শুটিংয়ের গ্রাম পুবাইলের ভাদুন
নাটক বা সিনেমায় গ্রামের গল্পে স্বাভাবিকভাবে প্রয়োজন হয় গ্রাম। তখন গ্রামে করতে হয় শুটিং। ঢাকার ভেতরে সেই সুযোগ নেই। তবে পুরোদস্তুর গ্রামের শুটিংয়ের জন্য ঢাকার পাশেই রয়েছে দারুণ এক গ্রাম। গাজীপুরের পুবাইল। প্রায় দুই দশক আগে এখানে চলেছিল শুটিংয়ের জন্য প্রথম ক্যামেরা। তারপর আর থামেনি। ধীরে ধীরে এই গ্রাম পরিচিতি পেয়েছে শুটিংয়ের গ্রাম হিসেবে। এই গ্রামের আনাচে কানাচে এমনকি বেশিরভাগ বাড়িতেই চলেছে শুটিংয়ের ক্যামেরা। চেনা পরিচিত জনপ্রিয় সব অভিনয়শিল্পীর পাশাপাশি এই গ্রামের সাধারণ মানুষ, এমনকি গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগিও হয়ে উঠেছে একেকটি চরিত্র। করেছে অভিনয়।
কিভাবে শুরু
সঠিক সময়টা কেউই বলতে পারলেন না। তবে প্রায় দুই দশক আগে এই গ্রামে প্রথম শুটিং করেছিলেন প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা আমজাদ হোসেন। তিনিই প্রথম 'আগুন লাগা সন্ধ্যা' নামে একটা নাটকের শুটিং করেছিলেন এই গ্রামে। তারপর থেকে ধীরে ধীরে এই গ্রামটি চিনেছেন নাটক ও চলচ্চিত্রের মানুষ। এরপর সালাহউদ্দিন লাভলুর পরিচালনায় এই গ্রামে চিত্রায়িত হয়েছে 'সাকিন সারিসুরি', 'রঙের মানুষ', 'সোনার কাঠি রূপার কাঠি'র মতো জনপ্রিয় সব ধারাবাহিক নাটক। এখন গ্রামের নাটক মানেই পুবাইলের ভাদুন গ্রামে শুটিং।
তবে একেবারে শুরুতে কোনো শুটিং বাড়ি ছিল না। আমজাদ হোসেন এক পরিচিতের বাড়ি ম্যানেজ করে শুটিং করে আসার পর পরিচালকদের চাহিদা বাড়ে। এই চাহিদা থেকেই ধীরে ধীরে শুটিং হাউজ গড়ে ওঠে। ২০০৬ সালের আগ অবধি ছিলো মাত্র একটি শুটিং বাড়ি। এখন সেই অবস্থা নেই। এখন সেখানে ১০টি শুটিং বাড়ি। বাড়ি বলতে ইটপাথরের বাড়ি নয়, একেবারে গ্রামের বাড়ি। কোনো বাড়ি মাটির, কোনোটা টিনের আবার কোনোটা কাঠ এবং সেমিপাকা বাড়ি। যে বাড়ির পাশেই আছে পুকুর, বাধাই করা ঘাট। মুরগির ঘর, গরুর গোয়াল, গাছগাছালি, মাচাসহ সবই। পাশাপাশি আছে কিছু রিসোর্ট। এসব শুটিংবাড়ির মালিক আবার অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত মানুষজনই। তারা নিজ উদ্যোগে বা লিজ নিয়ে শুটিংবাড়ির ব্যবসা করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান টেলিহোমের মালিক মোহাম্মদ আলী বশিরের আছে একটি শুটিং বাড়ি। অভিনেতা শামীম জামান লিজ নিয়ে একটি বাড়ি ভাড়া দেন শুটিংয়ের জন্য। নিজেও নিয়মিত শুটিং করেন এই বাড়িতে। এছাড়া স্থানীয় ব্যক্তিদেরও কিছু বাড়ি আছে ভাড়া দেয়ার জন্য।
জনপ্রিয় অভিনেতা আজিজুল হাকিম এই গ্রাম নিয়ে বলেন, 'প্রায় ২০ বছর আগে থেকে এই গ্রামে শুটিং করি আমি। তখন এখানকার মানুষের শুটিং দেখার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু দিনদিন তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। এখন তারা আমাদেরই একটা অংশ হয়ে গেছেন।'
সরেজমিনে গ্রাম
গত সোমবার পুবাইল গ্রামে গিয়ে দেখা যায় বেশ কিছু শুটিংবাড়িতে চলছে শুটিং। এরমধ্যে শামীম জামানের বাড়িতে শুটিং করছিলেন পরিচালক রাজীব মনি দাস। সাত পর্বের ঈদের নাটক 'বিয়াইন সাব' নাটকে অভিনয় করছেন ফারজানা ছবি, তানিন তানহা, রাশেদ মামুন অপু, তারেক স্বপন, আ খ ম হাসানসহ অনেকেই। এই গ্রামের শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে অভিনেত্রী ফারজানা ছবি বলেন, 'এই এলাকার মানুষ শুটিং দেখতে দেখতে এত অভ্যস্ত হয়ে গেছেন যে, এখন আর কেউ এই গ্রামে ভিড় করে না। পাশাপাশি খুব নিরিবিলি গ্রাম। তাই আরাম করে শুটিং করা যায়।'
এই গ্রামের চটের আগা নামের এক জায়গায় শুটিং করছিলেন পরিচালক সকাল আহমেদ। মাছরাঙা টেলিভিশনের জন্য নির্মাণ করছেন ধারাবাহিক নাটক 'সরকার অ্যান্ড সন্স'। এই নাটকের শুটিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন আজিজুল হাকিম, শাহনাজ খুশি ও প্রাণ রায়। গ্রাম নিয়ে মজার অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন প্রাণ রায়।
বলেন, 'আমার গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটে। সেখানে খুব কম যাওয়া হয়। কিন্তু এখানে আসলে নিজের গ্রামকে খুঁজে পাই। অনেক বছর ধরে এখানে আসি শুটিং করার জন্য। তখন থেকেই এই গ্রাম, গ্রামের মানুষ রাস্তাঘাট সব আপন হয়ে গিয়েছে।'
ভাড়ায় মেলে সবকিছু
এখানকার শুটিংবাড়িগুলোর ভাড়া একেকটার একেকরকম। দিন হিসেবে ভাড়া দেয়া হয় প্রতিটি বাড়ি। চার হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যায় একেকটি বাড়ি। তবে ভাড়ার পার্থক্য নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাড়ির ম্যানেজার জানালেন কোনো বাড়িতে তারকাদের বিশ্রামের জন্য এসি রুম আছে। পাশাপাড়ি বাড়ির সৌন্দর্য, প্রপস, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, জেনারেটর সাপোর্টের ওপরে বাড়ি ভাড়া ওঠানামা করে। এতো গেল শুটিংবাড়ির দরদাম। তবে শুটিংয়ের প্রয়োজনে যে কোনো কিছু মেলে এই গ্রামে। মানুষ থেকে শুরু করে গরু, হাঁস-মুরগি, বটি, দা, শাড়ি, গামলা, চুড়ি, ঝাড়ু সবই ভাড়ায় পাওয়া যায়।
কথা বলে জানা যায়, শুরুর দিকে এই গ্রামে সবকিছু ফ্রি পাওয়া যেতো। গ্রামের মানুষ আগ্রহ নিয়েই শুটিংয়ে সহযোগিতা করতো। কিন্তু ধীরে ধীরে চাহিদা বেড়ে যাওয়া এবং দীর্ঘ সময় ব্যবহার করতে হয় বলে সবকিছুর জন্য 'ভাড়া' নির্ধারণ করেছেন গ্রামবাসী। অর্থাৎ টাকা ছাড়া এখন কিছুই পাওয়া যায় না এখানে।
বিষয়টি নিয়ে পরিচালক রাজীব মনি দাস বলেন, 'আপনি সবকিছুই এখানে পাবেন যদি টাকা দেন। এমন হয় একটা গরু লাগবে শুটিংয়ে। এজন্য ১ হাজার টাকা দিতে হয়। আবার মুরগি ২০০ টাকা চেয়ে বসেন। এছাড়া অনেক সময় মানুষও প্রয়োজন হয়, অন্য গ্রামে গেলে হয়ত উৎসাহী কেউ এসে ফ্রিতে শুটিং করে দেবেন। কিন্তু এখানে টাকা দিতে হয়। সাথে খাওয়াদাওয়া তো আছেই।'
সবকিছু মিলিয়ে ঢাকার খুব কাছে হওয়ার কারণে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই গ্রাম। পাশাপাশি শুটিংবান্ধব হওয়ার কারণেই চাহিদা বাড়ছে পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের।