‘জঁ ক্যা’ হতে যাচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম ইংরেজি ভাষার সিনেমা: ফাখরুল আরেফিন খান
২০১৭ সালে মুক্তি পায় ফাখরুল আরেফিন খান পরিচালিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'ভুবন মাঝি'। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটের এই সিনেমা মুক্তির পর বেশ আলোচনায় আসেন নির্মাতা। দুই বছর পর নির্মাণ করেন 'গণ্ডি' নামে আরও একটি চলচ্চিত্র।
'ভুবন মাঝি' চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন কলকাতার অভিনেতা পরমব্রত আর 'গণ্ডি'তে সব্যসাচী চক্রবর্তী।
এবার পরিচালক উদ্যোগ নিয়েছেন 'জঁ ক্যা' নামে নতুন একটি সিনেমা নির্মাণের। সেসব নিয়ে তার মুখোমুখি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
টিবিএস: চলচ্চিত্র পরিচালক হয়ে ওঠার পেছনের গল্পটা শুনতে চাই।
ফাখরুল আরেফিন খান: সিনেমার পরিবেশের মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছি আমি। আমার বাবা, মামা, চাচা, ফুফুরা সবাই সিনেমা দেখতেন, গান শুনতেন। আমি কিন্তু আশির দশকের কথা বলছি। ওই পরিবেশে বড় হয়ে তো সিনেমার প্রতি একটা আগ্রহ জন্ম নেয়। এটাই সম্ভবত পরে আমার জীবনে ছাপ ফেলেছে।
টিবিএস: ক্যারিয়ার হিসেবে চলচ্চিত্র পরিচালনার তাড়া কবে অনুভব করলেন?
ফাখরুল আরেফিন খান: আমার কখনই চিন্তা ছিল না আমি চলচ্চিত্র পরিচালক হব। ১৯৯৬ সালে যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন আমরা সবাই কিছু না কিছু করার চেষ্টা করতাম। পড়াশোনার বাইরে কিছু করার চেষ্টা আরকি। ওই সময় আমার চলচ্চিত্রের প্রতি একটা আগ্রহ জন্ম নেয়। কারণ, আমি আবিষ্কার করলাম, চলচ্চিত্র আসলে একটা ভাষা। এই ভাষায় চাইলে নিজের কথা বলা যায়। তখন আমি ফিল্ম অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করলাম। তখন জহির রায়হান চলচ্চিত্র সংসদের সঙ্গে কাজ করতে চাইলাম; কিন্তু তারা আমাকে নিল না। কারণ আমি ছাত্র ইউনিয়ন করি না। পরে নিজেই একটা চলচ্চিত্র সংগঠন করলাম। জাহাঙ্গীরনগর স্টুডেন্ট ফিল্ম সোসাইটি। ওখানে ১২৪ জন সদস্য হলো।
মজার ব্যাপার হলো, আমরা কেউই কিন্তু তখন চলচ্চিত্র কী, বুঝি না। কিন্তু আমরা কাজ করব, বুঝব, দেখব- এটাই ছিল লক্ষ্য। ওই সময়ও কিন্তু আমার সিনেমা পরিচালনার চিন্তা মাথায় ছিল না। আমাদের লক্ষ্য ছিল ভালো সিনেমা মানুষকে দেখানো। যেটা দেখলে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে। ভালো দর্শক তৈরি হবে।
তারপর ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটি, অশ্লীলতাবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হলাম। এভাবেই আস্তে আস্তে মোরশেদুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল, তারেক মাসুদসহ ওই সময়ের সব চলচ্চিত্রকারের সঙ্গে পরিচয় ও সম্পর্ক তৈরি হলো। ওয়ার্কশপ করতে গিয়ে সবাইকে আমি শিক্ষক হিসেবে পেলাম। তবে চলচ্চিত্র নিয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে তারেক মাসুদের ৬ মাসের একটি কোর্স। এটা আমার চলচ্চিত্রের একটা পিলার।
টিবিএস: তখনই কি সিনেমা নির্মাণের নেশাটা তৈরি হয়?
ফাখরুল আরেফিন খান: নাহ! তখনও না। তখন আমার চিন্তা ছিল সিনেমা সবার মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে। বলে রাখি, আমার ফটোগ্রাফির একটা নেশা আছে। বাড়ি থেকে আমাকে ২৬ হাজার টাকা দেওয়া হলো ক্যামেরা কেনার জন্য। বলে নিই, আমার কিন্তু জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। যাই হোক, ওই ২৬ হাজার টাকা তখন আমার পকেটে। এটা ২০০৭ সালের ঘটনা। একদিন রাতের বেলা এটিএন বাংলার একটা খবরে দেখলাম, আলী আহসান মুজাহিদ বলছেন, দেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই। আমার কাছে বিষয়টা খুব শকিং লাগল। এটা তো মিথ্যা কথা। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি এটার জবাব দেবো। কিন্তু কীভাবে? আমি তো লিখতে পারি না। তাহলে আমি কি জানি! চলচ্চিত্রের ভাষাটা জানি। তাহলে একটা ডকুমেন্টরি বানাতে পারি।
তখন এক সাংবাদিক ছোটভাইকে নিয়ে রিসার্চ শুরু করলাম। প্রথমে খোঁজ লাগালাম মুজাহিদ আসলে কে? তার ব্যকগ্রাউন্ড কী? বের করলাম, ১৯৭১ সালের আল বদর বাহিনীর জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন আলী আহসান মুজাহিদ। আর সভাপতি ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। আরও রিসার্চ করে পেলাম, ১৯৭১ সালের পুরো আল বদর বাহিনীটাই পরে জামায়াতের ইসলামের নেতৃত্ব দিয়েছে এবং দিচ্ছে। তখন আমি উদ্যোগ নিলাম, এসব বিষয় নিয়ে একটা ডকুমেন্টরি বানাব।
মজার ব্যাপার হলো, ওই সময় আমি এটা বানাতে অনেকের কাছে সাহায্য চেয়েছি। অনেক ক্ষমতবানদের কাছে গিয়েছি। পাইনি। আমি র্যাংগসটেল নামে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম। ৪০ হাজার টাকা বেতন পেতাম। সেটার এগিনিস্টে ব্র্যাক ব্যাংক থেকে চার লাখ টাকা লোন করলাম। সেটার সাথে ক্যামেরা কেনার জন্য রেখে দেওয়া ২৬ হাজার টাকা দিয়ে মাঠে নামলাম। সিনেমাটা বানানোর পরে সেটা দেখে জনতা ব্যাংক থেকে আবুল বারকাত আমাকে এক লাখ টাকা সাহায্য করলেন। বাবার এক বন্ধু এক লাখ টাকা দিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে ৬১ মিনিটের এই ডকুমেন্টরি বানাতে আমার ১০ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছিল। আর ওই চার লাখ টাকা লোনের বিপরীতে সাত লাখ টাকা দিতে হয়েছিল।
টিবিএস: ওটা বানানোর পর কেমন সাড়া পেয়েছিলেন?
ফাখরুল আরেফিন খান: এটা একটা অভূতপূর্ব সাড়া। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সারা দেশে এটার শো করল। সেক্টর কমান্ডার ফোরাম নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় দেখাল। এটা দেখাতে গিয়ে শেরপুর ও পাবনায় মারামারি হলো। বিশেষ ট্রাইবুনালে ডকুমেন্টরিটিটা একটা সাক্ষী হিসেবে কাজ করেছে। আমার জীবনের নিরাপত্তা নিয়েও তখন সংশয় দেখা দিয়েছিল। তখনও আমি আসলে ভাবিনি, ফিল্মমেকার হবো।
তারপর নির্মাণ করলাম 'দ্য স্পিচ' নামে আরও একটা ডকুমেন্টরি। এটা হলো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন পেশার মানুষের কী ভাবনা ছিল, সেটা নিয়ে। এটাতেও বেশ সাড়া পড়ে গেল। এই দুটির পরে ডকুমেন্টরি বানালেও আমার একটা বিষয়ের ওপর আগ্রহ ছিল। সেটা হলো কুষ্টিয়ার লালন সাইজিকে নিয়ে। তিনি এখন যেখানে শুয়ে আছেন, সেটার নাম হকের ঘর। এই ঘরটাকে কেন্দ্র করে বাউল মেলা ও টাকা পয়সার একটা সিন্ডিকেট আছে। এটা আসলে বাউলদের দখলে থাকার কথা থাকলেও সেটা আর নাই। সব দলের মানুষ এটা ভোগ করেন। সেটার বিরুদ্ধে একজন সাধারণ বাউল ফকির মন্টু শাহ মামলা করেন। তিনি জিতে গেলেও কিন্তু একটা পয়েন্টে আটকে যান। পরে আর ওই টাকা বা পুরো আখরা বাউলরা ফিরে পাননি। সেটা নিয়ে আমি একটু ডকুমেন্টরি বানাই। নাম দিই 'হকের ঘর'। সেটা আগামী মাসে রিলিজ হবে আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে।
বাউলদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নহির শাহ নামে এক বাউলের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তার সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে জানি, তিনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন। জানতে চাই, বাউল হয়ে তিনি কী করে যুদ্ধে গেলেন। বাউলরা তো জীবহত্যা করে না। মশা-মাছিও মারে না। তিনি একটা গল্প বলেন। তখনই আমার মনে হয়, এটা নিয়ে সিনেমা হতে পারে। তখনই গল্পটা একটা টিস্যু পেপারে লিখি। তারপর ঠিকঠাক করে সরকারি অনুদানের জন্য জমা দিই। সরকার অনুদানও দেয়। তারপরই আসলে ফিল করি, আমি আসলে চলচ্চিত্র পরিচালক হবো। এ কারণে 'ভুবন মাঝি'র প্রধান চরিত্রের নামও কিন্তু নহীর।
টিবিএস: আপনার সিনেমায় কলকাতা অভিনয়শিল্পীরা কাজ করেন বেশি। কারণ কী?
ফাখরুল আরেফিন খান: আসলে চরিত্রটা যাকে ডিমান্ড করে, তাকেই নেওয়া হয়। আলাদা করে ভাবিনি কখনো। তাছাড়া, সব ডিরেক্টরের একটা সার্কেল আছে। সে কারণে এটা হয়। আর ডিরেক্টরের সঙ্গে আর্টিস্টদের একটা সম্পর্ক থাকা জরি। সাথে ডিওপির সাথে।
টিবিএস: প্রথম ছবি ছিল মুক্তিযুদ্ধের। তৃতীয় ছবিটিও তাই। মুক্তিযুদ্ধের ওপর বিশেষ দুর্বলতা আছে নিশ্চয়?
ফাখরুল আরেফিন খান: সত্যি কথা বলতে মুক্তিযুদ্ধের ওপর আমার সবসময় একটা দুর্বলতা আছে। আমার দেখা প্রথম চলচ্চিত্রের নাম 'সংগ্রাম'। বাবা আমাকে হাত ধরে নিয়ে গুলিস্তান সিনেমা হলে সিনেমাটি দেখিয়েছিলেন। ওই সিনেমা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। আর একটা কারণে আমাকে মুক্তিযুদ্ধ টানে। ১৯৮৪ সালে দেখা 'আগামী' সিনেমাটা। তখন আমার বয়স ছিল ১০ বছর। ওই বয়সেই সিনেমাটা আমাকে আলোড়িত করেছে। ওইটার ফলাফল হলো 'আল বদর' ও 'ভুবন মাঝি'।
টিবিএস: 'জঁ ক্যা ' ছবিটির চিন্তা কবে মাথায় এলো এবং কীভাবে?
ফাখরুল আরেফিন খান: ২০১৬ সালে দৈনিক প্রথম আলোতে একটা প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। যে প্রতিবেদন পড়ে ৪৯ বছর আগে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বরের একটি ঘটনা জানতে পারি। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের (পিআইএ) 'সিটি অব কুমিল্লা' নামে একটি বোয়িং-৭২০বি বিমান অবতরণ করে প্যারিস অরলি বিমানবন্দরে। ১৭ জন যাত্রী ও ৬ জন ক্রু নিয়ে বিমানটি লন্ডন থেকে প্যারিস, রোম ও কায়রো হয়ে করাচি যাবে। এর মধ্যে পাঁচজন যাত্রী প্যারিস থেকে উঠবেন। ওই পাঁচজনের সঙ্গে বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যূহ পেরিয়ে বোয়িংটিতে উঠে বসেন ২৮ বছর বয়সী যুবক জঁ ক্যা। পাইলট আকাশে ওড়ার প্রস্তুতি হিসেবে বিমানটি চালু করতেই পকেট থেকে পিস্তল বের করে জঁ ইঞ্জিন বন্ধ করার নির্দেশ দেন। কেউ তার নির্দেশ অমান্য করলে সঙ্গে থাকা বোমা দিয়ে পুরো বিমানবন্দর উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। (আসলে জঁর সঙ্গে কোনো বোমা ছিল না!) তখন ওয়্যারলেসটি কেড়ে নিয়ে নিয়ন্ত্রণকক্ষের মাধ্যমে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের উদ্দেশে জঁ নির্দেশ দেন, বিমানটিতে যেন ২০ টন ওষুধ ও চিকিত্সাসামগ্রী তুলে দেয়। সেটা যুদ্ধাহত ও বাংলাদেশি শরণার্থীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। কারণ জঁ ক্যা জেনেছেন, ভারতের শরণার্থী শিবিরে বাংলাদেশের ৫ লাখ শিশু বিনাচিকিৎসায় মৃত্যবরণ করেছে। এটা তার মনে দাগ কাটে। আর যেন কোনো শিশু এভাবে মৃত্যুবরণ না করে, এই কারণেই তিনি ওষুধ তুলে দিয়ে বিমানটি ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেন।
পুলিশ ও সেনাবাহিনীর একটা বড় অংশ পৌঁছে যায় বিমানবন্দরে। জঁর কথামতো মালামাল তোলার একফাঁকে সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য উঠে পড়েন প্লেনটিতে। তারা জঁ'কে গ্রেপ্তার করেন। যদিও তার কথামতো ফরাসি সরকার রেডক্রস ও আরেক ফরাসি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা 'অর্ডি দ্য মানতে'র সহায়তায় ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী পাঠিয়েছিল। এই ঘটনাটা নিয়েই আমার সিনেমা। পরে অবশ্য এই ঘটনায় জঁর পাঁচ বছরের জেল হয়।
টিবিএস: কাজ কতদূর হয়েছে?
ফাখরুল আরেফিন খান: কাজ অনেকদূর এগিয়েছে। এরইমধ্যে অভিনয়শিল্পী চূড়ান্ত করেছি। শুটিং হবে ফ্রান্সে আর ভারতের 'ফ্রেঞ্চ ইন্ডিয়া'র চার এলাকার একটি, পদুচেরিতে। শুটিং শেষ করে আগামী ৩ ডিসেম্বর ছবিটি মুক্তি দেওয়ার ইচ্ছা আছে। এটা ইংরেজি ভাষার সিনেমা। আমি যতদূর জানি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই প্রথম ইংরেজি ভাষার সিনেমা হতে যাচ্ছে।
টিবিএস: নতুন কোনো সিনেমার পরিকল্পনা কি মাথায় আছে?
ফাখরুল আরেফিন খান: আরও কয়েকটি সিনেমার পরিকল্পনা ও গল্প নিয়ে ঘুরছি। এর মধ্যে সায়েন্স ফিকশন, নারী প্রধান গল্প নিয়ে সিনেমাও আছে। দেখা যাক কতদূর কি করতে পারি।