অ্যাভাটার দ্য লাস্ট এয়ারবেন্ডার: নেটফ্লিক্সের 'ব্যর্থ' রিমেক না-কি নতুন এক অভিজ্ঞতা?
'অ্যাভাটার দ্য লাস্ট এয়ারবেন্ডার'-এর নাম শুনলেই অ্যানিমে প্রেমীদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে উড়ে বেড়ানো স্কাই বাইসন কিংবা পাখা ওয়ালা লেমুর অথবা অগ্নি কাই এর শ্বাসরুদ্ধকর অ্যাকশন। ৯০ দশকের কিশোরদের কাছে এক অন্যরকম আকর্ষণ ছিল নিকলডিওনের এই অ্যানিমেটেড সিরিজটি। অ্যাং, কাটারা, সাকা কিংবা জুকো চরিত্রের সাথেই বড় হয়েছে এই প্রজন্ম।
সেই জনপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখেই এই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি নেটফ্লিক্স নিয়ে এসেছে 'অ্যাভাটার দ্য লাস্ট এয়ারবেন্ডার'-এর লাইভ অ্যাকশন ড্রামা সিরিজ। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যৌথ প্রযোজনায় এই সিরিজটি পুনঃনির্মাণের ঘোষণা দেয় নিকলডিওন ও নেটফ্লিক্স।
ঘোষণার প্রায় ৬ বছর পর মুক্তি পেল বহুল প্রতীক্ষিত এই সিরিজটি। নতুন এই লাইভ অ্যাকশন নিয়ে নানা রকম মনোভাব দেখা গেছে অ্যানিমে প্রেমীদের মধ্যে। তবে কেমন হয়েছে জনপ্রিয় সিরিজটির নতুন এই রূপ?
হতাশা নাকি সাধ্যের মধ্যে সবটুকু?
মাটি (আর্থ), পানি (ওয়াটার), অগ্নি (ফায়ার) এবং বাতাস (এয়ার) এই চার মূল উপাদানকে কেন্দ্র করে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতেই বিভিন্ন যুগে জন্ম নেয় অ্যাভাটার। ১২ বছর বয়সী এয়ার 'বেন্ডার' অ্যাং এর অ্যাভাটার হয়ে ওঠার যাত্রা নিয়েই আবর্তিত হয় সিরিজটির গল্প।
তিনটি সিজনে মোট ৬১টি পর্বে নির্মিত হয়েছে অ্যানিমে সিরিজটি। অ্যানিমে সিরিজের ২১ পর্বের প্রথম সিজনে বলা গল্পই নেটফ্লিক্স তাদের নতুন লাইভ অ্যাকশন সিরিজের মাত্র আটটি পর্বে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে। তাই বোধহয় একই ধরনের অনুভূতি পাওয়া সম্ভব না। নতুন লাইভ অ্যাকশন সিরিজে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়েছে এত অল্প সময়ে গল্প বলার খাতিরে।
শুরুতেই 'অ্যাং' পর্বের আইকনিক এক দৃশ্য যেখানে প্রথমবারের মত পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় চার 'ইলেমেন্টসের' সাথে। তা একেবারে অ্যানিমের সিরিজের মতো না হলেও খুব একটা মন্দ হয়নি। তবে বলতেই হয়, অ্যানিমে সিরিজের মতো সাকা (ইয়ান ওজলি) কিংবা অন্যান্যদের 'কমিক রিলিফ' কৌতূকগুলো অনেকটা জোর করেই বসানো হয়েছে বলে মনে হয় নতুন এই সিরিজটিতে।
সিরিজের অন্যতম জনপ্রিয় 'আংকেল আয়রোহ'(পল সুন হিয়োং লি) চরিত্রটিকে বেশ সুন্দরভাবে সাজালেও কিছু কিছু জায়গায় তার কথোপকথন নিয়ে তাড়াহুড়ো করা হয়েছে বলেও মনে হয়েছে। এছাড়াও অ্যানিমে সিরিজের জেনারেল আইরোহ আরো অনেক বেশি ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ। পুরো একটি পর্ব দেয়া হলেও 'ওমাশুর' রাজা 'বুমি'(উৎকর্ষ আমবুদকার) 'ইনটু দ্য ডার্ক' পর্বে আরো অনেক বেশি রোমাঞ্চকর হতে পারতো।
আবার পর্বটিতে বুমির উপস্থিতি অ্যানিমে ভার্সনের কাছাকাছি যেতে পারেনি। যদিও অ্যানিমের রাজা বুমি অ্যাংকে অনেক বেশি সমাদর করলেও লাইভ অ্যাকশনে দেখা পাওয়া যায় অ্যাং এর উপর তার ক্ষোভ। 'মজাদার বুদ্ধিমত্তার' কোন খেলা নয় বরং অ্যাভাটার হিসেবে অ্যাং এর কেমন হওয়া উচিত, তার কি ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে তাই বোঝাতে চায় এখানের বুমি। তবে এই পর্বে সবচেয়ে সুন্দর চরিত্রায়ণ হয়েছে 'বাঁধাকপি ওয়ালার', তা না বললেই নয়!
পুরো সিরিজ জুড়েই তাড়াহুড়োর বিষয়টি চোখে পরার মতো। তবে সময়ের কথা মাথায় রাখলে এই বিষয়টিকে উপেক্ষা করাই যায়। মাঝে মাঝেই গল্পের পরিবর্তনও হয়েছে এ কারণেই। তবে এত সব পরিবর্তন আর সময়ের ঝুটঝামেলার মধ্যেও 'জুকো' (ডালাস জেমস লিউ) চরিত্রটি তার জৌলুস ধরে রেখেছে। অ্যানিমে এবং লাইভ অ্যাকশন উভয় সিরিজেই জুকোর চারিত্রিক পরিবর্তনের যে সফর তা খুবই সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
এদিকে লাইভ অ্যাকশন সিরিজের প্রথম পর্বে মঙ্ক গিয়াৎসুর (লিম কে সিউ) মৃতদেহ প্রায় ১০০ বছর পর আবিষ্কার করার পর রাগ, দুঃখ এবং ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। যেখানে প্রথমবারের মতো অ্যাভাটার রূপে আসে অ্যাং (গরডন করমিয়ের)।
পরবর্তীতে তার শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করে অ্যাং; যা অ্যানিমে সিরিজে ছিল না। তবে এটা একটা সুন্দর সংযোজন ছিল লাইভ অ্যাকশন সিরিজে।
আবার 'ওয়ারিওরস' পর্বে কিয়োসি দ্বীপে তাদের সফর সুন্দরভাবে দেখানো হলেও সুকি (মারিয়া ঝ্যাং) ও সাকার মধ্যকার রোম্যান্স এ সেই স্বতঃস্ফূর্ততা নেই। তবে এই পর্বের মূল সৌন্দর্য ছিল অ্যাভাটার কিয়োশির তার নিজ উত্তরসূরিদের বাঁচাতে 'অ্যাকশন' দৃশ্যে অবতারণা।
পরবর্তী 'ওমাসু' পর্বে অনেকগুলো প্লট দেখানোর চেষ্টা করলেও পর্বটি দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। বরং অনেকগুলো প্লট থাকায় গল্পের ধারাবাহিকতা হারিয়েছে এই পর্বটি।
অন্যদিকে দর্শকদের সবচেয়ে বেশি হতাশ করেছে মনে হয় 'স্পিরিটেড অ্যাওয়ে' পর্ব। এই পর্বটি আসল অ্যানিমে সিরিজের ধারে কাছেও যেতে পারেনি। দর্শকদের হতাশার মূল কারণ এখানে স্পিরিটদের উপস্থাপনা। স্পিরিটরা কীভাবে ও কেন মানুষের উপর এতটা রুষ্ট হয়েছে তার পুরো ব্যাপারটারই খুবই আবছা আবছাভাবে তুলে ধরা হয়েছে এখানে।
আবার এই পর্বের মূল আকর্ষণ 'কোহ দ্য ফেস স্টিলার' হওয়ার কথা থাকলেও 'ফেস স্টিলারের আসল শ্বাসরুদ্ধকর ভয়ের সিক্যুয়েন্সটি ফুটিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে লাইভ অ্যাকশন।
এদিকে 'ইনটু দ্য ডার্ক' পর্বে 'বুমির' উপস্থাপনা অনেককে হতাশ করলেও এই পর্বটি তার স্বকীয়তার জায়গা থেকে আলাদা একটা স্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করে অনেকেই। এদিকে 'মাস্ক' পর্বে স্পিরিট জগতে অ্যাং এর সাথে দেখা হয় গিয়াৎসুর।
গিয়াৎসু 'স্পিরিট' জগতে রয়ে গিয়েছিল শুধু অ্যাং এর সাথে দেখা করার জন্য; যাতে তিনি অ্যাং কে পথ প্রদর্শন করতে পারে শেষবারের মতো। তবে এর মূল আকর্ষণ ছিল জুকোর অ্যাং ফায়ার ন্যাশনের জেল থেকে পালানোর দৃশ্য।
সাধারণত লাইভ অ্যাকশনগুলোতে অ্যানিমের মত এসব অ্যাকশন দৃশ্যগুলো তেমন চমকপ্রদ না করতে পারলেও এই পর্বে জুকো ও অ্যাং এর পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি অসাধারণভাবে দৃশ্যায়িত হয়েছে। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তাদের মধ্যকার অজানা নানা অনুভূতি। দর্শকদের মতে এই পর্বটি এই সিরিজের অন্যতম আকর্ষণ।
পরবর্তী 'নর্থ' পর্বটি অ্যানিমে সিরিজের প্রতি অনেক বেশি বিশ্বস্ততা ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। 'নর্দান ওয়াটার ট্রাইব' ভিজিয়্যুলি সুন্দর হলেও এই পর্বের মূল আকর্ষণ ছিল 'মুন স্পিরিট' এবং কাটারার (কিয়াওয়েনটিও টারবেল) 'ওয়াটার বেন্ডিং' এ অভিজ্ঞ হয়ে ওঠা।
অ্যানিমে সিরিজের মতো এত বড় পরিসরে না হলেও মাস্টার পাকু (এ মার্টিনেজ) ও কাটারা মুখোমুখি হয় ওয়াটার বেন্ডিং ডুয়েলে। তাদের মধ্যকার এই ডুয়েলটি আসল অ্যানিমে সিরিজের সাথে সর্বোচ্চ বিস্বস্ত থাকার চেষ্টা করে। এই পর্বেই আজুলাকে (এলিজাবেথ ইউ) প্রথম বারের মতো লাইটেনিং বা বজ্রপাত বেন্ড' করতে দেখা যায়।
এদিকে পরবর্তী ও এই সিজনের শেষ পর্ব 'লিজেন্ডস' এ কমান্ডার/অ্যাডমিরাল ঝাও (কেন লেউং/লেং) মুন স্পিরিটকে মেরে ফেলতে আক্রমণ করে নর্দান ওয়াটার ট্রাইবের উপর। এই আক্রমণের পর 'ওশেন স্পিরিট' 'লা' এবং অ্যাং এর অ্যাভাটার অবস্থা একত্র হয়ে 'কইজিলাতে' রূপ নেয়। বলা যায় যে, এই পুরো দৃশ্যের সিজিআই এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করে। পর্বটি শেষ হয়েছে আজুলার 'ওমাশু' জয়ের মধ্য দিয়ে।
মূল অ্যানিমে সিরিজের নির্মাতা মাইকেল দান্তে ডিমার্টিনো ও ব্রায়ান কোনিয়েজকো প্রতিটি চরিত্র ও পর্ব নির্দিষ্ট এক জগতকে মাথায় রেখে তৈরি করেছিল। প্রতিটি চরিত্র কীভাবে অগ্রসর হবে, চরিত্রের সাথে পর্বের সংশ্লিষ্টতার কথা মাথায় রেখেই এগিয়েছিল অ্যানিমে সিরিজটি। অ্যাভাটার ও তার এক জগৎ তৈরি করেছিল তারা। লাস্ট এয়ার বেন্ডার সিরিজটিকে ধরা হয় অ্যানিমে জগতের অন্যতম এক মাস্টারপিস হিসেবে।
নেটফ্লিক্সের লাইভ অ্যাকশন কি আসল অ্যানিমে সিরিজের সাথে সদ্বিচার করতে পেরেছে? তাদের এই সিরিজটির রিমেক করার প্রচেষ্টা অনেকের মতেই দুঃসাহসিক। অনেককেই করেছে হতাশ। অনেক কিছুই বাদ গিয়েছে এখানে। পরিবর্তন করা হয়েছে লাইভ অ্যাকশনের প্রয়োজনে। তবে গল্প যেহেতু আং, দ্য অ্যাভাটারের 'লিজেন্ড বা উপকথা' নিয়ে গল্পকার তার নিজস্বতা মিশিয়ে এই কিংবদন্তী গল্প বলার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রাখে এই বিষয়টিও মাথায় রাখা উচিত।
তবে অ্যাভাটার 'দ্য লাস্ট এয়ার বেন্ডার' অ্যানিমে সিরিজটি আইএমডিবি রেটিং অনুযায়ী পেয়েছে ৯.৩; যেখানে লাইভ অ্যাকশন সিরিজটি পেয়েছে মাত্র ৭.৩। যদিও অনেক মূল চরিত্র এবং প্রথম এই সিজনের অনেক গল্পরেই খোলাসা হবে এর পরবর্তী সিজনে। তাই সিরিজটির দ্বিতীয় সিজন দেখতেই অপেক্ষা এখন সবার।
এই বছরের শেষের দিকে অথবা ২০২৫ সালের শুরুর দিকে আসতে যাচ্ছে 'অ্যাভাটার দ্য লাস্ট এয়ারবেন্ডার' এর দ্বিতীয় সিজন।