চসিকের টাকায় প্রতিষ্ঠিত প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে দখলে নিল মহিউদ্দিন পরিবার
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ ও জমি দিয়েছিল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। কিন্তু তারপরও চসিককে প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরিবারের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়টির নিয়ন্ত্রণ হারাতে হয় তাদের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে।
পদাধিকার বলে টানা ১৩ বছর ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে মহিউদ্দিনসহ দুজন সিটি মেয়র দায়িত্ব পালন করেন। তবে ২০১৬ সালে মেয়র না হয়েও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি নিজের পরিবারের দখলে নেন মহিউদ্দিন।
আদালতের রায়ের তোয়াক্কা না করে সাত বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে নিজেদের সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে মহিউদ্দিনপুত্র সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে।
ক্ষমতার অপব্যবহার করে শর্তপূরণ না করার পরও স্থায়ী সনদ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে নওফেলের বিরুদ্ধে।
দখলকে স্থায়ী করতে ট্রাস্টি বোর্ডে যুক্ত করা হয়েছিল শত শত কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদসহ তার পরিবারের তিন সদস্যকে।
এদিকে দীর্ঘসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃত্ব না থাকায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে সূত্র।
বর্তমানে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি অনুষদের মোট ১৪টি বিভাগের ৬ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী আছে। শতাধিক শিক্ষকসহ মোট তিন শতাধিক কর্মকর্তা, কর্মচারী কর্মরত। বিশ্ববিদ্যালয়টির বার্ষিক বাজেট প্রায় ৭১ কোটি টাকা।
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু
চসিকের নথি থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, সংস্থাটির প্যাডে সরকারি দপ্তরে করা আবেদনের ভিত্তিতে ২০০২ সালে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পায় সিটি করপোরেশন। বিশ্ববিদ্যালয়টি করার প্রস্তাব প্রথমে এসেছিল এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কাছ থেকে।
সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন ভবনে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম শুরু করা হয়। শুরুতে চসিকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
এরপর প্রবর্তক সিএসসিআর হাসপাতালের বিপরীতে এবং নগরীর ওয়াসা মোড়ের ফিলিং স্টেশনের উপরে সিটি করপোরেশনের দুটি জমিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ করা হয়। তিনটি ভবন নির্মাণসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় মোট ৪৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ব্যয় করা হয় সিটি করপোরেশনের তহবিল থেকে।
এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ১৯৯৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিন মেয়াদে মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। ফলে ২০১০ সাল পর্যন্ত টানা আট বছর তিনি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন পদাধিকার বলে।
২০১০ সালের মেয়র নির্বাচনে এম মনজুর আলমের কাছে পরাজয়ের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান পদও হারান তিনি। তবে মেয়র মনজুর সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভায় মহিউদ্দিনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টির সদস্য হিসেবে মনোনীত করেন।
২০১৫ সালে আওয়ামীলীগ নেতা আ জ ম নাছির উদ্দীন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব। কারণ নাছিরের সঙ্গে মহিউদ্দিনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধ পুরনো।
সাবেক সিটি মেয়র এম মনজুর আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তিনি মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার পর চসিকের সাধারণ সভায় রেজুলেশন করে মহিউদ্দিনকে ট্রাস্টির সদস্য করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, 'আমি দায়িত্বে থাকার সময়ও বিশ্ববিদ্যালয়টি সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি ছিল। এরপর নতুন মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার পর কী হয়েছে, তা আমি জানি না।'
আইনি লড়াই
২০১৫ সালের ১৪ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এক চিঠি দিয়ে নতুন মেয়র নাছির উদ্দীকে ট্রাস্টির চেয়ারম্যান হিসেবে সম্বোধন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ প্যানেলসহ ঘাটতি পদগুলো পূরণে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলে। পাশাপাশি সর্বশেষ ট্রাস্টি বোর্ড নিবন্ধন করা হয়নি জানিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে আইন অনুযায়ী ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করতে বলা হয়। এছাড়া একটি চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট (সিএ) প্রতিষ্ঠান দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১১ থেকে ২০১৪ সালের হিসাব নিরীক্ষা করতে বলা হয় ওই চিঠিতে।
তবে ইউজিসির চিঠিটি কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা রেজিস্ট্রার বরাবর দেওয়া হলো না, এই যুক্তি তুলে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে উচ্চ আদালতের রিট পিটিশন দায়ের করেন মহিউদ্দিন।
বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চসিকের সম্পৃক্ততা ও হস্তক্ষেপ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, এই প্রশ্ন তুলে তিনি হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেন।
আদালত রুলের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে মহিউদ্দিনের অংশগ্রহণে কোনো ধরনের বাধা না দেয়ার নির্দেশনা দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা হিসেবে মহিউদ্দিন কেন ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করতে পারবেন না, তা জানতে চেয়েও রুল জারি করেছিলেন উচ্চ আদালত।
২০১৬ সালের ১২ জুন দেওয়ানী আদালতে প্রতিকার চাওয়ার নির্দেশ দিয়ে মহিউদ্দিনের পিটিশন খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। তবে ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন অধ্যাদেশ, ১৯৮২ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৯২-এর কোনোটিতেই সিটি করপোরেশনকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
তবে ওই মামলা চলাকালে চসিককে দেওয়া সেই চিঠিটি বাতিল করে ইউজিসি।
আদালতের পর্যবেক্ষণের বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশন রিভিউ পিটিশন দায়ের করে। ২০১৭ সালের মে মাসে রিভিউ পিটিশনের রায়ে উচ্চ আদালত উল্লেখ করেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ কোনো পক্ষের ওপর প্রয়োজ্য হবে না।
এ রুলের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবার লিভ টু আপিল পিটিশন করেন মহিউদ্দিন। কিন্তু এর শুনানিতে তিনি হাজির না হওয়ায় ২০১৯ সালের ৭ জানুয়রি লিভ টু আপিলটি খারিজ করে দেন আদালত।
উচ্চ আদালতের মামলটি খারিজ হওয়ার পর দেওয়ানী আদালতে কোনো মামলা করেননি মহিউদ্দিন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালনায় চসিকের সব ধরনের বাধা কেটে যায়।
কিন্তু মেয়রকে ট্রাস্টির চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ২০১৯ সালে নতুন সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পান মহিউদ্দিনপুত্র নওফেল। পরে তিনি শিক্ষামন্ত্রী হন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি নিজের প্রভাব খাটিয়ে পছন্দমতো ট্রাস্টি বোর্ডে সদস্য অন্তর্ভুক্ত করেন।
এছাড়া দলীয় হাইকমান্ডের অনানুষ্ঠানিক নির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব ছেড়ে দিতে বাধ্য হন তৎকালীণ মেয়র নাছির উদ্দীন। ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হন নওফেল।
চসিকের কয়েকজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা না করলেও চসিক তা করছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়।
তারা বলেন, আদালতে হেরে গিয়েও মহিউদ্দিন পরিবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিয়ে চাপে ফেলে বিশ্ববিদ্যালয়টি দখলে নিয়েছিলেন। বিষয়টি সিটি করপোরেশনের সবাই জানেন।
নওফেলের প্রভাব
২০১৭ সালে মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার রাজনৈতিক উত্তরসূরি হন বড় ছেলে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। বাবার মৃত্যুর পর তিনি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব নেন বলে জানান চসিক কর্মকর্তারা।
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের ১২ সদস্যের মধ্যে তিনজনই মহিউদ্দিন পরিবারের। বোর্ডের চেয়ারম্যান নওফেল, আর তার মা হাসিনা মহিউদ্দিন ও ছোট ভাই বোরহানুল হাসান চৌধুরী সদস্য হিসেবে আছেন।
এর বাইরে ট্রাস্টি বোর্ডে ছিলেন এস আলম গ্রুপের তিনজন, আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক অনুপম সেন, রেমন্ড আরেং, প্রকৌশলী শহীদুল আলম ও সাবেক সংসদ সদস্য সাবিহা মূসা।
২০১৯ সাল থেকে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী এবং ২০২৪ সালে শিক্ষামন্ত্রী হলেও ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েননি নওফেল।
উল্টো বিশ্ববিদ্যালয়টি পারিবারিক ও রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার প্রভাবের কারণে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নিয়োগ ও পদায়নের ক্ষেত্রে ইউজিসি মতামত নেওয়া হতো না। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এককভাবে নওফেলের সিদ্ধান্তেই চলত বিশ্ববিদ্যালয়টি।
প্রায় ১৬ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য পদে আছে অধ্যাপক অনুপম সেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী ৭৫ বছর বয়সের পর উপাচার্যের দায়িত্ব পালনের সুযোগ না থাকলেও ৮৪ বছর বয়সেও উপাচার্য পদে আছেন তিনি।
ইউজিসির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পরও নওফেল ট্রাস্টি চেয়ারম্যানের পদ না ছাড়ায় স্বার্থের সংঘাত দেখা দিয়েছিল। একইসঙ্গে তিনি প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ছিলেন। এ কারণে জবাবদিহি নিশ্চিত হয়নি।
ওই কর্মকর্তা বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী সনদ প্রাপ্তির জন্য নিষ্কণ্টক, দায়মুক্ত ও অখণ্ড জমিতে স্থায়ী ক্যাম্পাস থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা চসিকের জমি নিষ্কণ্টক ও দায়মুক্ত ছিল না। খণ্ড খণ্ড ক্যাম্পাস ছিল। এরপরও ২০২১ সালে শিক্ষা উপমন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে স্থায়ী সনদ দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়টিকে।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে নওফেল ও মহিউদ্দিন পরিবার আত্মগোপনে। প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মে অন্যতম অভিযুক্ত রেজিস্ট্রার খুরশিদুর রহমানও সরকার পতনের পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়েছেন। তার মুঠোফোনে ও হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে এবং উপাচার্য অধ্যাপক অনুপম সেনের মুঠোফোন নাম্বারে গত কয়েকদিনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের কাউকেই পাওয়া যায়নি।
চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, নিজস্ব জমিতে, অর্থ বিনিয়োগ করে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছে সিটি করপোরেশন। একসময় এটি চসিকের আওতায় ছিল। পরে যেকোনো কারণে হোক তা হাতছাড়া হয়ে গেছে।
'এখন বিভাগীয় কমিশনানের আলাপ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে,' বলেন তিনি।