ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছরেও বাংলা কেন সুপ্রতিষ্ঠা পায়নি?
জাতি গঠনের প্রথম শর্তই হচ্ছে তার ভাষা। ভাষা দ্বারা জাতি যত সুস্পষ্টভাবে প্রতিনিধিত্ব করে তা অন্য কিছুতে পারেনা। সংস্কৃতির সংমিশ্রণ অনেকভাবে ঘটতে পারে, কিন্তু ভাষা সেদিক থেকে নিজস্ব স্বকীয়তায় স্বতন্ত্র।
আজকের ইউরোপ নানাভাবে নানা বিষয়ে একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, ভৌগলিক প্রবেশাধিকার, চাকরির ক্ষেত্রে। কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে তারা এক অনন্য অবস্থান নিয়ে রেখেছে। এমনকি 'গ্রেট ব্রিটেন' বলে খ্যাত চারটি রাষ্ট্র একত্রিত হয়ে যে রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে, সেই রাষ্ট্রটির চারটি দেশের ভাষা ও উচ্চারণ আলাদা। সেটাকে মিশ্রণ করা যায়নি। অর্থাৎ স্কটিশরা যে ইংরেজি বলে তা বৃটেনের ইংরেজির সঙ্গে মেলে না। উচ্চারণগতভাবে বেশ কিছু তারতম্য আছে। আবার লিভারপুলের অংশের মানুষের মধ্যেও ব্যাপারটা তাই। এমনিভাবে ইংল্যান্ডের চারটি রাষ্ট্রের যে সমন্বিত 'গ্রেট ব্রিটেন', তা এখনও তাদের সেই ভাষাগত স্বাতন্ত্র ধরে রেখেছে।
ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর অবস্থাও তাই। প্রায় প্রতিটি দেশ মাত্র কয়েক কোটি জনসংখ্যার দেশ, তার নিজস্ব ভাষায় তাদের জীবন পরিচালনা করছে। শিক্ষাদীক্ষা সবকিছুতেই তার নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করছে। আয়তনে আমাদের থেকে ছোট ছোট দেশ। তারা তাদের সমস্ত শিক্ষাব্যবস্থা তাদের নিজস্ব ভাষায় করতে পেরেছে।
আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন বা যারা এই সমাজে নিজেদেরকে অভিভাবক মনে করেন তারা কেউই ভাষার প্রশ্নে একক অবস্থানে আসতে পারে নি। এখনো উচ্চ আদালতের দু-একটি রায় বাংলায় লেখার পর গর্ব করা হয় কিংবা 'বাংলায় রায় লিখতে হবে' বলে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা জারি করতে হয়। তারপরও বাংলা সঠিকভাবে কতটা চালু হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
দেশে তিন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। শহরভিত্তিক যে শিক্ষাব্যবস্থা তা মূলত ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থা। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের যে শিক্ষাব্যবস্থা সেখানে বাংলা একটি মাধ্যম আবার এই গ্রামীণ জনপদের একটি বিশাল অংশ আরবি ভাষায় শিক্ষিত হচ্ছে। এই হচ্ছে আমাদের ভাষা আন্দোলনের ফসল!
আমরা প্রতি বছর ভাষা আন্দোলনকে স্মরণ করি। একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য যারা আত্মহুতি দিয়েছেন তাদের স্মরণ করি। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য জাতিসংঘকে ধন্যবাদ জানিয়ে গর্ব অনুভব করি। শহরের রাজনীতিবিদরা বেশ কিছু বক্তৃতা, বিবৃতি দিয়ে থাকেন। রেডিও-টেলিভিশনে ভাষা নিয়ে ইতিহাসের নামে বেশ কিছু গল্প-অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। তারপরের দিন ২২ তারিখ থেকেই আবার ভাষা আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যায়।
স্বাধীনতার ৫০ বছর এবং ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছরেও একটি ভাষা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, সাধারণ মানুষের কথা বাদ দিলাম; যারা ভাষা নিয়ে কাজ করেন বা ভাষার অধ্যাপক, ভাষা বিজ্ঞানী তাদের কারো জানা নেই বাংলা ভাষায় মোট শব্দ সংখ্যা কয়টি। যদিও বাংলা ভাষায় নানা রকমের শব্দের অস্তিত্ব আমরা খুঁজে পাই। কিন্তু এই দেশের ভাষাবিদরা আজ পর্যন্ত এই ভাষার সঠিক শব্দ সংখ্যা নিরূপণ করতে পারেননি। এ নিয়ে আমাদের কোনো কার্যকর গবেষণা আছে বলে আমার জানা নেই।
ভাষা কোনো আধিপত্য মানে না। নিজের ভাষার উপর অন্য ভাষা চাপিয়ে দেবার ইতিহাস সুখকর নয়। ভাষার জন্য যেমন আমরা রক্ত দিয়েছি তেমনি পৃথিবীর নানাপ্রান্তে ভাষার জন্য জীবন দেওয়ার ইতিহাস কম নয়।
ভাষা নিয়ে সবচেয়ে বড় রক্তপাতের ঘটনা ঘটে ১৯৭৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায়। স্কুল শিশুদের চলা আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালায়। বহু স্কুল ছাত্র প্রাণ দেয়। এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রায় ৪৫০ জনের অধিক মানুষ জীবন দেয়। বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের অনুপ্রেরণার স্মারক হয়ে থাকে স্কুল শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন।
ভারতের স্বাধীনতারও ১০ বছর আগে সেখানকার তামিল ভাষী মানুষ তাদের ভাষার উপর অন্য ভাষার আধিপত্য মেনে নেয়নি। তামিলনাড়ুর মানুষ সেদিন আন্দোলন করে, জীবন দিয়ে সর্বত্র হিন্দি প্রচলনের চেষ্টা রুখে দিয়েছিল। স্বাধীনতা উত্তর কংগ্রেস সরকার আবার চেষ্টা চালায় হিন্দি ভাষা প্রচলনের। মাধ্যমিক শিক্ষায় হিন্দি বাধ্যতামূলক করা হয়। এর পরিণতিতে কংগ্রেসকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল। হিন্দি প্রচলনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। তারপর থেকে কংগ্রেস আর কখনো তামিলনাড়ুতে সরকারে যেতে পারেনি।
তবে তামিল নেতাদের সামাজিক ঐক্যের স্বার্থে ৭০ ভাগ মানুষ তামিল ভাষী হওয়া সত্বেও সেখানে বাকি ৩০ ভাগ মানুষ আরও ৪টি ভাষায় কথা বলতো। সেকারণে তারা সাধারণ ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে বেছে নেয়। তামিল নেতাদের এই সমঝোতার উদ্যোগ আজও একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
ভারতে এখন ২০টির অধিক ভাষাকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যদিও সেখানে শতাধিক ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে। দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি, হিন্দি ও রাজ্যের নিজস্ব ভাষা এই তিনটিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
ভারতের ১৯৩৭ সালের সূচিত সেই আন্দোলন আমাদের বাংলাদেশেও সংক্রমিত হয়েছিল, যখন পাকিস্তানের জন্মের পরেই পাকিস্তানের শাসক চক্র উর্দুকে আবার রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। যদিও পাকিস্তানের সবকটি প্রদেশে নানান ভাষা চালু ছিল। গুজরাটি ভাষার মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে কেন বেছে নিয়েছিলেন তা সুস্পষ্ট নয়। কারণ সেই সময়ের পাকিস্তানি উর্দুভাষী জনসংখ্যা মাত্র ৭ শতাংশ ছিল।
ভাষা দ্বারা বিভক্ত সমাজ ঐক্যবদ্ধ করার জন্য একটি 'সাধারণ ভাষা' বেছে নেওয়া হয়, ভারতের জন্য যেমন ছিল হিন্দি তেমনি পাকিস্তানের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল উর্দু। ভারত পাকিস্তান উভয় অংশের নেতারা ভেবেছিলেন একটি সাধারণ ভাষা দিয়ে সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করবেন। এই তত্ত্বের ভয়ানক পরিণতির কথা জানার পরও পাকিস্তানের নেতৃত্ব কেন একই ভুল করলো সেটা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। তামিলনাড়ুর আন্দোলন ভারতীয় রাজনীতির মোড় পরিবর্তন করে দিয়েছে। একইভাবে পূর্ববঙ্গে গড়ে উঠা মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলন স্বাধীকারের চেতনার বীজ বপন করে।
কেউই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। স্বাধীনতার ৫১ বছর পরেও ভাষার ক্ষেত্রে আমরা কোন সঠিক সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা আগামী প্রজন্মকে দিতে পারিনি। শহরের শিক্ষা ব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে ইংরেজি কেন্দ্রীক হয়ে উঠেছে। শহরের উচ্চবিত্ত প্রায় সকলেই সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।