গণমাধ্যম: স্বাধীন, বেশি স্বাধীন নয়, নাকি প্রায় পরাধীন...?
মিডিয়ার স্বাধীনতা নিয়ে তর্কের কোনো শেষ নেই। এ তর্ক না থাকলে, কলামবিদদের লেখার টপিক যেমন থাকবে না, তেমনি থাকবে না মানব বন্ধন, সেমিনার, জুম মিটিং, টকশোগুলোও। কয়েকটি এনজিও মিডিয়ার স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করছে। বলতে হয় মিডিয়ার স্বাধীনতার তর্কটা ভালোই বেঁচে আছে I
মিডিয়ার জন্য সেটা সুসংবাদ। কারণ পাঠক জানতে চায়, সংবাদ কর্মীরা বলতে চায় আর সরকার এই সুযোগে জানাতে চায় যে, এরকম স্বাধীনতা কোনোদিন ছিল নাI কিন্তু কার কথা আমরা বিশ্বাস করবো?
জনপ্রশাসনের অবস্থান থেকে আমরা কয়েকজন একটি কাজ করতে উদ্যোগ নিয়েছিI আমরা দেখার চেষ্টা করছি এই বিষয়টিকে মিডিয়ার মালিক, সম্পাদক অর্থাৎ নীতিনির্ধারককুল, কর্মী বাহিনী ও মিডিয়ার ভোক্তারা কী ভাবে দেখেন; কী কী বিষয়কে তারা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন।
মিডিয়াতে কি থাকে?
মিডিয়ায় কতটা রাজনীতির খবর থাকে, কতটা অর্থনীতি, বিনোদন, খেলার খবর এবং অন্যান্য খবর থাকে এ নিয়েই আমাদের প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু I এরপর প্রশ্ন, কোন খবরে কে কতটুকু প্রভাবিত হয়। কীভাবে হয়, কাদের দ্বারা হয়।
আমাদের গণমাধ্যমগুলোর চিত্র হলো, সাংবাদিকরা সংবাদ তৈরি করছে কিন্তু সেই সংবাদের বিষয় নির্ধারণ করে দিচ্ছে বা ট্রিটমেন্ট ঠিক করছে মালিক-পক্ষ অর্থাৎ এই মিডিয়ার চরিত্র। অতএব মালিক/ সম্পাদক হচ্ছেন এখানে নীতিনির্ধারক। সুতরাং মিডিয়ার স্বাধীনতার পরিসরে তাদের ভূমিকা কী, সেটা বোঝা দরকারI কিন্তু সে বিষয়ে বিতর্ক বা আলোচনার আগ্রহ খুবই কম I
কিন্তু "মিডিয়ার স্বাধীনতা' শব্দটির প্রকৃত অর্থ বলতে আমরা কি বুঝি? বেশ কয়েকটি প্রাথমিক আলাপ থেকে যা বুঝলাম তা হলো, মিডিয়ার স্বাধীনতা বলতে অধিকাংশ মানুষ মনে করে "রাজনৈতিক স্বাধীনতা "।
তাদের মতে, মিডিয়ার স্বাধীনতা নির্ভর করছে, যে মিডিয়া সরকারের কতটা সমালোচনা করতে পারবে তার ওপর। অর্থাৎ, যে মিডিয়া দেশের প্রধানমন্ত্রীকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করতে পারবে সেই মিডিয়া সবচেয়ে স্বাধীন। মিডিয়ার চরিত্রের, কাঠামোর বা উদ্দেশ্যের সঙ্গে স্বাধীনতার সম্পর্ক নিয়ে ভাবনা কম I
তাহলে প্রশ্নটা কি মিডিয়া বিষয়ক না রাজনীতি বিষয়ক?
মিডিয়ার স্বাধীনতা আর রাজনৈতিক স্বাধীনতার পরিসরের মধ্যে যদি পার্থক্য না থাকে, তবে মিডিয়া কি প্রধানত রাজনীতির সহকারী বা সহায়ক ?
এই কারণে মিডিয়ার প্রধান ভূমিকা কি, সেটা নিয়ে জড়িতরা, সংশ্লিষ্টরা কি ভাবছে সেটা জানা দরকারI
প্রাথমিক পর্যায়ে প্রশ্ন করতে গিয়ে ৫ টি প্রধান উত্তর পেয়েছি পাঠকদের কাছ থেকে। যদিও সেখানে মতভেদ রয়েছে।
১. মিডিয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে
২. রাষ্ট্র বিরোধী শক্তিদের প্রতিহত করবে
৩. সরকারের ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দেবে
৪. জনগণের সেবা করবে
৫. তথ্য ও বিনোদনের উপাদান দেবে
একই প্রশ্ন গণমাধ্যম কর্মীদের করলে, তারা প্রায় কেউই তথ্য সরবরাহের কথা উল্লেখ করেননি। প্রায় সবাই বিষয়টিকে দেখছেন রাজনীতির পরিসর থেকেI তাদের বক্তব্য গণমাধ্যম হলো "গণতন্ত্রের পথে চলমান ও দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়ার এটি অংশ।"
কাজ করার স্বাধীনতা: মালিক ও সরকার
যখন কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কারা খর্ব করছে, প্রায় সবার উত্তর ছিল, "এর জন্য দায়ী সরকার অথবা দলীয় রাজনীতির প্রতি আনুগত্য।"
এছাড়া, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা নিয়ে রিপোর্ট করতে গেলেও তাদেরকে সাবধান করে দেয়া হয় বলে তারা জানান। কে এই "স্বাধীনতা" খর্ব করছে জিজ্ঞাসা করলে তাদের উত্তর "সবাই জানে, কি বলা যাবে, কি যাবে না I " অবশ্য, এই ধরনের রিপোর্টিংকে তারা স্বাধীনতার সূচক বলে মনে করে নাI
মালিকের সাথে সাংবাদিকের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে তারা আগ্রহী কম I অনেকেই অস্বস্তি প্রকাশ করেন আলাপ করতে I যখন সরাসরি জিজ্ঞাসা করা হয়, কে তাদের কলম বন্ধ করে, বেশিরভাগ মানুষ ইঙ্গিত করে মালিককেই I তাদের উত্তর: "মালিকপক্ষ যে কারণে বিনিয়োগ করেছে সেটা ব্যর্থ হবে যদি সরকার বিরোধী রিপোর্ট হয় I মালিকের স্বার্থের বিরুদ্ধে বা তার লোকের বিরুদ্ধে কিভাবে রিপোর্ট হবে? "
এই জিজ্ঞাসাবাদ থেকে যা বোঝা গেলো, সরকারের আইন বা কড়াকড়িকে সবাই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ মনে করে কিন্তু মালিকের হস্তক্ষেপকে নয়I সেটাকে তারা মেনে নিয়েই চলে এবং টিকে থাকার উপায় মনে করেন। কারণ মালিকের সন্তোষ না থাকলে চাকরিও থাকবে না।
অতএব স্বাধীনতার ধারণাটা রাজনৈতিক, পেশাগত নয় I এখানে,মালিকের হস্তক্ষেপ স্বাভাবিক কিন্তু সরকারি হস্তক্ষেপ "গনতন্তের সহায়ক" মিডিয়ার প্রধান অন্তরায় ভাবা হচ্ছেI
পাঠক, শ্রোতা ইত্যাদি যারা গণমাধ্যমের খদ্দের তাদের কয়েকজনের সাথে আলাপে জানা গেলো, মানুষ এখন পেশাদারি মিডিয়ার চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার দিকেই ঝুঁকছে বেশিI আগেকার দিনের মতো মানুষ সাংবাদিকদের ওপর একচ্ছত্রভাবে নির্ভর করে না। তবে সরকারি দলের ভোক্তারা টেলিভিশনের ওপর বেশি আস্থাবান I কারণ সেখানে রাজনৈতিক বিষয়গুলোর চর্চা বেশি I
অন্যদিকে, সরকার বিরোধী ভোক্তারা তুলনামূলকভাবে পত্রিকা বেশি পড়ে। তবে পত্রিকার চেয়েও তারা ফেসবুককেই বেশি প্রাধান্য দেয়। টিভি চ্যানেলের মালিকদের তারা সরকারি লোক মনে করে। যেহেতু ফেসবুকে তারা নিজের সমগোত্রীয়দের পায় এবং প্রতিক্রিয়া জানিয়ে মন্তব্য করতে পারে তাই ফেসবুক তাদের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং পছন্দের I
এই সব তথ্যই সংগ্রহ করা হয়েছে জরিপ ভিত্তিক গবেষণার কাঠামো তৈরির জন্য। বেশিরভাগ মানুষের কাছে যে মিডিয়া ও রাজনৈতিক অবস্থান একই তার একটি নমুনা হলো এসবI
অতএব "নির্মোহ" মিডিয়ার প্রতি কারো আগ্রহ নেই। না ভোক্তার , না কর্মীর। তাদের কাছে যা গ্রহণযোগ্য মনে হয়, তারা তাই-সমর্থন করেI কর্মীদের মধ্যেও প্রাধান্য দেয়া হয় দল ভিত্তিক রাজনৈতিক সচেতনতাকেI
তাদের কাছে 'জনগণের ভাবনা' ও 'তাদের সমর্থিত দলের অবস্থান' সমার্থকI তাই গণমাধ্যম এখন নিজস্ব কাঠামো, বৈশিষ্ট্য নয় রাজনীতির দিকে ঝুঁকছে। হয়তো এটা সব সময় ছিল, এখন এটা অনেক প্রবলI
এই পরিবেশে কোন ধরনের মিডিয়া টিকে থাকবে তা এখনো বোঝা যাচ্ছে নাI
- লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, কলাম লেখক
অনুলিখন: রাফিয়া মাহমুদ প্রাত