‘আমি ছাড়া আমাকে নিয়ে আর কেউ সিনেমা বানাবে!’: ম্যাডোনা
ম্যাডোনা'র ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইল তার অনুসারীদের কখনো হতাশ করে না। তার প্রোফাইলে তাকে নানা ঢংয়ে দেখতে পান ফলোয়ারেরা। কখনো তিনি কাঁদছেন, কখনো মাতাল, কখনও পরিবারের ভিডিও, ব্রিটনি স্পিয়ার্সের বিয়েতে তাকে শুভেচ্ছার চুমু খাচ্ছেন- এসব বিচিত্র কাজকারবারে ভরপুর ম্যাডোনার ইনস্টাগ্রাম।
পরের প্রজন্মের শিল্পীদের তুলনায় ইনস্টাগ্রামে ম্যাডোনার অনুসারীর সংখ্যা বেশ কম। কিন্তু অন্যদের চেয়ে তার শেয়ারই সবচেয়ে বেশি। শৈল্পিক ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ দুটোকেই ছাড়িয়ে যান ম্যাডোনা। গত ৪০ বছরের বেশি সময় সঙ্গীতজগতের সঙ্গে যুক্ত আছেন তিনি। এ মাসেই নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে 'ফাইনালি এনাফ লাভ: ফিফটি নাম্বার ওয়ানস' নামক একটি রেমিক্স অ্যালবাম বাজারে ছাড়ছেন তিনি। এছাড়া ম্যাডোনার বায়োগ্রাফি সিনেমার প্রোডাকশনের কাজও চলছে।
ম্যাডোনার ইনস্টাগ্রামের উন্মাদনার সঙ্গে তার শিল্পীজীবনেরও বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ২৫ বছর বয়সে, ১৯৮২ সালে সঙ্গীতের দুনিয়ায় পা রাখার পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন তিনি। একজন পপ তারকা হিসেবে যৌন হয়রানি থেকে শুরু করে দেশপ্রেমহীনতাসহ নানা, ধরনের হয়রানিরই শিকার হয়েছেন। তবে তার কর্মকাণ্ডও অনেক ক্ষেত্রেই লাগামছাড়াও হয়েছে।
১৯৮০'র দশকে নিজের মিউজিক ভিডিওতে ক্রুশ পুড়িয়েছিলেন তিনি। ১৯৯০'র দশকে 'সেক্স' নামের একটি বই প্রকাশ করেন। সেখানে হোমোসেক্সুয়ালিটি ও ফেটিশিজম নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা ও যথেষ্ট খোলামেলা ছবি প্রকাশ করেন। যথেষ্ট হৈচৈ হয়েছে।
সবসময় মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে চাওয়া ম্যাডোনা গত ৪০ বছর এ বিদ্রোহী কর্মকানণ্ডর জন্য আলোচনায় এসেছেন। কিন্তু এসবের মাঝেও তার ভালো অ্যালবামের সংখ্যাও কম নয়, যদিও তার গলা সবসময় উৎকর্ষের উচ্চ অবস্থানে ছিল, তাও না। এভিটা (১৯৯৬) সিনেমার জন্য তিনি প্রচুর খেটেছেন, সঙ্গীত কোচদের কাছে প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছিল অনেকদিন।
চার দশকের ক্যারিয়ারে ম্যাডোনা ১৪টির মতো অ্যালবাম বের করেছেন। এর মধ্যে কমপক্ষে পাঁচটি অ্যালবাম সবারই শোনার প্রয়োজনের পর্যায়ে পড়ে। তার প্রথম দুটি অ্যালবাম (ম্যাডোনা, ১৯৮৩; লাইক আ ভার্জিন, ১৯৮৪) আশির দশকের ড্যান্স পপ ঘরানার সঙ্গীতের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। তার বেশ কয়েকটি গান ও ১৯৮৯ সালের অ্যালবাম 'লাইক আ প্রেয়ার' এখনো সমান জনপ্রিয়। এ অ্যালবামটিকে ম্যাডোনার সর্বোত্তম কাজ বলে ধরা যায়।
ডেট্রয়েটের একটি ছোট শহরে জন্ম ম্যাডোনা ছয় বছর বয়সে মাকে হারান। ২৫ কোটির মতো রেকর্ড বিক্রি হয়েছে তার। ইতিহাসের বেস্ট-সেলিং নারী সঙ্গীতশিল্পী তিনি। ২০ বছর বয়সে বাবার নিষেধ সত্ত্বেও নিউ ইয়র্কে চলে যান। সেখানে মডেলিংয়ের যাত্রা শুরু হয়। এরপর ন্যুড শিল্পী হিসেবেও কাজ করেছেন। সঙ্গীতজীবনের শুরুতে তাকে প্রতিযোগিতা করতে হয়েছে প্রিন্স, মাইকেল জ্যাকসন, ব্রুস স্প্রিংসটিন, ফিল কলিনস, জর্জ মাইকেল, ইউটু'র মতো প্রখ্যাত পুরুষ শিল্পীদের সঙ্গে।
পুরুষ প্রাধান্যের এ পটভূমিতে নিজের যৌনতাকে ব্যবহার করে ম্যাডোনা নিজের ভাবমূর্তি তৈরি ও সঙ্গীতজগতে নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের উপায় বের করেন। তবে ম্যাডোনার যৌনতা তার পুরুষ অডিয়েন্সের বিনোদনের জন্য ছিল না। ম্যাডোনা ছিলেন একজন প্রতিপত্তিশালী ও বেপরোয়া নারী। অন্যদিকে নিজের ৩০ বছর বয়সে প্রথমবারের মতো মদ্যপান করেন, তাও অভিনেতা শন পেনের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পরে। চঞ্চল ও কৌতূহলী ম্যাডোনা সবসময় কিথ হারিং ও জ্যঁ-মিশেল ব্যাসকুইয়াতের মতো সাহসী শিল্পীদের সঙ্গ খুঁজেছিলেন।
কিন্তু খুব শীঘ্রই ম্যাডোনা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি যে পরিবেশে আছেন তা কোনো স্বাধীনচেতা নারীর সাফল্যকে সহ্য করতে পারে না। ১৯৭৯ সালে ম্যাডোনা যখন বিখ্যাত হয়ে ওঠেননি, তখন তোলা তার কিছু খোলামেলা ছবি ১৯৮৫ সালে প্রাপ্তবয়স্কদের ম্যাগাজিন প্লেবয় ও পেন্টহাউজে প্রকাশিত হয়। ম্যাডোনার চেয়ে এ ম্যাগাজিনগুলো বরং ম্যাডোনার খ্যাতিকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগিয়েছিল, তারা ছবিগুলো মোটা লাভে বিক্রি করেছিল।
এ ঘটনা থেকে সেই প্রথমবারের মতো পরিস্থিতি বুঝতে পারেন ম্যাডোনা। এবং দমে না গিয়ে, পাছে লোকে কিছু বলে এ সঙ্কোচ উড়িয়ে দিয়ে- ভয়ে সিটিয়ে যাননি, বলা যায় এরপর আর কখনো আপোষ করেননি এ শিল্পী। ২০১৬ সালে রোলিং স্টোন ম্যাগাজিন তাকে 'উইম্যান অভ দ্য ইয়ার' খেতাব দেয়।
ম্যাডোনা কেবল একজন পপ তারকাই নন, তিনি বিদ্রোহ, ও সংহতি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রতীক। হাল আমলের জনপ্রিয় পপ তারকা বিয়ন্সে এক চিরকুটে ম্যাডোনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিখেছিলেন, 'আমি আপনার কাছে ভীষণ কৃতজ্ঞ। আপনি অনেক নারীর জন্য অসংখ্য সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছেন। আপনি একজন মাস্টারপিস জিনিয়াস।'
স্প্যানিশভাষী অধুনা সঙ্গীতশিল্পীদের মাঝেও ম্যাডোনা বেশ আইকন। আর্জেন্টিনার মিস নিনা'র কাছে ম্যাডোনা অনুপ্রেরণার উৎস। ইনস্টাগ্রামে তার প্রোফাইলে যত বেশি মানুষ ঘৃণা ছড়াক না কেন, ম্যাডোনা কখনো হাল ছেড়ে দেবেন না। কুইয়ার কমিউনিটির প্রতি নিজের অঙ্গীকার বজায় রাখতে সমকামী র্যাপার সসি সানটানার সঙ্গে মিলে 'ম্যাটেরিয়াল গার্ল' নামক একটি গান প্রকাশ করেছেন ম্যাডোনা। তার ১৯৮০'র দশকের সুপারহিট 'ম্যাটেরিয়াল গার্ল' গানের রেমিক্স সংস্করণ এটি।
তিন সপ্তাহে আগে ভ্যারাইটিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ম্যাডোনা নিজের বায়োগ্রাফি সিনেমার ঘোষণা দিয়েছেন। ওই সিনেমায় তার চরিত্রে অভিনয় করবেন জুলিয়া গার্নার। নিজেই উদ্যোগ নিয়ে নিজের জীবনের ওপর সিনেমা বানাচ্ছেন তিনি। ম্যাডোনা বলেন, "অনেক মানুষই আমাকে নিয়ে সিনেমা বানাতে চাচ্ছিল, এদের বেশিরভাগই নারীবিদ্বেষী। তাই আমি বলি, 'আমাকে নিয়ে আমি ছাড়া আর কেউ সিনেমা বানাবে না।'" এভাবে আরেকবার ম্যাডোনার মতোই সিদ্ধান্ত নিলেন ম্যাডোনা।
সূত্র: এল পাইস