সমাবেশে পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদ করেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী
ভাষা আন্দোলনের সময় ভাষাসৈনিক বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য। ১৯৫২ সালের একুশ ফেব্রুয়ারি। ঢাকায় যেদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা রাজপথে মিছিল বের করে, সেদিন বিনোদ বিহারী ছিলেন ঢাকায়।
সেদিনই আইন পরিষদের অধিবেশন ছিল বিকাল ৩ টায়। সেই অধিবেশনে যোগ দিতে দুপুর আড়াইটা নাগাদ রিকশায় বেরিয়েছিলেন তিনি। মেডিকেল কলেজ পার হয়ে কিছুদূর আসা মাত্র কয়েকটি ছেলে জোর করে রিকশা থেকে নামিয়ে তাদের সঙ্গে তাকে যেতে বাধ্য করে।
তারা ছিল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তারা ঝাঁজের সঙ্গে বিনোদ বিহারীকে বলে, 'আমরা মরছি পুলিশের গুলিতে, আর আপনারা যাচ্ছেন কি না অ্যাসেম্বলিতে? আসুন, দেখুন, কি করছে পুলিশ!'
এরপর তারা বিনোদ বিহারীকে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ভেতর বরকতের মৃতদেহের সামনে নিয়ে যায়। সেই বীর শহীদের দেখে ক্রুদ্ধ, উত্তেজিত ছাত্রদের বুঝিয়ে বিনোদ বিহারী বলেন, "বিরোধী দলের লোক হয়ে আইন পরিষদে যদি না যাই, যদি আইনসভায় এ নৃশংসতার সমালোচনা না করি এবং যদি ছাত্রদের নায্য দাবি তুলে না ধরি, তবে কার লাভ?"
"দেশ বিদেশের লোক জানবে কি করে এসব নৃশংস ঘটনা!"
ছাত্ররা তখন বিনোদ বিহারীর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবনে সক্ষম হয় এবং তাকে ভিন্ন পথে কাঁটা তারের বেড়া ফাঁক করে দিয়ে আইন সভায় যেতে দেয়।
এরপর বিনোদ বিহারীসহ কংগ্রেসের পক্ষ থেকে মনোরঞ্জন ধর, গোবিন্দ ব্যানার্জি, নেলী সেন গুপ্ত, ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত, বসন্ত কুমার দাশ এবং রংপুরের খয়রাত হোসেন, ময়মনসিংহের আনোয়ারা খাতুন ও মুসলীম লীগের আবদুর রশীদ তর্কবাগীশসহ আরো অনেকে 'পয়েন্ট অব অর্ডারের ভিত্তিতে আইনসভার কাজ বন্ধের অনুরোধ জানান। একইসাথে ছাত্র মিছিলে গুলি চালনা, টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ প্রভৃতি ঘটনার বিবরণ তুলে ধরে আইনসভায় হইচই বাধিয়ে দেন।
প্রধানমন্ত্রীকে ঘটনাস্থলে গিয়ে মৃতদেহ দেখারও দাবি জানান তারা।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুসলীম লীগের মন্ত্রীবর্গ এসব ঘটনার কোনো সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হয়। পরে বিচার বিভাগীয় তদন্তের প্রতিশ্রুতি আদায় হয় এবং স্পিকার আবদুল করিম সংসদ মুলতুবি ঘোষণা করেন। এসবের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বিনোদ বিহারী।
বিনোদ বিহারী চৌধুরী ১৯১১ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালি থানায় জন্মগ্রহণ করেন।
ফটিকছড়ির রাঙ্গামাটিয়া বোর্ড স্কুলে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়৷ সেখান থেকে তিনি ফটিকছড়ি করোনেশন আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, বোয়ালখালির পি.সি. সেন সারোয়ারতলি উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম কলেজে পড়াশোনা করেন।
১৯২৯ সালে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য তাকে বৃত্তি প্রদান করা হয়। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন।
১৯৩৪ এবং ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশ রাজের রাজপুতনার ডিউলি ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী অবস্থায় থাকার সময় তিনি প্রথম শ্রেণীতে আই.এ. এবং বি.এ. পাস করেন।
বিনোদ বিহারী চৌধুরী ১৯৩০ সালে কংগ্রেস চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সহ-সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪০-১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস নির্বাহী কমিটির সদস্য থাকার পাশাপাশি ১৯৪৬ সালে কংগ্রেস চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।
১৯৪৭ সালে ৩৭ বছর বয়সে পশ্চিম পাকিস্তান কংগ্রেসের সদস্য হন তিনি। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারির মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দলকে বেআইনি ঘোষণা করলে রাজনীতি থেকে অবসর নেন বিনোদ বিহারী। এর মধ্যে তিনি ১৯৩৯ সালে দৈনিক পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসাবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ১৯৪০ সালে চট্টগ্রাম কোর্টের একজন আইনজীবী হিসাবে অনুশীলন শুরু করেন। কিন্ত অবশেষে তিনি তার দীর্ঘ কর্মজীবনে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন।
বিনোদ বিহারী চৌধুরী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন বিপ্লবী কর্মী যিনি বিপ্লবী সূর্য সেনের সহকর্মী ছিলেন। তিনি ২০১৩ সালের ১০ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।
টিবিএস ও নগদ-এর যৌথ উদ্যোগ