অপ্রদর্শিত আয়ের বিনিয়োগ সব খাতেই হোক
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব দ্বারা পরিচালিত আবাসন খাত দেশের প্যানডেমিক অবস্থায়ও রমরমা ব্যবসা করে চলছে। আয়করের নতুন বিধি অনুসারে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর পরিশোধ করলে উৎস জিজ্ঞাসা করা হবে না- এই শর্তে আবাসন খাতের বিনিয়োগকে কালো টাকার মালিকদের কাছে প্রত্যাবর্তন করানো হয়েছে। দেশের আবাসন খাত থেকে রাজস্ব বিভাগ ৩০২ কোটি টাকা আয় পেয়েছে।
এ বছরের বিষয়টা রাজস্ব খাত খুব বড় করে দেখছে।
৩০২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের বিপক্ষে কত টাকা বিনিয়োগ হয়েছে আবাসন খাতে, তার উল্লেখ নাই। দেশে ২০০৭ সালের সেই সময়কার সামরিক সরকার, তথা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিচালনা করেছিলেন, তারা সকল ধরনের বিনিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। উৎস ঘোষণা ব্যতিরেকে কোনো বিনিয়োগ করা যাবে না, যা আজও বহাল কেবলমাত্র আবাসন খাত ছাড়া।
দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য আবাসনের দিকে লক্ষ্য রেখে নানা স্তরে আলাপ-আলোচনার ভেতর থেকে আবাসন কোম্পানি দাবির কাছে সরকার মাথা নত করেছে বলা যায়। আবাসন কোম্পানিকে এই সুযোগ দেওয়ার ফলে দেশে দুর্নীতি বৃদ্ধি পেয়েছে কি না, তা বলতে পারবে গবেষণা সংস্থাগুলো। টিআইবি কিংবা এই ধরনের অন্য যারা গবেষণা করে, তাদের অনেকেরই গবেষণাপত্রকে বলা হয় বানোয়াট... ইত্যাদি। কিন্তু সত্যিকারের তথ্য উঠে আসে আবাসন কোম্পানির কাছ থেকেই যে, সরকার পরিচালনার দায়িত্ব প্রধান তিনটি বিভাগের অনেকেই এই সমস্ত সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে।
যেমন, আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি, চট্টগ্রামের আলোচিত মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ডের নায়ক ওসি প্রদীপ সাহা তার স্ত্রী ও পরিবারের অন্যদের নামে ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন। তার এই দুর্নীতির টাকা বিনিয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি হওয়াতেই তিনি দুর্নীতির মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন কি না- সে প্রশ্ন করা যেতে পারে।
শুধু ওসি প্রদীপের বিষয় নয়, অন্য ক্ষেত্রেও অন্য পেশার মানুষও যেন একই পথ অবলম্বন করছে।
সরকার যখন আবাসন খাতকে সুযোগ দিয়েছে, তখন সরকারের উচিত ছিল কর্মসংস্থান খাতগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া; যেমন শিল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে।
করোনা পরবর্তী সময়ে অঘোষিত টাকার ওপরে একটা কর ধার্য করা যেতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে, এই ধরনের শিল্প বিনিয়োগ দেশের জিডিপিতে যেমন সহায়তা করবে, তেমনি বিশাল জনসংখ্যার দেশের ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে তখনকার সুশীল সমাজের প্রতিনিধি কয়েকজনকে দেখেছি, তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন ড. আকবর আলি খান, যিনি অর্থনীতি খাতের একজন মেধাবী মানুষ, এনবিআর পরিচালনা করেছেন; তিনিও এই শিল্পে বিনিয়োগের যে বিষয় সুরক্ষিত ছিল, তা তুলে দেওয়ার পক্ষে তখন অত্যন্ত জোরালো অবস্থানে ছিলেন।
এ জন্যই এই আবাসন খাতের বিনিয়োগটা কতটা অর্থনীতি বান্ধব, তার যেমন হিসাব করতে হবে; তেমনি সর্বাগ্রে খুঁজে দেখতে হবে এই খাতকে শুধুমাত্র এই সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে দেশে দুর্নীতির বিকাশ লাভ করছে কি না। যেখানে শিল্প বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করা অথবা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলো, উৎস ঘোষণা করার শর্ত পুনর্বহাল করার ভেতর দিয়ে সেখানে আবাসন খাতকে এই ব্যাপক সুবিধা দেওয়ার ফলশ্রুতিতে দেশে দুর্নীতির প্রসার ঘটবে, ঘটেছে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই।
মানুষের আবাসন যেমন প্রয়োজন, তেমনি কর্মসংস্থানের প্রয়োজন। ব্যাপক বেকারত্বের দেশে বিনিয়োগের প্রসার ঘটানো জাতীয় দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অভাবে ব্যাপকভাবে দেশে যেমন দুর্নীতির প্রসার ঘটছে, তেমনি কর ফাঁকি দেওয়া একটা স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে।
ব্যবসায়ীদের মধ্যে কর ফাঁকি দেওয়ার ইতিহাস অনেক গভীর। তারপরও তাদেরকে যদি শিল্পে বিনিয়োগের সেই পুরনো সুযোগটা দেওয়া হয়, তাহলে বেকারত্ব নিঃসন্দেহে কমার সম্ভাবনা আছে। এই বিষয় বিবেচনায় রেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারের উচিত শিল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকৃত টাকার যদি উৎস ঘোষণা করা না হয়, তাহলে বিনিয়োগ ডিক্লারেশন হওয়া এবং বিনিয়োগ সম্পন্ন হওয়ার পরে যেমন আবাসন খাতে কর দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, তেমনি একই ব্যবস্থা চালু করা।
বর্তমানে আবাসনের দিকে লক্ষ রেখে যেভাবে অঘোষিত আয় বিনিয়োগ করার সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তেমনি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এমনসব ক্ষেত্রে একই ধরনের সুযোগ পারে বেকারত্বের এই দেশকে সহযোগিতা করতে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক