করোনাভাইরাসের প্রভাবে তাঁত শিল্পে ‘মহামারি’
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া সরকারের জন্যে জরুরি। তার মধ্যে বিধিনিষেধ আরোপ (সাধারণ মানুষের ভাষায় লকডাউন) অন্যতম প্রধান একটি পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপ নেওয়ার কোন বিকল্প ছিল কি না, সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। কিন্তু করোনাভাইরাস যেমন জীবন কেড়ে নেয়, আক্রান্তদের শারীরিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে, একইভাবে করোনায় আক্রান্ত না হয়েও লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত ও নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন এমন মানুষের সংখ্যা লাখ থেকে কোটির ঘরে পৌঁছাচ্ছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ( ৩১ আগস্ট ২০২১) করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ লক্ষ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ২৬,১৯৫ জন। এই অবস্থাকে মহামারি ঘোষণা করা হয়েছে এবং সর্বাত্মক চেষ্টা করে সংক্রমণ রোধের চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সমন্বয়হীনতাসহ বহু দুর্বলতা আছে, সে প্রসঙ্গে এখন কথা বলছি না। কিন্তু জীবিকা হারিয়ে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন, এমন মানুষের পরিসংখ্যান কে রাখছে?
দেশে যখন লকডাউন (বিধিনিষেধের অপর নাম) ঘোষণা করা হয়, তখন অফিস আদালত, গণপরিবহন, গার্মেন্ট শিল্প, রপ্তানিমুখি শিল্প ইত্যাদি নিয়ে প্রচুর ভাবনা-চিন্তা করা হয়। প্রয়োজনে তাদের বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়। প্রয়োজনে গার্মেন্ট শ্রমিকদের শত শত কিলোমিটার হেঁটেও যদি আসতে হয়, তাতেও সরকারের খুব মাথাব্যথা নেই। গার্মেন্ট কারখানার মালিকদের অনুরোধে সব ছাড় দেওয়া হয়।
এটা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি বড় খাত, কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু দেশের অর্থনীতির জন্যে আরও যেসব শিল্প আছে, তাদের বাঁচিয়ে রাখাও কম জরুরি নয়। তাঁত শিল্প, বিশেষ করে শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, চাঁদর বুনছেন এমন লক্ষ লক্ষ তাঁতী আজ কী অবস্থায় আছেন, তাদের খবর কি কেউ রাখছে? ঢাকা, টাঙ্গাইল, পাবনা, কুষ্টিয়াসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের তাঁত শিল্প ২০২০ ও ২০২১ সালে লকডাউনে মারাত্মকভবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই শিল্পকে গ্রামীণ অর্থনীতিতে কৃষির পরেই সর্ববৃহৎ কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী হিসেবে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে চিহ্নিত করা হয়।
দেশে লক্ষ দক্ষ তাঁত শ্রমিক রয়েছেন, এর মধ্যে কম পক্ষে ৫০% নারী নানাভাবে তাঁতের কাজ করছেন। পরোক্ষভাবেও জড়িত রয়েছেন আরও কয়েক লক্ষ শ্রমিক। বছরে প্রায় ১০ বিলিয়ন টাকা তারা জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ করছেন। সবচেয়ে বড় কথা, দেশের সাধারণ মানুষের কাপড়ের চাহিদা (শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা) পূরণ করছেন তারাই।
কাপড় প্রতিদিন কেনা-কাটার পণ্য নয়। গরিব মানুষ বছরে-ছয় মাসে দুটো কাপড় কিনতে পারে। মধ্যবিত্ত এবং শহরের মানুষ নিত্য ব্যবহারের কাপড় ছাড়াও ঈদ, পয়লা বৈশাখ, পুজা, বিয়ে-শাদী ইত্যাদি অনুষ্ঠানে বিশেষ কাপড় কেনেন। তাই তাঁতীরা ঈদের সময় ভালো বিক্রি করতে পারলে তাদের বছরের আয়ের একটা বড় অংশ উঠে আসে।
গামছার ব্যবহার নানাভাবে হয়। লক্ষ কোটি গামছা কৃষক, রিক্সা-ভ্যানচালক, দিন মজুরসহ নানা পেশার মানুষ ব্যবহার করেন। কিন্তু এইসব প্রয়োজনের কথা ভেবে লকডাউন ঘোষণার সময় বিশেষ ছাড়ের কথা চিন্তা করা হয় না, যেটা গার্মেন্ট কারখানার ক্ষেত্রে দেওয়া হয়। এমনকি তামাকের মতো ক্ষতিকর পণ্যের কোম্পানিও বিশেষ আবেদন করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের আইনের দোহাই দিয়ে ছাড় নিচ্ছে। কিন্তু তাঁত শিল্পের ক্ষেত্রে কোনো বিবেচনা করা হয়েছে কি না, আজও শোনা যায়নি। কোনো প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা তাঁত শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষ তাদের জীবন-জীবিকা রক্ষার জন্যে পাননি।
তাঁতীদের দুর্দশার কথা, বিশেষভাবে প্রতিবেদন খুব কম পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনগুলো করা হয়েছিল ঈদের আগে, এপ্রিল মাসে; কারণ এটাই দেশীয় কাপড় বিক্রির সবচেয়ে বড় সময়। কয়েকটি পত্রিকার বরাতে কিছু তথ্য দিচ্ছি। পাবনা ও সিরাজগঞ্জের চিত্তরঞ্জন তাঁতে ২৫ থেকে ৩০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান ছিল। এই দুটি জেলা দেশের সর্ববৃহৎ তাঁত এলাকা। এদের মধ্যে সারা বছরে ঈদের সময় ৬০% তাঁত বস্ত্র বিক্রি হয় শাহজাদপুর হাটেই; লেনদেন হয় প্রায় ২০০ কোটি টাকার। কিন্তু এবার ঈদের আগে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে দোকান খোলার কারণে মাত্র ১০ থেকে ২০% তাঁত বস্ত্র বিক্রি করা গেছে।
এখানে প্রায় ৬ লক্ষ তাঁত চলত স্বাভাবিক সময়ে। মহামারিতে মাকুর শব্দ শোনা যাচ্ছে না সাড়ে ৩ থেকে ৪ লক্ষ তাঁতের। দেশের ৪৮% তাঁত বস্ত্র এই দুটি জেলাতেই উৎপাদন করা হয় [ডেইলি স্টার, ২৭ এপ্রিল ২০২১]। এখন তাঁতীদের অবস্থা খুবই খারাপ।
তাঁত বন্ধ হয়ে যাবার কারণে তাঁতীদের একটি বড় অংশ অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন পেটের ক্ষুধা মেটাবার জন্যে। ছোট ছোট তাঁত কারখানাগুলো বন্ধ করে দিতে হচ্ছে; কারণ, সুতার দামও বেড়ে গেছে অন্তত ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। এদিকে বিক্রির কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিছু তাঁতী ধার-দেনা শোধ করতে তাঁত বিক্রি করে দিচ্ছেন, আবার কেউ কেউ এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন দেনা শোধ করতে না পেরে। আগে যে তাঁতী নিজে শ্রমিক নিয়োগ করে তাঁত চালাতেন, এখন তাদের অনেকেই অন্যের তাঁতে শ্রমিক হয়ে কাজ করছেন [ঢাকা ট্রিবিউন, ২৫ এপ্রিল ২০২১]।
টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি বা ভাইটাল তাঁতের শাড়ি একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প। বৈচিত্র্য তাঁতের ধরনে, উৎপাদন পদ্ধতির পার্থক্যে, বুনুনিতে এবং নকশায় অন্যান্য সব তাঁতের চেয়ে ভিন্ন। বাংলাদেশের পরিচয় তুলে ধরার যে শাড়িগুলো পৃথিবীর সকল বাঙালির কাছে পরিচিত, তার মধ্যে রয়েছে জামদানির; পাশাপাশি রয়েছে টাঙ্গাইলের ভাইটাল তাঁতের শাড়ি, বিশেষ করে নকশি বুটি শাড়ি। তবে পাবনার শাড়ির তুলনায় এই শাড়ি মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের নারীদের মধ্যেই বেশি ব্যবহার হয়; কারণ এই শাড়ি তৈরিতে যে শিল্পকর্ম ও দক্ষতার প্রয়োজন পড়ে এবং দামি মিহি সুতার ব্যবহার হয়, তাতে এর দাম সাধারণ শাড়ির তুলনায় অনেক বেশি পড়ে।
বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলায় ৩৪,৪০২টি তাঁতে এক লক্ষ তাঁতী যুক্ত আছেন। কিন্তু করোনা মহামারির আগে ৫০,০০০ তাঁত চালু ছিল এবং তাতে দেড় লক্ষ তাঁতীর কর্মসংস্থান ছিল [ঢাকা ট্রিবিউন, ১৮ মার্চ ২০২১]। অর্থাৎ, সরকারি হিসেবেই ৫০ হাজার তাঁতী কর্মহীন হয়েছেন; তাঁত বন্ধ হয়েছে ১৫,৫৯৮টি।
টাঙ্গাইল শাড়ি দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল ইউনিয়নে বেশি উৎপাদিত হয়। করোনা পরিস্থিতিতে তাঁত শিল্পীরা কেমন আছেন, জানার জন্যে উবিনীগ একটি সংক্ষিপ্ত জরিপ চালায়। নলুয়া গ্রাম যেখানে নকশি বুটি তাঁতীরা জানিয়েছেন, করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনের কারণে মহাজনরা কাপড় নেওয়া বন্ধ করেছেন। মহাজনরা তাদের কাছ থেকে আগে যে শাড়ি নিয়েছিলেন, এখনো বিক্রি করতে পারেননি। টাঙ্গাইলের বড় হাট করটিয়া ও পাথরাইল বাজারের দোকান বন্ধ। কাপড় তৈরি করতে সুতা, নাতা কিনতে হয়। কর্মচারীর মজুরি দিতে হয়। কাপড় তৈরি করে বিক্রি করার পর শ্রমিকদের মজুরি দেন। ওই টাকায় সংসার চলে। প্রায় ৩ মাস ধরে কাপড় বোনা বন্ধ।
ঈদের বাজার ধরার জন্যে করোনার আগে শব-ঈ বরাতের পর থেকে কাপড় বিক্রির তোড়জোড় লেগে যেত। ঈদ উপলক্ষ্যে সব শাড়ি রোজার আগেই পাইকারদের কাছে বিক্রি হয়ে যেত। গত ৩০ থেকে ৪০ বছর তাঁতীরা এভাবেই তারা কাজ করে আসছেন। কিন্তু এই বছর তার কিছুই নেই। তাঁতীদের ঘরে ঘরে কাপড় পড়ে আছে।
তাঁতী হাবেল মিয়া একজন ক্ষুদ্র নকশি বুটি তাঁতী। তার কথার মধ্যে তাঁতীদের দুর্দশার চিত্র ফুটে উঠেছে। হাবেল বলছেন, 'আমরা তো ছোট তাঁতী। ব্যবসায় খাটানো সামান্য পুঁজি সব আটকে আছে। দেশের পরিস্থিতি ভালো হলে ক্ষতি দিয়েও বিক্রি করে দিতাম। এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। দিনমজুরদের চেয়েও খারাপ অবস্থায় আছি। আমরা ভ্যান বা রিকশা চালাতে পারি না। কৃষিকাজ করতে পারি না। কর্মচারীরা অন্য পেশায় লেগেছে। কোনো জায়গা থেকে টাকা আসছে না। পুঁজি আটকে গেছে। বর্তমানে গ্রামের সব তাঁত বন্ধ আছে। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে তৈরি করা সব শাড়ি ঘরে পড়ে আছে। আগে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, স্থানীয় মহাজনরা এসে শাড়ি নিত। কবে বাজার ব্যবস্থা আগের মতো হবে, জানি না।'
তাঁত শ্রমিকদের কাজের অবস্থাও করুণ। তারা মালিকের কাছে এসে টাকা ধার চান। মালিকের চলে না, তাই ধারও পান না। বেশির ভাগকে এক বেলা খেয়ে থাকতে হয়। অনেক শ্রমিক ধানকাটা, কামলা দেওয়া, রাজের কাজ, অটোরিকশা চালানোতে নিযুক্ত হয়েছেন। শত শত সহযোগী নারী শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। নারী শ্রমিকেরা বাড়িতে শাড়ি এনে শাড়ির ডিজাইনের ঝুলের সুতা কাটার কাজ করতেন। দিনে ৩-৪টি শাড়ির ডিজাইনের সুতা কাটতেন। কিন্তু এখন শাড়ি উৎপাদন না থাকায় নারীরা আর কাজ করতে পারছেন না।
বসাক তাঁতীরা এখানে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তারা নিজেরা উৎপাদন করেন এবং অন্য তাঁতীদের কাছ থেকেও সংগ্রহ করেন। তাদের শাড়ির ও তাঁত কাপড়ের ব্যবসা ভারতের কলকাতার সঙ্গেও অনেক বেশি ছিল। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে সারা দেশ থেকে বিভিন্ন ব্যাপারী যে শাড়ি কিনতেন, তা প্রায় বন্ধ; ভারতেও শাড়ি যাচ্ছে না। ফলে তাদের অবস্থা শোচনীয়। বেচা-বিক্রি না থাকার কারণে পুঁজি ভেঙ্গে খাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।
কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলায় যেসব তাঁতী গামছা ও লুঙ্গি বোনেন, তাদেরও একই অবস্থা। যারা নিজের তাঁতে কাপড় বোনেন, সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং অন্যান্য এলাকা থেকে পাইকাররা আসছেন না বলে বাধ্য হয়ে তাঁত বন্ধ রাখছেন। করোনা পরিস্থিতিতে মহাজনরা বাকিতে সুতা দিচ্ছেন না। বাজারে গামছা ও লুঙ্গির দাম পাওয়া যাচ্ছে না।
গরিব ও স্বল্প পুঁজির এই তাঁতীরা মাসে প্রায় ৪ হাজার টাকা আয় করতে পারতেন, এখন তা বন্ধ হওয়ায় তাদের লবণ, চাল, ডাল দোকান থেকে ধার করে কিনতে হচ্ছে। এক পর্যায়ে সেই সুযোগও থাকবে না। তাই কঠিন খাদ্য সংকটে তাদের দিন যাচ্ছে।
অনেক গরিব মহিলা চরকায় সুতা নলি ভরার কাজ করতেন। তাঁত বন্ধ থাকছে বলে তাদের এই কাজও নেই। আগে দিনে প্রায় ৩০-৪০ টাকা আয় হতো, যা দিয়ে তেল-লবণের খরচ যোগান দেওয়া কিংবা চালটুকু হলেও কেনা যেত।
এই ধরনের অবস্থা বর্ণনা করতে গেলে লিখে শেষ করা যাবে না। কিন্তু কিছু উদাহরণ থেকেই দেখা যাচ্ছে, তাঁতীদের বিষয়ে বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম বোর্ড, শিল্প মন্ত্রণালয় কিংবা এসএমই প্রতিষ্ঠান- কারও কাছ থেকেই কোনো সহায়তা তারা পাচ্ছেন না। তাদের এই মহামারির মধ্যেও বাজারে ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাজার নাই তো তাদের জীবিকা নাই। আর সরকার জীবন বাঁচাবার কথা বলে যে ব্যবস্থা নিচ্ছে, তাতে বিশাল একটি জনগোষ্ঠি অনাহারে থাকছে, পুঁজি হারিয়ে পথে বসছে, সে দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
এই শিল্প ধ্বংস হলের দেশের অর্থনীতিরও বড় ধরনের ক্ষতি হবে, সেই দিকটা আমাদের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দেখার কথা ছিল। সেটা হচ্ছে না।
শুধু করোনা নয়, মহামারি লেগেছে দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনায়। এ অবস্থায় তাঁত শিল্প রক্ষা করুন, তাঁতীদের জীবন-জীবিকা বাঁচান।
-
লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী