শাহরুখ খান: বলিউডের রোমান্স কিং যেভাবে অ্যাকশন তারকা হয়ে উঠলেন
তিন দশকের বেশি সময়ের সিনেমা ক্যারিয়ারে বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ খান খ্যাতি কুড়িয়েছেন রোমান্টিক নায়ক হিসেবে। মন্ত্রমুগ্ধকর চাহনি, গালে টোল পড়া মোহনীয় হাসি আর দুই হাত মেলে ধরা তার ট্রেডমার্ক শটে দখল করে নেন রোমান্স কিং-এর আসন। কিন্তু ২০২৩ সালে 'দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে' তারকা ধরা দিয়েছেন অন্য রূপে, ধুন্ধুমার অ্যাকশন তারকা হয়ে ।
মুক্তি পাওয়া সর্বশেষ চলচ্চিত্র 'জাওয়ান' এর একটি দৃশ্যে টাক মাথার শাহরুখকে দেখা যায় মেট্রো ট্রেনে যাত্রীদের জিম্মি করে রাখতে। এসময় গান ও নাচের মাধ্যমে আতঙ্কিত যাত্রীদের বিভ্রান্তিতে ফেলেন কিং খান।
ছবিটির ট্রেলারে শাহরুখকে বলতে শোনা যায়, 'আমি যখন ভিলেন হয়ে যাই, তখন নায়কদের কোনো সুযোগ থাকে না'।
টানা কয়েকটি ছবি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ার পর চলচ্চিত্র থেকে দীর্ঘ বিরতি নেন শাহরুখ। আর প্রায় পাঁচ বছর পর পর্দায় ফিরেই লিখেছেন প্রত্যাবর্তণের গল্প। তারজন্য বেরিয়ে এসেছেন নিজের সহজাত চরিত্র থেকে। রোমান্টিক নায়কের জায়গায় তাকে দেখা গেছে ধুন্ধুমার অ্যাকশনে।
এর আগেও ডন (২০০৬) ও রইস (২০১৭) এর মতো চলচ্চিত্রে তাকে অ্যাকশন করতে দেখা গেছে। তবে সেগুলো সাম্প্রতিক পাঠান কিংবা জাওয়ানের মতো অ্যাকশনে ভরপুর নয়।
চলচ্চিত্র সমালোচক অনুপম চোপড়া বিবিসিকে বলেন, এটি তার (শাহরুখের) ক্যারিয়ারের নতুন ধাপ।
শাহরুখের ২০২৩ সাল শুরু হয় স্পাই থ্রিলার পাঠান মুক্তির মধ্য দিয়ে। যেখানে তাকে দেশ রক্ষায় ভয়ঙ্কর এক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে দেখা যায়। ছবিটি চার সপ্তাহের মধ্যে ভারতীয় বক্সঅফিস রেকর্ড (১২০ মিলিয়ন ডলার) ভেঙে দেয়।
আর সর্বশেষ জাওয়ান ছবিতে তাকে দেখা যায় দ্বৈত চরিত্রে। আবার গল্পের খাতিরেই তাকে হাজির করা হয়েছে আরো ছোট ছোট কিছু ভূমিকায়। জাওয়ান ছবি মাত্র ১৮ দিনেই পাঠানকে ছাড়িয়ে যায়।
অনুপম চোপড়া বলেন, ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে আমরা শাহরুখকে যেভাবে দেখেছি তার বর্তমান রূপ তারচেয়ে অনেক ভিন্ন।
চলচ্চিত্রে শাহরুখের প্রাথমিক সাফল্য আসে ডার (১৯৯৩) ছবিতে অ্যান্টি হিরো, বাজিগর (১৯৯৩) প্রতিহিংসাপরায়ণ প্রেমিক ও আনজাম (১৯৯৪) ছবিতে ভয়ঙ্কর এক প্রতিপক্ষ হিসেবে।
কিন্তু ১৯৯৫ সালের ব্লকবাস্টার দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে তাকে একজন রোমান্টিক নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
তারপর থেকে, তিনি বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন তবে মানুষের মনে রয়ে গেছেন রোমান্স কিং হিসেবে।
জাওয়ান ও পাঠান ছবিতেও তার প্রথাগত ক্যারিশমা উপস্থিত ছিল। তবে সে সাথে যোগ হয়েছে পেশীযুক্ত সুপারস্টার তকমা।
দুই ছবির প্লট ভিন্ন হলেও মূল মেসেজ একই ছিল- একজন দেশপ্রেমী নায়ক, যার সহযোগী হিসেবে আছে ভিন্ন ধর্মী ও ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের মানুষ, যারা দেশ বাঁচাতে একসাথে কাজ করে।
চলচ্চিত্রগুলো ছিল বলিউডের সাম্প্রতিক 'কেরালা স্টোরি', 'কাশ্মির ফাইল' কিংবা 'গাদার ২' থেকে ভিন্ন। শেষের তিনটি ছবি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সদস্যদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। ছবিগুলো ছিল হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস ও জাতীয়তাবাদ নিয়ে। অনেক সমালোচকের কাছে অজনপ্রিয় হলেও ছবিগুলো হিট হয়।
এদিকে জাওয়ান ছবিতে শাহরুখ অভিনয় করেছেন এক আর্মিপুত্রের চরিত্রে। আর্মি চরিত্রেও আবার শাহরুখই অভিনয় করেন। এতে দেখা যায় শাহরুখ তার বাবার বিরুদ্ধে আনা অসত্য অভিযোগের বিরুদ্ধে লড়ছেন। দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে জবাবদিহি করতে তাকে নানা ভূমিকায় দেখা যায়।
এই ধরনের বার্তা এর আগেও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, তার পুরনো ছবিতেও রাজনৈতিক বার্তা ছিল।
অনুপম চোপড়া বলেন, 'স্বদেশ' এর মতো ছবিতে-যেখানে তাকে ভারতে আসা নাসা প্রকৌশলীর চরিত্রে দেখা গেছে- রাজনৈতিক বার্তা ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে ভারতে যে অবস্থা বিরাজ করছে সে হিসেবে জাওয়ান ছবি গভীর রাজনৈতিক বার্তা দিয়েছে।
অধিকারকর্মীরা বলছেন, নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক অপরাধ বেড়েছে। বিজেপি এসব অভিযোগ অস্বীকার করে কিন্তু ঘটনাগুলোর নিন্দাও খুব একটা করে না।
চলচ্চিত্র সমালোচক রাহুল দেসাই বলেন, পাঠান ও জাওয়ান তার ক্যারিয়ার ও তারকাখ্যাতিকে পুনর্জীবন দিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ছবিগুলো কেবল শাহরুখের ক্যারিয়ারকে নতুন রূপ দেয়নি বরং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজেপি শাসনের মধ্যে মুসলিম সুপারস্টারের খ্যাতি ও তাকে অনুসরণীয় করেছে।
দেসাই বলেন, অনেক দর্শক হয়তো বুঝতেই পারে না যে ছবি দেখার সময় তারা ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চাকে ধারণ করছে।
ছবির এক পর্যায়ে শাহরুখকে দেশে ভোট এবং রাজনৈতিক জবাবদিহিতা নিয়ে দীর্ঘ বক্তব্য রাখতে দেখা যায়। বিজেপি ও কংগ্রেসসহ একাধিক রাজনৈতিক দলই দাবি করে তাদের প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্য কথাগুলো বলা হয়েছে।
অনুপম চোপড়া বলেন, এটা ভালো লক্ষণ যে আপনার কাজ সবদিকে প্রভাব ফেলছে।
দেসাই বলেন, অভিনেতা হিসেবে শাহরুখের এখনো অনেক কিছুই দেওয়ার আছে। বিভিন্ন চরিত্রে তাকে দেখার অপেক্ষায় আছি।