হুমায়ূন আহমেদ: ডা. এজাজুল ইসলাম ও ফারুক আহমেদের স্মৃতিতে
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের আমন্ত্রণে অফিসে এসেছিলেন হুমায়ূন আহমেদের হাত ধরে তারকাখ্যাতি পাওয়া দুই অভিনেতা ডা. এজাজুল ইসলাম ও ফারুক আহমেদ। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত 'তারা তিনজন' সিরিজ থেকে শুরু করে অসংখ্য নাটকে অভিনয় করেছেন।
আলাপের শুরুতে তারা দুজন হূমায়ূন আহমেদের সঙ্গে পরিচয়ের কথা বলেন।
ডা. এজাজুল ইসলাম শুরুর দিনের স্মৃতি মনে করে বলেন, 'সময়টা তখন ১৯৯৬ সাল। আমি ডাক্তারি পাশ করে গাজীপুরের জয়দেবপুরে চেম্বার দিয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল আমাদের কোর্স। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ফর্মে সাইনের জন্য প্রফেসর করিম স্যারের রুমে যাই। কিন্তু গিয়ে শুনি তিনি হুমায়ূন আহমেদের অফিসে কাকরাইলে আছেন। কোনো কথা না ভেবে সোজা সেখানে গেলাম। খুঁজে বের করলাম তার অফিস। স্বাক্ষর নেওয়ার চেয়ে আমার মূল লক্ষ্য হুমায়ূন আহমেদ স্যারের সঙ্গে দেখা করা।'
''স্বাক্ষর নেওয়ার জন্য রুমে যেতে করিম স্যার কথা বলার আগেই হুমায়ূন স্যার ডেকে বললেন, 'কী নাম তোমার, বাসা কোথায়' ইত্যাদি। আমি বললাম, জয়দেবপুর। তখনই স্যারই বললেন, 'আমি সেখানে শুটিং করতে যাই। নানা ঝামেলায় পড়ি। তুমি আমাকে সহযোগিতা করতে পারবে না?'''
''আমি যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলাম। বললাম, 'স্যার, কোনো সমস্যা নাই। আপনি আসেন।' সেখান থেকে বের হয়ে তো আমি খুশিতে আত্মহারা! এত আত্মহারা যে, প্রফেসর করিম স্যারের স্বাক্ষর নেওয়া ফরমটা হারিয়ে ফেলি। এই ঘটনার সপ্তাহ খানেক পরে স্যার আমাকে ফোন করেন। বড় একটা ইউনিট নিয়ে গাজীপুর আসেন শুটিং করতে। সেই শুটিংয়ে নানা সহযোগিতা করেছি। স্যার খুব খুশি হয়েছিলেন। ওই নাটকটা ছিল 'সবুজ সাথী'।''
''ঘটনাক্রমে ওই নাটকের একটা চরিত্রে আমি অভিনয় করেছিলাম। একদিন গাড়িতে বসে স্যার বললেন, 'আমার একটা বাগান বাড়ি করার শখ। আমি অনেককেই বলেছি, কেউ তো জায়গা দিতে পারল না। আমাকে কি একটা জায়গা খুঁজে দিতে পারো? আমি তোমাকে এই দায়িত্ব দিলাম।' এরপর আমি দিন-রাত খুঁজে একটা জায়গা বের করে দেখালাম। নূহাশ পল্লীর সেই জায়গা দেখার পর স্যার খুব খুশি হলেন।''
এদিকে, অভিনেতা ফারুক আহমেদ বলেন, 'হুমায়ূন ভাইয়ের ছোট ভাই আহসান হাবীব আর আমি স্কুল ফ্রেন্ড। তখন স্যার মোহাম্মদপুর থাকতেন, সেই সুবাধে আমি প্রায়ই তাদের বাসায় যেতাম। সে সময় আমি ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। পরবর্তীকালে তার পরিচালনায় ১৯৯১ সালের দিকে বিটিভির শেখ রিয়াজ উদ্দিন বাদশার প্রযোজনায় 'অচিন বৃক্ষ' নামে একটি নাটকে অভিনয় করি। এরপর 'আজ রবিবার'সহ তার প্রায় ১৫০টির মতো নাটকে অভিনয় করেছি।'
'হুমায়ূন আহমেদকে অনেকেই স্যার বলেন। কিন্তু যেহুতু আমার বন্ধুর বড় ভাই, এই কারণে আমি ভাই ডাকতাম। সম্পর্কটা পারিবারিক হয়ে গিয়েছিল। শুধু হূমায়ূন আহমেদের কারণে আহসান হাবীবের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতাম।'
'তারা তিনজন' সিরিজের বেশ কয়েকটি গল্প নির্মাণ করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। এই নাটকে অভিনয় করেছেন এই দুজনসহ স্বাধীন খসরু। কমেডির আদলে সমাজের নানা ধরনের গল্প উঠে আসত সিরিজটিতে।
কীভাবে এই সিরিজের জন্ম?
এজাজুল ইসলাম বলেন, 'এটা স্যারের মাথা থেকেই বের হয়েছিল। তিনি আমাদের তিনজনকে নিয়ে একটা পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু আমাদের সঙ্গে শেয়ার করলেন না। শুটিংয়ের দিন জানলাম। তারপর এটা বেশ জনপ্রিয় হয়ে গেল। সবাই প্রশংসা করল। তারপর তো নিয়মিত হয়ে গেল।'
আলাপে প্রসঙ্গ আসে জন্মদিনের। হুমায়ূন আহমেদ কীভাবে জন্মদিন পালন করতেন?
ফারুক আহমেদ বলেন, ''স্যার খুব ঘরোয়াভাবে জন্মদিন পালন করতেন। তার জন্মদিনে কাছের মানুষজন তার বাসায় যেত। যাওয়ার সময় অবশ্যই উপহার নিতে হতো। না হলে স্যার জিজ্ঞেস করতেন, 'আমার জন্য কী এনেছ?' যদিও এটা খুব মজা করে জিজ্ঞেস করতেন স্যার। তিনি আসলে এত মজার মানুষ ছিলেন যে, তার সঙ্গ পাওয়াটাই একটা আনন্দ।''
পুরোনো স্মৃতি মনে করে ডা. এজাজুল ইসলাম বলেন, 'একবার স্যারের জন্মদিনে যেতে রাত হয়ে গেল। কি নেব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। পরে গাছ নিয়ে গিয়েছিলাম দুজন। স্যার খুব খুশি হয়েছিলেন। সবাইকে দেখিয়েছেন ডেকে ডেকে।'
ফারুক আহমেদ বলেন, ''তার ছেলের জন্মদিনে একবার দাওয়াত দিতে ভুলে গিয়েছিলেন স্যার। কিন্তু আমরা কোথা থেকে যেন খবর পেয়েছিলাম কোন রেস্টুরেন্টে স্যারের ছেলে নিশাদের জন্মদিন পালন করা হচ্ছে। আমরা দুজন ঠিকই হাজির হয়ে গিয়েছিলাম। পরে ব্যাপারটা নিয়ে স্যার খুব মজা করেছেন। সবাইকে ডেকে বলেছেন, 'এই দুজনকে দাওয়াত করিনি। কিন্তু ঠিকই চলে এসেছে।' এটার নামই ভালোবাসা।''
এজাজুল ইসলাম বলেন, ''স্যারের 'ডাক্তার' ডাকটা খুব মিস করি। তার হাত ধরে মিডিয়াতে আসা। কিন্তু এই সময়ে সবচেয়ে বেশি মিস করি স্যারকেই। তিনি থাকলে আমাদের 'তারা তিনজন' সিরিজ এতদিনে আরও অনেক পর্ব তৈরি হতো।''
ফারুকেরও একই মত। বলেন, 'ভাইয়ের জন্মদিনে একটাই চাওয়া, তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা।'