ার প্রাপ্তি হিসেবে? নাকি শাহরুখ খান আমাদের বাস্তব জগতেই বিচরণ করেন?
ভারতীয় লেখিকা শ্রেয়না ভট্টাচার্য তার বই 'ডেসপারেটলি সিকিং শাহরুখ খান'-এ এই সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। অসংখ্য ভারতীয় নারীর সাথে কথা বলে তিনি যা জেনেছেন, তা সত্যিই আপনাকে হার্টথ্রব এই তারকা সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখাবে।
'শাহরুখ খানকে আপনি কেন পছন্দ করেন?'-এমন প্রশ্নের জবাবে প্রথমে সোজাসাপ্টা উত্তর আসবে, 'কারণ শাহরুখ খান দেখতে আকর্ষণীয়, নায়ক হিসেবে তাকে মানায়, তিনি মজার মানুষ, সাক্ষাতকারে ক্যান্ডিড, খ্যাতিলাভ ও টাকাপয়সার ব্যাপারে অনুতপ্ত নন ইত্যাদি ইত্যাদি।'
কিন্তু যখন আরও গভীরে গিয়ে প্রশ্ন করা হলো, তখন ভক্তরা বিভিন্ন ছবিতে শাহরুখের ভূমিকা নিয়ে কথা বলতে লাগলেন। জানালেন শাহরুখ খান আসলে কখনো তাদের কাছে মাচো হিরো ছিলেনই না; বরং নারীদের প্রতি শাহরুখের যে সংবেদনশীল অনুভূতি এবং মায়া, সে কারণেই তারা এই তারকাকে এতটা পছন্দ করেন।
কিন্তু আপনি জেনে অবাক হবেন, নারীদের এই শাহরুখপ্রীতি আসলে অর্থনৈতিক বৈষম্যের সাথেও জড়িত। বিভিন্ন শ্রেণীর নারীরা তাদের ব্যক্তিগত জীবনের নানা চাওয়াপাওয়ার সাথে আত্মিকভাবে সংযুক্ত করেছেন খানকে।
লেখিকা শ্রেয়না ভট্টাচার্য বলেন, "আমি যখন নারীদের জিজ্ঞেস করলাম কখন, কবে, কিভাবে তারা শাহরুখ খানের প্রেমে পড়া শুরু করেছে; তারা আমাকে জানাতে লাগলো কবে কিভাবে এই নির্মম দুনিয়ার কাছ থেকে তারা আঘাত পেয়েছে!" অর্থাৎ, এসব নারী তাদের স্বপ্ন, উদ্বেগ-কষ্টের তীব্র আবেগ থেকে রোমান্টিক পুরুষ হিসেবে শাহরুখ খানকে বেছে নিয়েছেন।
শাহরুখের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ কোনো স্বল্প সময়ের জরিপের ফলাফল নয়। প্রায় দুই দশক ধরে উত্তর ভারতের অসংখ্য সিঙ্গেল কিংবা বিবাহিত নারীদের সাথে বন্ধুত্ব-যোগাযোগ ও আলাপচারিতার ফলাফল এটি। এদের মধ্যে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, সব ধর্ম-বর্ণের, পেশার নারী রয়েছেন। সুখী বা অসুখী গৃহিণী, কর্মজীবি নারী, শ্রমিক শ্রেণীর নারীসহ সবার সাথে কথা বলেছেন লেখিকা। এদের সবাই শাহরুখকে ভালোবেসেই এক ছাদের তলায় এসে দাঁড়িয়েছেন।
আমাদের জীবনে শাহরুখ খানের আবির্ভার নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে। সে সময় ভারতজুড়ে অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু হয়, যাকে আমরা 'উদারীকরণ' বলে থাকি। কিন্তু এটি নারীদের ঠিক কতটা মুক্তি দিয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন লেখিকা শ্রেয়না।
ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের একটি বস্তিতে ধূপকাঠি তৈরিতে ব্যস্ত নারীদের সাথে কথা বলে দেখা গেল, তারা মজুরি সংক্রান্ত গতানুগতিক প্রশ্নের চাইতে তাদের বলিউড হিরো নিয়ে কথা বলতে বেশি পছন্দ করেন। বৈষম্যপূর্ণ শ্রমবাজার এবং ঘরের ভেতরেও সংগ্রাম করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেন এসব নারী। মধ্যবিত্ত বা ধনী নারীদের ক্ষেত্রেও এ ধরনের হতাশার খবর আশ্চর্যের কিছু নয়।
নারীদের প্রশ্ন, 'কেন সব ছেলেপুরুষেরা শাহরুখের মতো হয় না?" নিজেদের কল্পনা ও বাস্তবতার উপর ভিত্তি করেই একজন শাহরুখ খানকে গড়ে তুলেছেন তারা।
রূপালি পর্দায় শাহরুখ খানের সবচেয়ে বড় সফলতা হলো, তিনি এমন একজন নায়ক যিনি সত্যিই নারীদের প্রতি যত্নশীল এবং তাদের কথা মন দিয়ে শোনেন। নিজের ভাগ্য নিয়ে তার দুশ্চিন্তা, সংগ্রাম তাকে একজন আদর্শ জীবনসঙ্গী রূপে তুলে ধরে। ছবিতে দেখা যায়, 'পুরুষদের কান্না বারণ'- এমন চিন্তাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি। কষ্ট পেলে কাঁদছেন, অসহায়ত্ব প্রকাশ করছেন, নিজের কোনো অনুভূতিই লুকিয়ে রাখছেন না।
জনৈক মুসলিম গার্মেন্টকর্মী নারী বলেন, "আমি চাই কাভি খুশি কাভি গামে শাহরুখ খান কাজলের সাথে যেভাবে কথা বলেন, তাকে যেভাবে স্পর্শ করেন, আমার স্বামীও আমার সাথে তাই করুক! কিন্তু সেটা কোনোদিন হবে না, কারণ আমার স্বামীর মনমেজাজ আর হাত দুটোই খুব কঠোর।"
অন্যদিকে ধনী গৃহবধূদের অনেকেই চান তাদের বখে যাওয়া ছেলেটি যেন শাহরুখ খানের মতো 'ভালো পুরুষ' হয়ে থাকে, নারীদের সম্মান করতে, সুরক্ষা দিতে শেখে।
সিনেমায় শাহরুখ খানের চরিত্রগুলোকে তারা যেমন গ্রহণ করেছেন, আবার সমালোচনাও করেছেন। 'দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে'কে বলা হয় শাহরুখ খানের সবচেয়ে ব্যবসাসফল ও রোমান্টিক ছবি। জনৈক শাহরুখভক্তের মায়ের ভাষ্যে, "এই ছবিতেই আমি প্রথম দেখলাম কোনো নায়ক এতক্ষণ ধরে রান্নাঘরে গাজর ছিলছে এবং ঘরের নারীদের সাথে এতটা সময় কাটাচ্ছে।" আর এ বিষয়টি ওই নারীর কাছে যথেষ্ট রোমান্টিক।
রোজকার নানা অন্যায়-অত্যাচার ও হৃদয়ভঙ্গের কষ্ট থেকে একটু মুক্তির উপায়ও ছিলেন শাহরুখ খান। ভক্তদের অনেকেই শাহরুখ খানকে বিয়ে করতে চাইতেন। কিন্তু সেটা তিনি বলিউড তারকা বলে নয়, বরং তিনি একজন দায়িত্বশীল পুরুষ বলে।
অসংখ্য নারী ভক্তের কাছে হলে গিয়ে শাহরুখ খানের ছবি দেখতে পারাটা ছিল এক কষ্টার্জিত স্বাধীনতা। মায়ের কাছে বকুনি খেয়ে পালিয়ে সিনেমা হলে যাওয়া, গার্মেন্টকর্মী নারীর ছোটভাইকে কিছু টাকা বকশিশ দিয়ে শাহরুখের ছবির টিকিট যোগাড় করা এই সবই ছিল তাদের এক আবেগের বহিঃপ্রকাশ। এমনকি প্রান্তিক শ্রেণীর কারো কারো হয়তো সিনেমা দেখার টাকাও ছিল না, শুধুমাত্র ছবির গান শুনেই তারা শাহরুখকে ভালোবেসেছেন।
অন্যদিকে, কিশোরী নারীরা শাহরুখ খানকে তাদের স্বপ্নের পুরুষ হিসেবে চাননি, তারা চেয়েছেন নিজেরাই শাহরুখ খান হতে, তার মতো খ্যাতি অর্জন করতে। শাহরুখ খান তাদেরকে সফল মানুষ হওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।
এভাবেই বছরের পর বছর ধরে ভক্তদের নিজের মোহনীয় জাদুতে মুগ্ধ করে রেখেছেন বলিউডের জীবন্ত কিংবদন্তী শাহরুখ খান। এই জাদুর শেষ কোথায় তা আমরা এখনো জানিনা, ততদিন পর্যন্ত নাহয় সব আলোচনা-সমালোচনা বাদ দিয়ে শাহরুখেই মগ্ন হোক ভক্তরা!
(শ্রেয়না ভট্টাচার্যের 'ডেসপারেটলি সিকিং শাহরুখ ইন্ডিয়া'স লোনলি ইয়ং ওমেন অ্যান্ড দ্য সার্চ ফর ইন্টিমেসি অ্যান্ড ইন্ডিপেনডেন্স' বইটি প্রকাশ করেছে হার্পার কলিন্স ইন্ডিয়া'।)
সূত্র: বিবিসি