আইনপ্রণেতারা যখন আইনবহির্ভূত হত্যা চান
যে কোনো সুস্থ মস্তিস্কের মানুষ একমত হবেন যে প্রতিটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড দেশের আইনের শাসন এবং স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার প্রতি আঘাত।
সংসদ সদস্যরা যেমন আইন প্রণয়ন করবেন, তেমনি সে আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কিনা তার নজরদারি করবেন। প্রয়োজনে বিদ্যমান আইন সংশোধন করবেন অথবা নতুন আইন তৈরি করবেন। মোদ্দা কথা আইনের শাসন সমুন্নত রাখার পক্ষে তারা জোরালো ভূমিকা পালন করবেন।
কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো দুইদিন আগে কয়েকজন সংসদ সদস্যের সংসদে দাঁড়িয়ে ধর্ষকদের ‘ক্রসফায়ার’ দেওয়ার দাবি দেশের সংবিধান, আইনের শাসন এবং স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার প্রতি পক্ষান্তরে অনাস্থা প্রকাশের মতোই একটি ব্যাপার।
তাদের দাবি ধর্ষকদের ‘ক্রসফায়ার’ দিলেই নাকি দেশে ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে। এমন দাবি যখন সংসদ সদস্যরা তোলেন তখন আমাদের আতঙ্কিত বোধ না করার কারণ নেই।
তাদের এমন দাবি সম্পূর্ণ ভুল। গত ১৫ বছরে প্রায় তিন হাজার বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে যদি অপরাধ দমন করা যেত তাহলে আজ সংসদে দাঁড়িয়ে তাদেরকে ধর্ষণ বন্ধ করতে ধর্ষকদের ক্রসফায়ারে দেয়ার দাবি জানাতে হতো না।
এক বছর আগেও মাদক সন্ত্রাস বন্ধ করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযানে প্রায় ৩০০ বিচারবহির্ভূত হত্যকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তাতে কি দেশ থেকে মাদক নির্মূল হয়ে গেছে?
দুর্ভাগ্যজনক হল, কয়েকজন সংসদ সদস্য যখন সংসদে দাঁড়িয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে বলছিলেন তখন স্পিকার তাদের কোনো বাধা দেননি। এমনকি তাদের বক্তব্যে সংসদের কার্যবিবরণী থেকে এক্সপাঞ্জও করেননি। অর্থাৎ তাদের এমন বে-আইনি দাবি সংসদের ইতিহাসে থেকে যাবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সংসদের কর্মকাণ্ড নিয়ে গবেষণার সময় সংসদ সদস্যদের এমন আইন বহির্ভূত দাবি সম্পর্কে জানলে তখন কি আমাদেরকে ধিক্কার দিবে না?
যারা সংসদে দাঁড়িয়ে ধর্ষকদের বিচারবহির্ভূতভাবে ক্রসফায়ারে দিতে বলেছেন তারা তাদের উপর অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্ব কি যথাযথভাবে পালন করছেন? সংসদে সেদিন উপস্থিত অন্য সদস্য যারা কয়েকজনের বেআইনি দাবির প্রতিবাদ না জানিয়ে চুপ করে থেকেছেন তারাও কি তাদের সাংবিধানিক দায়িত্বের প্রতি যত্নশীল ছিলেন?
বিচার পাওয়ার অধিকার যে কোনো নাগরিকের মৌলিক অধিকার, সংবিধান স্বীকৃত অধিকার। ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিরও সে অধিকার রয়েছে। কোনো অপরাধীকে বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলে দেশের সংবিধান এবং বিচার ব্যবস্থা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।
একটা কথা মনে রাখা উচিত মাথা ব্যাথার জন্য মাথা কেটে ফেলা যেমন কোনো সমাধান নয়, তেমনি অপরাধ দমনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কোনো সমাধান হতে পারে না।
লেখক: সাংবাদিক