ভারতের সবচেয়ে ‘ঘৃণিত’ অভিনেতা, তার নামে সন্তানের নাম রাখা হতো না, নায়কের চরিত্র ফিরিয়ে দিতেন
প্রাণ নামটি এখনকার সিনেমাপ্রেমীদের মনে কোনো হেলদোল না-ও হতে পারে। তবে একটা সময় ছিল যখন রুপালি পর্দায় প্রাণকে দেখামাত্রই নায়কের 'প্রাণের' আশঙ্কায় দর্শকহৃদয়ে ধুকপুকানি শুরু হয়ে যেত। তর্কযোগ্যভাবে তিনিই ছিলেন হিন্দি সিনেমার সবচেয়ে 'ভয়ানক' ভিলেন এবং সবচেয়ে 'ঘৃণিত' অভিনেতা।
তবে প্রাণের সিকান্দ-এর যাত্রার শুরুটা কিন্তু খলনায়ক হিসেবে হয়নি। ১৯ বছর বয়সি পাকিস্তানের লাহোরে একজন ফটোগ্রাফারের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। অভিনয়ে আসার কোনো পরিকল্পনা ছিল না।
১৯৩৯ সালের এক রাতে একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে 'পান' চিবোচ্ছিলেন প্রাণ। ওই সময় চিবোনোর ভঙ্গি এবং চেহারায় একটা 'ভয়ানক ভাবের' কারণে তিনি লেখক ওয়ালি মুহাম্মদ ওয়ালির চোখে পড়ে যান। এই লেখক তখন চলচ্চিত্র নির্মাতা দলসুখ এম পাঞ্চোলির সঙ্গে পাঞ্জাবি সিনেমা 'ইয়ামলা যাট'-এ কাজ করছিলেন।
প্রাণকে প্রথমে ছবিতে ৫০ রুপি পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। কিন্তু ফটোগ্রাফার হিসেবে মাসে ২০০ রুপির বেশি উপার্জন করতেন। তাই সিনেমায় নামবেন কি না, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন।
তবে শেষতক প্রাণ ঝুঁকি নিলেন—এবং হিন্দি সিনেমা পেয়ে ইতিহাসের সেরা খলনায়ক। ২০১৩ সালে প্রাণের মৃত্যুর পর অমিতাভ বচ্চন লিখেছিলেন: 'আমরা এখন আর তাদের মতো অভিনেতা তৈরি করি না…'
প্রাণের প্রথম ছবি 'ইয়ামলা যাট' দারুণ ব্যবসাসফল হয়। পর্দায় খলনায়ক হিসেবে নজর কাড়েন প্রাণ। এরপর একের পর এক সিনেমা আসতে থাকতে তার হাতে।
১৯৪২ সালে 'খানদান' দিয়ে হিন্দি সিনেমায় অভিষেক হয় তার, তা-ও রোমান্টিক নায়ক হিসেবে। ছবিটি সিলভার জুবিলি হিট হলেও প্রাণ আর নায়কের চরিত্রে অভিনয় করতে আগ্রহী হলেন না। কারণ নায়ক হয়ে 'গাছের চারপাশে দৌড়ে দৌড়ে' নাচানাচি করার ইচ্ছা ছিল না তার।
এই অভিনেতা তার জীবনীতে লিখেছেন, 'নিজেকে গানের সঙ্গে নাচতে দেখতে আমার ভালো লাগত না। তাই এমন সিনেমা করার সিদ্ধান্ত নিলাম, যেখানে গান থাকবে না অথবা যেখানে আমার জন্য কম গান থাকবে। এছাড়া নায়িকার পিছু পিছু গাছ ঘিরে দৌড়াতে আমার ভীষণ অস্বস্তি লাগত।'
এ সিদ্ধান্তের কারণেই তিনি খলনায়ক চরিত্রে অভিনয় করতে আরম্ভ করেন। এক সাক্ষাৎকারে প্রাণ খলচরিত্রে অভিনয়ের আরেকটি কারণ বলেছিলেন—'অল্প কিছু চরিত্র বাদ দিলে সব নায়কেরা একইরকম। আর খলনায়কই নায়কের চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলে। আপনি যদি মন্দকে না জানো, তাহলে ভালোকে জানবেন কী করে?'
'খানদান'-এর পর প্রাণ আরও ছয়টি সিনেমা করেন, সবগুলোই হিট। এরপর তিনি দিল্লিতে তার বাবা লালা কেভাল কৃষেণ সিকান্দের সঙ্গে দেখা করতে যান। সেখানেই তার জন্ম। পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার কৃষেণ ছেলের সিনেমায় অভিনয়ে নামা নিয়ে খুশি ছিলেন না। প্রাণকে তিনি এক বন্ধুর কারখানায় চাকরি জোগাড় করে দেন।
ছেলেকে 'পথে রাখতে' শুক্লা আহলুয়ালিয়ার সঙ্গে প্রাণের বিয়েও ঠিক করেন কৃষেণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সাত সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে 'প্রিয়' সন্তানটির বিয়ে দেখে যেতে পারেননি কৃষেণ। তার আগেই ১৯৪৪ সালে হৃদরোগে মারা যান। এই ধাক্কায় শোকাহত প্রাণ বাবার দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ১৯৪৫ সালে শুক্লাকে বিয়ে করেন।
বাবার মৃত্যুর পরে আবার অভিনয়ে ফেরেন প্রাণ। স্ত্রীকে নিয়ে চলে যান লাহোরে। ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত লাহোরে প্রাণের সিনেমা ক্যারিয়ার ফুলে-ফেঁপে ওঠে। তবে দেশভাগের আগে দাঙ্গার কারণে তিনি ১৯৪৭ সালে বোম্বে (বর্তমানের মুম্বাই) ফিরে আসেন।
তবে বোম্বেতে এসে কাজ পাচ্ছিলেন না প্রাণ। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, 'এখানে অনেক ধাক্কা খেতে হয়েছে। ছয় মাসেরও বেশি সময় হাতে কোনো কাজ ছিল না।'
স্ত্রী-ছেলেকে নিয়ে তাজ হোটেলে উঠেছিলেন প্রাণ। ধীরে ধীরে হাতে টাকা ফুরিয়ে আসতে থাকে। ফলে প্রথমে একটি সস্তা হোটেলে, পরে একটি গেস্ট হাউসে গিয়ে ওঠেন তারা। একসময় হোটেল বিল পরিশোধের জন্য স্ত্রীর সোনার বালা বিক্রি করতে হয়েছিল এই অভিনেতাকে।
বিখ্যাত লেখক সাদাত হাসান মান্টো কাজ করতেন বোম্বে টকিজের সঙ্গে। প্রাণের জন্য তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক সাঈদ লতিফের কাছে সুপারিশ করেন। সাঈদ প্রাণকে 'জিদ্দি' (১৯৪৯) সিনেমায় সুযোগ দেন।
'জিদ্দি'র সাফল্য প্রাণকে খলনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাইয়ে দেয়। এ সিনেমার পর তার অভিনয় চলচ্চিত্রপ্রেমী ও নির্মাতাদের নজরে পড়ে। প্রযোজকরা তার সঙ্গে কাজ করার জন্য লাইন ধরেন। খলনায়ক হিসেবে প্রাণ এতটাই সাফল্য পান যে প্রযোজকরা তাকে নায়কের চেয়েও বেশি পারিশ্রমিক দিতে একপায়ে খাড়া ছিলেন।
'অপরাধী' সিনেমায় প্রাণ নায়কের চেয়ে ১০০ রুপি বেশি পারিশ্রমিক নেন। বছরে প্রাণের পাঁচ-ছয়টি সিনেমা মুক্তি পেত' এ সংখ্যা বছরে বছরে বাড়তে থাকে।
১৯৬৯ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত প্রাণ ছিলেন বলিউডের সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া তারকা। তিনি এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে সিনেমার পোস্টারে তার নাম নায়কদের নামের চেয়েও বড় করে লেখা হতো।
প্রাণ জানতেন চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে অভিনেতার ভাগ্য সপ্তাহে একবার করে বদলে যায়। তাই তিনি প্রতিটি সিনেমায় নতুন লুক, পোশাক ও মেকআপে হাজির হতেন। তার মেকআপের জন্য মেকআপম্যানের বাড়তি পরিশ্রম যেত।
এছাড়া প্রাণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চারপাশের মানুষজনকে পর্যবেক্ষণ করতেন, তাদের থেকে সিনেমার লুকের জন্য অনুপ্রেরণা নিতেন। যেমন, 'নিগাহেন' (১৯৮৯) সিনেমায় তখনকার প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সহকারী স্যাম পিত্রোদা-র মতো করে দাড়ি রেখেছিলেন।
খলনায়ক হিসেবে নিজের জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে প্রাণ বলেছিলেন, '"হালাকু"তে কাজ করার সময় একজন খলনায়ক নাম ভূমিকায় অভিনয় করছে, এটা নিয়ে মীনা কুমারী বিশেষ খুশি ছিলেন না। তবে আমাকে তার (হালাকু) মতো সাজসজ্জায় দেখার পর তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। …বি. সুবাষের সিনেমায় আমি আব্রাহাম লিংকনের গেটআপ নিয়েছিলাম।'
লুক ছাড়াও এই অভিনেতা তার চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতেও পেছনেও প্রচুর পরিশ্রম করতেন।
রক্তাভ চোখ, হিমশীতল কণ্ঠ ও ট্রেডমার্ক হাসি দিয়ে খলনায়ক হিসেবে নিজের একটি ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। খলচরিত্রে অভিনয় করেই 'দেবদাস' (১৯৫৫), 'আজাদ' (১৯৫৫), 'হালাকু' (১৯৫৬) ও 'মধুমতি'র (১৯৫৮) এর মতো সিনেমাগুলোকে স্মরণীয় করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
ভিলেন হিসেবে প্রাণের 'সুনাম' এমনই তুঙ্গে ওঠে যে বাবা-মায়েরা তার নামে সন্তানের নাম রাখার সাহসও পেতেন না।
পরিচালক তিন্নু আনন্দ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'তার নাম ছিল ভিলেনের সমার্থক। "প্রাণ" নামটি কেবল একজন মানুষের জন্য আলাদা করা ছিল—সেই মানুষটি প্রাণ সাহেব।'
খল চরিত্রে প্রাণের বহুমুখী অভিনয়ে তার নারী সহকর্মীরাও ভয় পেয়ে যেতেন। হেমা মালিনী একবার বলেছিলেন, 'প্রাণজি যেভাবে পারফর্ম করতেন, তাতে আমি তাকে ভয় পেতাম। তিনি এটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে এক ভুরু উঁচিয়ে আপনার দিকে তাকাবেন।'
তবে অভিনেত্রী অরুণা ইরানি বলেছিলেন, একসঙ্গে কাজ করার পর বুঝতে পেরেছিলেন যে প্রাণ 'পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ।' এক সাক্ষাৎকারে অরুণা বলেন, একবার শুটিং শেষ হওয়ার পর তিনি প্রাণের সঙ্গে হংকং থেকে মুম্বাই ফিরছিলেন।
'আমাদের হংকংয়ের ফ্লাইট দেরি করে। তাই কলকাতার কানেক্টিং ফ্লাইট মিস করে ফেলি। তখন আমরা রাত কাটানোর জন্য একটা হোটেলে উঠি। হোটেলে থাকার চিন্তায় মাথায় আসতেই আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছিলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম প্রাণজি আমাকে ধর্ষণ করবেন। হোটেলে পৌঁছানোর পর তিনি আমাকে আমার ঘরে নামিয়ে দিয়ে বললেন, ভেতর থেকে দরজায় তালা মেরে দাও। আমি পাশের কামরায় আছি। দরজায় কেউ নক করলে খুলবে না... আমাকে ফোন করে জানাবে।" তিনি এত ভদ্র মানুষ, দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।'
পরিচালক লেক ট্যান্ডন ও কিংবদন্তি অভিনেতা-পরিচালক মনোজ কুমারও প্রাণকে 'সেরা মানুষের কাতারে' রেখেছেন।
মনোজ কুমারের 'আপকার'-এ (১৯৬৭) যুদ্ধফেরত সৈনিকের চরিত্রে অভিনয়ের পর প্রাণের ক্যারিয়ার গ্রাফ দ্রুত উর্ধ্বমুখী হয়।
'আপকার'-এর দারুণ সাফল্যের পর ফের প্রাণের চাহিদা বেড়ে যায়, এবার অবশ্য চরিত্রাভিনেতা হিসেবে। তিনি 'জঞ্জির'-এ শের খান, 'ভিক্টোরিয়া নং ২০৩'-তে (১৯৭২) রানা এবং 'ডন'- (১৯৭৮) জাসজিতের মতো স্মরণীয় চরিত্রে কাজ করেন।
চিত্রনাট্যকার সেলিম খান একবার বলেছিলেন, ডিস্ট্রিবিউটররা 'জঞ্জির' কিনেছিলেন স্রেফ প্রাণের ওপর ভরসা করে। কারণ অমিতাভ বচ্চন তখনও নতুন অভিনেতা ছিলেন।
সেলিম খান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'সিনেমার কাস্টে প্রাণকে রাখতে পারাটাকে—সেটি ভিলেন হিসেবে হলেও—প্রযোজক ও পরিচালকরা দারুণ লাভজনক মনে করতেন।'
দর্শকরা প্রাণকে ঘৃণা করতে ভালোবাসলেও নির্মাতারা তাকে ভালোবাসতেন। প্রতিভা এবং কাজের প্রতি নিবেদন ও আন্তরিকতার কারণে নির্মাতাদের ভালোবাসা কুড়িয়েছেন তিনি।
প্রাণের নিবেদন নিয়ে মনোজ কুমার একটি ঘটনার কথা বলেছিলেন। একদিন 'আপকার'-এর শুটিংয়ে তিনি দেখলেন, প্রাণ ক্লান্ত চেহারায় চুপচাপ চেয়ারে বসে আছেন। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, আগেরদিন রাতে প্রাণের বোন মারা গেছেন। তিনি কলকাতায় মারা গেছেন। কিন্তু দুই প্রযোজক ব্যাপক লোকসানে পড়বেন বলে প্রাণ বোনের শেষকৃত্যে যাননি।
শত্রুঘ্ন সিনহা একবার বলেছিলেন, '"বিশ্বনাথ"-এর শুটিংয়ের সময় সুভাষ ঘাই দুজন মানুষকে নিয়ে বিরাট সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলেন—একজন শত্রুঘ্ন সিনহা, অপরজন ছিল প্রাণ। তিনি (সুভাষ ঘাই) বলতেন, শত্রুঘ্ন সিনহাকে সময়মতো আসতে বলে, ১০টার শিফটে ১০টায় আসতে বলে বলে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আর প্রাণকে বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছি উনি যেন সকাল সাড়ে ৯টায় না আসেন, কারণ তাকে ২টার আগে প্রয়োজন নেই।'
জনপ্রিয় অভিনেতা হওয়ার পরও প্রাণ ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে পিছপা হননি। ১৯৭৩ সালে তিনি সোহানলাল কানওয়ারের 'বেইমান'-এ অভিনয় করে সেরা সহকারী অভিনেতার জন্য ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু অভিনেতা এই পুরস্কার নিতে রাজি হননি। কারণ তার মনে হয়েছিল, বিচারকরা 'বেইমান'-এর জন্য শঙ্কর-জয়কিশানকে সেরা সঙ্গীত পরিচালকের যে পুরস্কার দিয়েছে, সেটি প্রাপ্য ছিলেন গুলাম মোহাম্মদ—'পাকেজা'র জন্য।
১৯৪০ থেকে ১৯৯০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত প্রাণ টানা কাজ করে গেছেন। তবে ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ দশকে এসে সমান দক্ষতায় কাজ করে যাওয়া তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এ সময় থেকে তিনি অভিনয় কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রাণের অভিনীত শেষ সিনেমাগুলো একটি ছিল অমিতাভ বচ্চন কর্পোরেশন লিমিটেডের 'তেরে মেরে স্বপ্নে' (১৯৯৬)।
৩৫০টিরও বেশি সিনেমায় অভিনয় করা এই অভিনেতা ২০১৩ সালে ৯৩ বছর বয়সে মারা যান। মনে-প্রাণে নিবেদিত এই অভিনেতা বলেছিলেন, 'পরের জন্মেও আমি অভিনেতা হতে চাই। এক জীবনে এই শিল্পের সেবা করা সম্ভব না।'