অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে রোগীর ক্ষতি করছেন না তো?
অক্সিজেন নিয়ে করোনা মৌসুমে একটি অবৈজ্ঞানিক বিষয় আমাকে আগেও ভাবিয়েছে। সেটা হলো, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর বাড়ি বাড়ি অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়া।
'ডেসপারেট টাইম কলস ফর ডেসপারেট মিজারস' বলেই হয়তো এই খটকা এতদিন চোখের আড়াল করে রেখেছিলাম।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শ্বাসকষ্টের রোগীগুলোকে বাড়ি বাড়ি অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়ার কাজটি আসলে আদতে অর্থহীন এবং কেউ দেখাতে পারবেন না, মেডিকেল সায়েন্সের কোনো বইয়ে বাসায় রোগী রেখে অক্সিজেন দেবার কথা বলা হয়েছে। প্যালিয়েটিভ কেয়ারে থাকা কিছু রোগীর সিম্পটম রিলিফের জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন হলেও সেখানে মেডিকেল পার্সোনেলের (প্যারামেডিক, নার্স, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট, ট্রেইন্ড কেয়ার গিভার) গাইডেন্সে অক্সিজেন প্রদান করা হয়।
মেডিকেল অক্সিজেনকে কোনো অবস্থাতেই হোম অ্যাপ্লায়েন্স বানানোর সুযোগ নেই।
কারণ:
১। যে রোগীর আসলেই অক্সিজেন প্রয়োজন হবে, তার চিকিৎসা আপনি বাসায় রেখে করছেন, মানে বোকামি করছেন। আপনি মনে করছেন, এতে মুমূর্ষু রোগীটার চিকিৎসা হচ্ছে, আসলে আপনি হাসপাতালে আসার কালক্ষেপণ করছেন।
২। সিলিন্ডারের ধারণক্ষমতা সীমিত এবং শেষ হয়ে গেলে বার বার বদলানো এবং সংশ্লিষ্ট টেকনিক্যাল নলেজ সবার থাকবে না। ফলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
৩। অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে দুর্ঘটনা ঘটলে বা আগুন ধরে গেলে, সেটা নিয়ন্ত্রণে আনার মতো অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা বাংলাদেশের বাসাবাড়িতে পাওয়া দুষ্কর। সুতরাং বৃহত্তর দুর্ঘটনা ঘটলে সেটা রোগী ও তার পরিবারের অপূরণীয় ক্ষতি করবে।
৪। অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থাপনা (মেইনটেনেন্স অর্থে) সংক্রান্ত কোনো জ্ঞান সাধারণ জনগণের নেই। বিশ্বাস করুন, আমি একজন চিকিৎসক, আমারও ছিল না। নেহায়েতই ল্যাপারোস্কপিক সার্জারির টুলস নাড়াচাড়া করার সুযোগ পাই বলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সিলিন্ডার সেট-আপ করতে পারি। কারণ, সেটা ল্যাপারোস্কপিক ইনসাফ্লেটর ডিভাইসে কানেক্ট করতে হয়। ল্যাপারোস্কপি ভালোবাসি বলে শুধু নিজের আগ্রহেই কাজটা শিখেছি।
৫। ভয়ংকর বিষয়টি হলো, মিনিটে ৫-১০ লিটার বেগে অক্সিজেন দিয়ে রোগীর শ্বাসযন্ত্রের করোনাভাইরাসগুলোকে আপনি আপনার বাসার পরিবেশে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ফলে বাড়ির অন্য সবাইকে আক্রান্ত করবার উর্বর পরিবেশ তৈরি করছেন! আপনার অজান্তে আপনি আপনার বাসাটাকে 'ডেডিকেটেড করোনা ওয়ার্ড' বানিয়ে ফেলছেন।
এবার, আমার অভিজ্ঞতা বলি:
গত রোস্টারে ডিউটি করার সময়ে যে কয়টি ডেথ সার্টিফিকেট আমি নিজের হাতে লিখেছি, এরা প্রত্যেকেই প্রথমে বাসায় রেখে রোগীকে অক্সিজেন দিয়েছেন। পরবর্তীকালে অবস্থার উল্লেখযোগ্য অবনতি হলে যখন আমাদের কাছে এনেছেন, আমাদের করণীয় খুব কমই ছিল।
অক্সিজেনের পাশাপাশি হাসপাতালে রোগীকে আমরা লক্ষণ ও রোগের গভীরতা বিবেচনায় আরও কিছু আই-ভি ঔষধ দেই। এছাড়াও রোগীকে প্রোনিং ও ব্রেথিং এক্সারসাইজের পরামর্শ দেওয়া হয়। এই বিষয়গুলো সেবিকা ও ওয়ার্ড এমপ্লয়িগণ মনিটর করতে পারেন। প্রয়োজনে দেখিয়ে ও শিখিয়ে দেন। সন্দেহাতীতভাবেই বাসায় অক্সিজেন পেলেও রোগী এই সেবাগুলো পান না।
এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি কিছু সাজেশন আপনাকে দিতে পারি।
১। মাইল্ড কেসের রোগীদের অক্সিজেন নেবার কথা কোনো গাইডলাইনেই বলা নাই। সুতরাং রোগীর করোনা রিপোর্ট 'পজিটিভ' এসেছে মানেই যে আপনাকে একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে ফেলতে হবে, এই ধারণাটা ভুল। এটা করবেন না।
২। আপনার রোগীর সত্যি সত্যি শ্বাসকষ্ট হলে বা অক্সিজেন স্যাচুরেশনের অবনতি ঘটলে দ্রুত তাকে হাসপাতালে আনুন। হাসপাতালে আনার পথে অ্যাম্বুলেন্সে থাকা অক্সিজেনের সাহায্য নিন। প্রয়োজনে সেখানে সাধারণ অক্সিজেন মাস্কের পরিবর্তে এনআরবি মাস্ক (NRB Mask) লাগাতে পারেন।
৩। করোনা আক্রান্ত রোগী করোনা নেগেটিভ হবার পরেও বেশ কিছুদিন বুকে ব্যথা বা শ্বাসকষ্টের মতো অবস্থা থাকতে পারে। এক্ষেত্রে আপনাকে নিয়মিত চিকিৎসকের ফলোআপে থাকতে হবে। অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে এমন রোগীকে চিকিৎসকরা কখনোই ছুটি দিয়ে দেন না। সুতরাং বাসায় অক্সিজেনের ব্যবহার দরকার হবে না।
৪। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখি অনেক সংগঠন বাসায় অক্সিজেন পৌঁছে দিচ্ছে। আপনাদের মহৎ উদ্দেশ্যকে কুর্নিশ করে জানাতে চাই, মাইল্ড কেসের রোগীদের বাসায় অক্সিজেন পৌঁছে দিয়ে আপনার একটি কৃত্রিম অক্সিজেন সংকট তৈরি করছেন, সিলিন্ডারজাত অক্সিজেনের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন এবং একটি মহলকে করোনা ব্যবসায় ব্রতী করছেন। আপনাদের প্রতি আমার অনুরোধ:
(ক) বাসায় বাসায় মেডিকেল অক্সিজেন পৌঁছে না দিয়ে আপনার এলাকায় যতগুলো অ্যাম্বুলেন্স আছে, সেখানে নিরবিচ্ছিন্ন অক্সিজেনের যোগান নিশ্চিত করুন সবার আগে। অনেক সময়ই দেখা যায় রোগীরা হাসপাতালে গিয়ে সিট পাচ্ছেন না। ফলে অন্য একটি হাসপাতালে যাচ্ছেন। এই বর্ধিত ট্রান্সপোর্টের সময়ে আপনার দেওয়া অক্সিজেনটা এখানে আসলেই কাজে লাগবে।
(খ) আপনার এলাকার সরকারি হাসপাতালগুলো যেখানে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাই নাই, সেখানে অক্সিজেনের মজুদ বাড়াতে সাহায্য করুন। কারণ, মজুদ ফুরিয়ে গেলে শুধু চিকিৎসক-সেবিকারাই বিপদে পড়বেন না; হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, ইনডোর, আইসোলেশন জোন- সর্বত্র আপনাদের সিলিন্ডার পৌঁছে দিন।
(গ) বাড়ি বাড়ি কাঁধে করে অক্সিজেন দেওয়া বন্ধ করুন। কারণ, আবেগী মনস্তত্ত্বে আপনি ভাবছেন, আপনি সিলিন্ডারটা দিয়ে কারও জীবন বাঁচাচ্ছেন। আদতে আপনি মোটেও সেটা করছেন না। আপনি হয় এমন কাউকে অক্সিজেন পৌঁছে দিচ্ছেন, যার আসলে অক্সিজেনের প্রয়োজন নেই, অথবা সত্যি সত্যি অক্সিজেন-সহ অন্যান্য জরুরি চিকিৎসা লাগবে- এমন কারও চিকিৎসা আপনি সিলিন্ডার দিয়ে বিলম্ব করাচ্ছেন।
(ঘ) অক্সিজেন দিয়ে সংগঠনের প্রচারই যদি আপনার উদ্দেশ্য হয়, তাহলে উপরের ১/২/৩/৪ এবং ক/খ/গ- আপনার জন্য নয়।
অক্সিজেনের রিসোর্স আমাদের অনেক অনেক বেশি নয়। খবরে দেখেছি, সরকারই অনেক স্বনামধন্য হাসপাতালে অক্সিজেনের মজুদ হঠাৎ ফুরিয়ে গেছে। সেন্ট্রাল লাইনে প্রেশার না থাকলে অনেক অক্সিজেন বেজড ডিভাইস কিন্তু চালানো যায় না। এই সীমিত সম্পদ দিয়েই কিন্তু লড়াইটা লড়ে যেতে হবে আরও বেশ কিছু দিন।
এখন আপনাদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, অক্সিজেনের ব্যবহারে, বিতরণে, ব্যবসায়, ব্র্যান্ডিংয়ে আপনি সচেতন হবেন কি না।
অক্সিজেন নিজে জ্বলে না, অপরকে জ্বলতে সাহায্য করে। আপনি নিজেও বাঁচুন, এবং অপরকে বাঁচতে সাহায্য করুন, কিন্তু সঠিক উপায়ে!
-
লেখক: চিকিৎসক, করোনা ইউনিট, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল