পশ্চিমা দর্শকেরা কেন ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘আরআরআর’ জাদুতে মুগ্ধ?
দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্র আরআরআর মুক্তির পর পেরিয়ে গেছে দশটি মাস, কিন্তু ভারত এবং পশ্চিমা বিশ্বে এখনো এই সিনেমাটিকে ঘিরে উৎসাহ-উন্মাদনা কমেনি। দেশ-বিদেশে একাধিক পুরস্কার জিতে নেওয়া, এসএস রাজামৌলি পরিচালিত এই চলচ্চিত্র ভারতীয় সিনেমার জন্য নতুন গৌরবের ইতিহাস গড়েছে। মাত্র সপ্তাহখানেক আগেই সিনেমার 'নাটু নাটু' গানটি গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড জিতেছে। হলিউড ও বিদেশি ভাষার অসংখ্য সিনেমার ভিড়ে আরআরআর-এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ পশ্চিমা সিনেমাবোদ্ধা ও সিনেমা সমালোচকেরা। কিন্তু কেন হলিউডে আরআরআর-এর এই জয়গান? কী আছে এই দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্রের মধ্যে, যে জাদুতে মুগ্ধ হয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব?
পরিচালক রাজামৌলি বলেছেন, তিনি মূলত দেশে এবং দেশের বাইরে বসবাসকারী ভারতীয়দের জন্যই এই চলচ্চিত্রটি বানিয়েছেন। কিন্তু মুক্তি পাওয়ার পর থেকে দক্ষিণী অভিনেতা রাম চরণ ও এনটিআর জুনিয়র অভিনীত সিনেমাটি যেন সেই সীমারেখাকে ছাড়িয়ে গেছে। এখন শুধু ভারতীয়রা নন, অন্য অনেক দেশের দর্শকরাই এই সিনেমার গভীরতা উপলব্ধি করতে পারছেন।
আরআরআর সিনেমার গল্প ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দুই ভারতীয় বিপ্লবীর সংগ্রামকে কেন্দ্র করে। ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী ১৪৬.৫ মিলিয়ন ডলার ব্যবসা করেছে এই সিনেমা। মুক্তির পর কয়েক সপ্তাহ নেটফ্লিক্সের সেরা দশে ছিল এই ছবি এবং এই মুহূর্তে জাপানের বক্স অফিস রেকর্ড ভাঙ্গার পথে আরআরআর। ২০২২ সালের সেরা চলচ্চিত্রের তালিকায় একাধিকবার এসেছে এই সিনেমার নাম; ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল বোর্ড অব রিভিউ'র করা সেরা সিনেমার তালিকায়ও ছিল আরআরআর।
গত সপ্তাহেই রাজামৌলির এ সিনেমার 'নাটু নাটু' গানটি 'বেস্ট অরিজিনাল সং' বিভাগে গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার জিতেছে যা সারা বিশ্বকে আরও একবার এই ভারতীয় সিনেমার মাহাত্ম্য সম্পর্কে অবগত করেছে। বিবিসি কালচার-এর চলচ্চিত্র সমালোচক নিকোলাস বার্বার ও ক্যারিন জেমস আরআরআরকে তাদের ২০২২ সালের সেরা ২০টি চলচ্চিত্রের তালিকায় রেখেছেন।
নিজের সিনেমাকে বিশ্বদরবারে পৌঁছাতে পেরে পরিচালক এসএস রাজামৌলির আনন্দ ও বিস্ময় বেশকিছু সাক্ষাৎকারেই চোখে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি টকশো লেট নাইট উইথ সেথ মায়ার্স-এ উপস্থিত হয়ে মজার ছলে রাজামৌলি বলেছিলেন, "যখন আমরা পশ্চিমাদের কাছ থেকে এই সিনেমা নিয়ে প্রশংসা পেতে শুরু করি, তখন ভেবেছিলাম এরা নিশ্চয়ই সিনেমা দেখতে যাওয়া প্রবাসী ভারতীয়দের বন্ধু।"
আরআরআর যখন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম মুক্তি পায়, তখন আর দশটা গতানুগতিক ভারতীয় সিনেমার চেয়ে এটি আলাদা কিছু ছিল না, বলেন নিউইয়র্ক-ভিত্তিক সমালোচক সিদ্ধান্ত আদলাখা। তিনি নিউ ইয়র্ক ফিল্ম ক্রিটিকস সার্কেলের সদস্য, যেটি কিনা এসএস রাজামৌলিকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের সেরা পরিচালক হিসেবে ঘোষণা করেছে।
আদলাখা বলেন, "মুক্তির প্রথম সপ্তাহে এই সিনেমার বেশিরভাগ দর্শকই ছিল ভারতীয়। কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বিভিন্ন স্তরের দর্শক এসে ছবিটি দেখতে আরম্ভ করে।"
যত বেশি দর্শক ছবিটি দেখেছে, তত বেশি মানুষ তাদের কাছ থেকে ছবিটির প্রশংসা শুনে সিনেমা হলে ছুটে এসেছে, সিনেমা সমালোচকেরা লম্বাচওড়া রিভিউ লিখেছেন — এ-লিস্টেড হলিউড চলচ্চিত্র নির্মাতারা যেমন, অ্যান্থনি এবং জো রুশো, এডগার রাইট, স্কট ডেরিকসন এবং জেমস গান আরআরআর-এর প্রশংসা করেছেন।
আমেরিকান ডিস্ট্রিবিউটররাও বলেছেন যে তারা এই সিনেমার প্রতি দর্শকদের ব্যাপক আগ্রহ দেখেই এটি সিনেমা হলে প্রদর্শন করেছেন। আগেপরের অন্য যেকোনো ভারতীয় চলচ্চিত্রের চেয়ে এই দক্ষিণী সিনেমাটি একেবারেই অন্যরকম সাড়া পেয়েছে পশ্চিমাদের কাছে। ছবিটি দেখতে গিয়ে দর্শকদের উল্লাস ও হইচইয়ের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতীয় অভিনেতাদের চলচ্চিত্র নিয়ে এমন উদ্দাম উত্তেজনা যুক্তরাষ্ট্রে বিরল।
পরিচালক জে জে আব্রামস লস অ্যাঞ্জেলেসের বিখ্যাত চাইনিজ থিয়েটারে আরআরআর সিনেমার একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন, যেখানে মানুষ 'নাটু নাটু' গানে নাচার জন্য মঞ্চে ছুটে গিয়েছিল। সিদ্ধান্ত আদলাখার ভাষ্যে, "আরআরআর দর্শকদের, এমনকি পরিচালকদেরও একটু ভিন্ন ধরনের সিনেমার সাথে পরিচয় করাচ্ছে, যা হয়তো তারা আগেপরে দেখে অভ্যস্ত নয় — আর ঠিক সে কারণেই হলিউডের নির্মাতারা ছবিটি এত পছন্দ করছেন।
আরআরআর সিনেমার গল্প এবং তা যথাযথভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি, সময়ের বিষয়টিও সাহায্য করেছে। টিভি হোস্ট ও বিনোদন সংবাদমাধ্যম লেইনিগসিপ এর প্রতিষ্ঠাতা এলাইন লুই বলেন, "আরআরআর খুবই বলিষ্ঠ একটি চলচ্চিত্র। শত শত মানুষ এই ছবিটি সিনেমা হলে গিয়ে কিংবা নেটফ্লিক্সে দেখার জন্য অপেক্ষা করছিল।"
যদিও আরআরআর সিনেমার মাধ্যমেই অস্কারে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয়নি ভারত, বরং গুজরাটি ভাষার চলচ্চিত্র ছেল্লো শো-এর কাছে গেছে সেই বিরল সম্মান। হলিউড চলচ্চিত্র নির্মাতারা এটিকে 'অসাধারণ ও দুর্দান্ত চলচ্চিত্র' বলে অভিহিত করেছেন।
তবে ট্রেড ম্যাগাজিন ভ্যারাইটি মনে করছে, আরআরআর সিনেমাটি সেরা চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালক, সেরা কোরিওগ্রাফি এবং সেরা মৌলিক গান শাখায় মনোনয়ন পেতে পারত।
এসএস রাজামৌলি তার ছবিটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র শাখায় জমা দেননি, কিন্তু হলিউডের অনেক হেভিওয়েট চলচ্চিত্রের সাথে এটি প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার যোগ্যতা রাখে বলে মনে করেন লুই। তিনি বলেন, "চলচ্চিত্র শিল্পে কোনো সিনেমা নিয়ে তুমুল হইচই তৈরি হওয়া একটি বড় ব্যাপার। আরআরআর এখন আলোচনার অংশ হয়ে গেছে। সপ্তাহান্তে বা কোনো পার্টিতে গেলেই সবাই একে অন্যকে জিজ্ঞেস করছে, তুমি কি আরআরআর সিনেমাটা দেখেছ?"
পাশ্চাত্যের অনেকের কাছেই সিনেমাটি বেশ উত্তেজনাকর ও ভিন্ন ধাঁচের মনে হয়েছে; যেহেতু বহু বছর ধরেই মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স এবং ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস-এর মতো সিনেমাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বক্স অফিসে রাজত্ব করছে।
আদলাখা বলেন, "ব্লকবাস্টার সিনেমাগুলো যখন খুবই কর্কশ ধরনের হয় কিংবা এতে যত্নের অভাব থাকে বা কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের মতো একই ধাঁচের হয়ে যায়; তখন আরআরআর-এর মতো সিনেমা যা অনেক যত্ন নিয়ে বানানো হয়েছে এবং সিনেমা নামক শিল্পকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, সেটির আবেদন দর্শকের কাছে বেড়ে যায়।"
আর. রাজামৌলির নিজস্ব স্টাইল অনুযায়ীই আরআরআর সিনেমায় দেখা যায় নতুনত্ব এবং ইমাজিনেটিভ স্টোরিটেলিং যা দর্শককে এক অদ্বিতীয় অভিজ্ঞতা দেয়। আরআরআর-এর একটি স্ট্যান্ডআউট দৃশ্যে দেখা যায়, যখন ছবির নায়কদের প্রথম দেখা হয়-তারা ঘোড়ায় এবং মোটরবাইকে চড়ে আসে, এর পরের একটি দৃশ্যে তারা আগুনের মধ্যে আটকে পড়া একটি শিশুকে উদ্ধার করতে ছুটে যায়।
আদলাখার মতে, "আমেরিকান দর্শকেরা এ ধরনের ম্যাক্সিমালিস্ট দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত নয়। কিন্তু আরআরআর সিনেমাটি এমনভাবে নির্মিত যে যেকোনো সংস্কৃতির মানুষই ছবিটির সাথে একাত্ম হতে পারবে।"
এছাড়াও, বলিউড ও টলিউডের (তেলুগু) চলচ্চিত্রের বাইরেও ভারতীয় দর্শকেরা কী ধরনের সিনেমা প্রত্যাশা করে নির্মাতাদের কাছ থেকে, সেটিও বোঝা গেছে আরআরআর-এর মাধ্যমে। আর সেটি হলো, অ্যাকশন দৃশ্য থাকবে অনেক, অনেক মানুষ থাকবে; কিন্তু গতানুগতিক হওয়া চলবে না।"
এদিকে ভারতে রাজামৌলির সিনেমার সাফল্য নতুন কিছু নয়, সেখানে তিনি ইতোমধ্যেই একজন খ্যাতনামা পরিচালক। তার নির্মিত চলচ্চিত্র বাহুবলি এবং বাহুবলি ২ দেখেনি বা নাম শোনেনি এমন সিনেমাপ্রেমী পাওয়া দুষ্কর! তাই তারকায় ঠাসা সিনেমা আরআরআর নিয়েও সকলের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি।
কিন্তু কিছু সমালোচকের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লাভ করেছে আরআরআর। তারা এই ছবিতে নিহিত রাজনৈতিক সমস্যা, হিন্দু আইকনোগ্রাফির ব্যবহার এবং আদিবাসী সংস্কৃতি গ্রাস হওয়ার মতো বিষয়গুলোর দিকে আঙুল তুলেছেন।
ভারতে সিনেমাকে রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারের একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয় বলে মতামত ব্যক্ত করেন চলচ্চিত্র সমালোচক সোম্য রাজেন্দ্রান। তাই ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতে আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করা, সত্যিকারের দুই বিপ্লবীর জীবন ও কর্মকাণ্ডকে সিনেমার পর্দায় তুলে ধরার ক্ষেত্রে তাদেরকে আবার হিন্দু পৌরাণিক বীরদের চরিত্রের সাথে কল্পনা করায় এক ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
কিন্তু পশ্চিমা দর্শকরা আরআরআর সিনেমাকে 'ঔপনিবেশ-বিরোধী ন্যারেটিভ' হিসেবেই বেশি গ্রহণ করেছেন, কারণ সেভাবেই তারা সিনেমাটি প্রত্যক্ষভাবে বুঝতে পেরেছেন, বলেন রাজেন্দ্রান।
আদলাখা আরও বলেন, আরআরআর সিনেমা নিয়ে প্রশংসা যেমন রয়েছে, তেমনই কিছু সমালোচনাও রয়েছে; কিন্তু সেগুলোও এই সিনেমা নিয়ে ব্যাপক আলোচনারই অংশ হয়ে উঠেছে।
আরআরআর নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকার পাশাপাশি, একটি বিষয় নিশ্চিত যে পরিচালক এসএস রাজামৌলি এবং তার টিম এই সিনেমার মাধ্যমেই ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মধ্যকার এবং সেই সঙ্গে বহির্বিশ্বেরও এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে ফেলেছেন।
আর এখানেই শেষ নয়, এসএস রাজামৌলির পরবর্তী লক্ষ্য হতে পারে একটি হলিউড চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যা 'প্রত্যেক চলচ্চিত্র নির্মাতার স্বপ্ন থাকে' বলে উল্লেখ করেছেন রাজামৌলি নিজেই।
সূত্র: বিবিসি