অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মীদের ভাগ্যে কি জুটবে?
ঘটনা ১
পকেটে যাদের পর্যাপ্ত টাকা আছে করোনার হাত থেকে সন্তানসহ নিজেদের বাঁচাতে সবাই এখন 'হোমকোয়ারেন্টিনে'। তাদের বাসায় এখন চাল, ডাল, তেল, মাছ, মাংসসহ নানা নিত্যপণ্যের মজুদের পাহাড়! তারা সবাই পরিবারসহ থাকবেন নিরাপদে, পর্যাপ্ত স্যানিটাইজারসহ। তাদের সন্তানরা থাকবেন 'দুধে-ভাতে'।
ঘটনা ২
কেরাণীগঞ্জের বুড়িগঙ্গা পাড়ে বসত গাড়ার পর থেকেই আমার বাসার সব কাজ করে দেয় এক মহিলা! নাম রাব্বানা! সে আমার এক বাবুর্চি বন্ধু, গণী ভাইয়ের বড় কন্যা। রাব্বানার সঙ্গে আমার দেখা হয় সপ্তাহে একদিন, প্রতি শুক্রবার, আমার ডেঅফ-এর দিনে!
বাকি দিনগুলো সে কাজ করে আমার লিখিত চিরকুট অনুসারে। আমার বাসার চাবি থাকে তার কাছে। তার মানে, রাব্বানা কিছুটা লেখাপড়াও জানে। তবে আমি জানি না, তার ছোট ভাড়াবাসার পরিবেশ কতটুকু 'করোনা প্রতিরোধে সহায়ক'।
তারপরও আজ সে আমার ডেঅফ-এর দিনে বাসায় এলো। আমার চাওয়ামতো এটা ওটা রান্না করে দিয়ে গেল।হেভি শাওয়ার নিয়ে সেই রান্নাই দুপুরে খেলাম পরম তৃপ্তি নিয়ে। জানি না, আমার করোনা হবে কি না!
তাহলে করোনা প্রতিরোধে আমার এখন কী করা উচিত? রাব্বানাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা উচিত? নিজের স্বার্থে যদি তাই করি, তাহলে রাব্বানার আয় কমবে। প্রতি মাসে সে আমার কাছ থেকে ২৩০০ টাকা পায়। যে টাকা সে তার এইচএসসি ও ক্লাস নাইনে পড়া ছেলেদের পেছনে খরচ করে। করোনার ভয়ে, আমি যদি রাব্বানাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দেই, তাহলে তার দুই ছেলের লেখাপড়া কি বন্ধ হয়ে যাবে?
ঘটনা ৩
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে সারা দেশের সব চায়ের দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কারণ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আড্ডা, সামাজিক সব তথ্য বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম এখনো চায়ের দোকানই। তাই করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে চায়ের দোকান বন্ধ করে সরকার অনেক ভালো উদ্যোগই নিয়েছে।
তবে কেরাণীগঞ্জে আমার এক বন্ধু আছেন, পরম বন্ধুই বলা যায়, আমরা ডাকি 'মনি' বলে। ছোট্ট একটা চায়ের দোকান চালান। প্রতিদিন বিক্রি হয়তো ৭০০ টাকা। সেই টাকায় তার তিনজনের সংসার চলে। একমাত্র ছেলের স্কুলের পড়াশুনারও খরচ চলে (কোচিংয়ের ফিসহ)। তবে আজ সকালে সাইকেল চালিয়ে তার দোকানে চা পানের বাসনায় গিয়ে দেখি, দোকানের শার্টার নামানো।
পরে প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদার এলাকায় 'এলান' করে দিয়ে গেছেন, 'সব চায়ের দোকান বন্ধ রাখতে হবে'।
পেটে 'ক্ষুধা' চেপে রেখে মনিও সরকারের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, মনির সংসার চলবে কিভাবে? আগামী মাসে মনি তার ছেলের স্কুলের বেতন দিতে পারবেন তো? বেতন না দিতে পারার অজুহাতে মনির ছেলেকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেবে না তো?
ঘটনা ৪
চরওয়াশপুরে আমার আরেকজন বন্ধু আছেন, নাম খলিল; পেশায় রাজমিস্ত্রী। অঘোষিত লকডাউনের কারণে তার কাজও বন্ধ।অথচ, তার সংসারে প্রতিদিন হাড়ি চাপাতে হয় কমপক্ষে চারজনের। এখানেই শেষ নয়, তার দুই ছেলে-মেয়ে স্কুল ও মাদ্রাসায় পড়ে। আচ্ছা, খলিলের পরিবারে এখন হাড়ি চড়ে তো?
সরকার কি জানেন, অঘোষিত লকডাউনের মধ্যে কীভাবে চলছে হাজারও রাব্বানা, মনি, খলিলদের সংসার? যারা সবাই অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মী। যাদের কাজের কোনো স্বীকৃতি নেই। যাদের কোনো লবিস্টও নেই, বিজিএমইএ, বিজেএমইএ'র মতো। তাহলে কী হবে তাদের?
জানি কিছুই জুটবে না তাদের ভাগ্যে। তারা নিজেরাই টিকে থাকবেন, 'সংগ্রাম করে, খেয়ে না-খেয়ে'।
সংগ্রাম দীর্ঘজীবী হোক...