একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফল
সংখ্যার মাধ্যমে তৃণমূলে আমাদের নির্বাচন ও গণতন্ত্র সম্পর্কে অনেক ধারণাই পাওয়া যায়।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) পরিচালনার জন্য একজন মেয়র ও ৫৫ জন কাউন্সিলর নির্বাচনের জন্য অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট দেননি ৭৭ শতাংশেরও বেশি ভোটার।
ভোটারদের 'গণতন্ত্রের উৎসবে' অংশ না নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়েছে নজিরবিহীন রেকর্ডও। বাংলাদেশের প্রায় তিন দশকের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ইতিহাসে সর্বনিম্ন ভোট পড়েছে এবারের চসিক নির্বাচনে।
১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম সিটি করপোরেশন নির্বাচন শুরু হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী- এ চার সিটি করপোরেশনে নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে সিটি করপোরেশন নির্বাচন শুরু। ৮০ দশমিক ৩০ শতাংশ ভোট নিয়ে সর্বোচ্চ ভোটদানের রেকর্ড গড়ে রাজশাহী। অন্য সিটি করপোরেশনগুলোতে ভোটদানের হার ছিল ৫৪-৬৩ শতাংশ। চট্টগ্রামে সেবার ৫৯ দশমিক ৩১ শতাংশ ভোট পড়েছিল।
প্রথম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের এ চিত্র বজায় ছিল পরবর্তী দুই দশকেও। তবে ২০১৫ সালে ঢাকায় দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন শুরু হওয়ার পরই ঢাকা ও চট্টগ্রামে এ চিত্র বদলে যেতে শুরু করে।
ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে ভোট বর্জন করে বিএনপি।
৩৭ দশমিক ২৯ শতাংশ ভোটার নিয়ে সর্বনিম্ন উপস্থিতি ছিল ঢাকা উত্তর সিটিতে, অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪৮ দশমিক ৪ শতাংশ। সে সময় চট্টগ্রামের ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪৭ দশমিক ৯ শতাংশ।
তবে গত বুধবারের নির্বাচনে বন্দরনগরী শুধু তার অতীত নির্বাচনের রেকর্ডই ভাঙ্গেনি, সর্বনিম্ন ভোটার উপস্থিতির নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে সর্বশেষ এ নির্বাচনে।
তবে নির্বাচনী ব্যবস্থায় এ নিয়ে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকায় ভোটারের সর্বনিম্ন উপস্থিতি সত্ত্বেও নির্বাচিতদের নিয়েই গঠিত হবে সিটি করপোরেশন।
প্রশ্ন হলো: এ ধরনের নিম্ন ভোটদানের হার কি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলা সংবিধানের নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ?
সংবিধানের ১১তম অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক নীতি হলো, প্রজাতন্ত্র হবে এমন এক গণতন্ত্র যেখানে প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।
শহরবাসীর জন্য কাজ করবে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন সিটি করপোরেশন।
সিটি করপোরেশন প্রদত্ত পরিষেবায় শহরবাসী সন্তুষ্ট নয়, নির্বাচনে বড় অংশের ভোটারদের অংশগ্রহণ না করা কি এমন সংকেতই দেয়?
গত বুধবার অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটারদের অনাগ্রহের অনেক কারণই রয়েছে।
দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশনের মতোই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনও জনসাধারণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি।
১৮৬৩ সালে গঠিত চিটাগং মিউনিসিপ্যালিটি, বর্তমানের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের শতবর্ষের ইতিহাস রয়েছে। প্রায় ১৫৮ বছর আগে প্রথম প্রতিষ্ঠার সময়েই শহরটির অন্যতম প্রধান সমস্যা ছিল জলাবদ্ধতা।
সংশ্লিষ্ট নথি অনুযায়ী, জনস্বাস্থ্য ও যোগাযোগ উন্নয়নের জন্য মিউনিসিপ্যাল বোর্ড গঠনের আগেই চট্টগ্রাম শহরের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে কমিটি গঠিত হয়।
১৮৫৬ সালের ১৪ মে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম সভার আলোচনার মূল বিষয়ই ছিল পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা।
১৯৭৭ সালে চিটাগং মিউনিসিপালিটির নাম পরিবর্তন করে চিটাগং পৌরসভা রাখা হয়, যা ১৯৮২ সালে মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনে উন্নীত হয়। ১৯৯০ সালের ৩১ জুলাই নাম পরিবর্তন করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন রাখা হয়। ১৯৯৪ সালে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় সিটি করপোরেশন নির্বাচন।
সর্বশেষ নির্বাচনে মেয়রপ্রার্থীদের অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল বন্দরনগরীর জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান। এর আগের নির্বাচনেও প্রার্থীরা একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অতীতের মতোই রাজনৈতিক ক্ষমতার অভাবে প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতার জন্য তাদের কাঠগড়ায় তুলতে পারেননি নগরবাসী।
বলে রাখা ভালো, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে পরিচালিত না হলে, এ ক্ষেত্রে জনসাধারণের কিছু করার রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকে না। এ ক্ষেত্রে শুধু নির্বাচনই অনেক কিছু বদলে দিতে পারে।
সর্বশেষ নির্বাচনে জনগণের অনাগ্রহের আরেকটি কারণ রাজনীতি।
স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা যেকোনো মূল্যে নির্বাচনে জয়লাভের জন্য মরিয়া ছিল, ফলে আইন অবমাননার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন পরিস্থিতিরও অবনতি হয়।
অন্যদিকে, দলীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে নির্বাচনের সার্বিক অবস্থা তদারকির দায়িত্বে থাকা নির্বাচন কমিশনও যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়।
ডিসেম্বর ও জানুয়ারির মধ্যবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত প্রথম দুই দফা পৌরসভা নির্বাচনেও সহিংসতার ঘটনা ঘটে, নির্বাচনী অনিয়ম দেখা যায়; ভোটারদের উপস্থিতিও ছিল কম।
তবে তারপরও এই ফলাফলেই সন্তুষ্ট নির্বাচন কমিশন।
মোদ্দা কথা, সবকয়টি আসন স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের দখলে যাওয়া এ নির্বাচনে সর্বনিম্ন ভোটার উপস্থিতির নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে।
- লেখক: উপ নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
- মূল লেখা: An unwanted outcome
- অনুবাদ: রাফিয়া তামান্না