ছাত্রদের আন্দোলন কি নিরাপদ সড়কের জন্য স্বপ্ন জাগাবে আবার?
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট, ওই কয়েকটা দিন রাস্তায় চলতে খুব নিরাপদ বোধ করতাম। লাইন মেনে গাড়ি চলত, উল্টো পথে যান চলাচল বন্ধ ছিল, লাইসেন্স ছাড়া কেউ গাড়ি চালাতে পারত না, অ্যাম্বুলেন্সকে জ্যামে আটকে থাকতে হয়নি...!
ওই কটা দিন ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করেছিল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের বাবা-মায়ের সমর্থন ও আদর, অন্যান্য শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের অকুণ্ঠ সমর্থন প্রকাশ্যে দেখা যেত। বাবা-মা তাদের ট্রাফিকের দায়িত্ব নেয়া ছেলেমেয়েদের সড়কের মাঝে দাঁড়িয়ে মুখে তুলে ভাত খাইয়ে দিতেন। শুধু নিজের সন্তানকেই নয়, সন্তানের বন্ধুদেরকেও খাইয়ে দিতেন তাঁরা।
শিক্ষার্থীরা তখন রাস্তায় মোড়ে মোড়ে সাইনবোর্ডে লিখে দিয়েছিল—'রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলছে, সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত'।
মানুষ আশা দেখেছিল, শিক্ষার্থীরা আশা জাগিয়েছিল, কুড়িয়েছিল বিপুল বাহবা। নগ্ন হয়ে পড়েছিল সড়ক ব্যবস্থাপনার বেহাল দশা। পুলিশের পোশাক পরা বাইকারের লাইসেন্স না থাকা, সরকারি গাড়ির ড্রাইভারের গাড়ির বৈধ কাগজ না থাকা—ইত্যাদি তখন শিক্ষার্থীরা সারাদেশের মানুষের সামনে উদোম করে দিয়েছিল।
২০১৮ সালের 'নিরাপদ সড়ক আন্দোলন' আশা জাগালেও আজও আমাদের সড়ক নিরাপদ হয়নি। তখনকার আশ্বাস বাস্তবায়ন হয়নি। থামেনি সড়কে মৃত্যুর মিছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থীরা যখন গণপরিবহনে 'হাফ ভাড়া'র দাবিতে আন্দোলন করছে, তারমধ্যেই ঘটেছে আরও একজন ছাত্রের মৃত্যু। নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈম রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ঢাকা সিটি করপোরেশনের গাড়ির ধাক্কায় মৃত্যুবরণ করেছে। পরবর্তীতে দেখা গেছে, ওই গাড়ি যিনি চালাচ্ছিলেন তিনি আসলে ড্রাইভারই না, সিটি কর্পোরেশনের একজন ক্লিনার।
নাঈমের মৃত্যু কি দুর্ঘটনা? এই প্রশ্নটার প্রথমে সুরাহা দরকার। সড়কে যত মৃত্যু ঘটে, সেগুলোর কারণ কী, এবং সেসবের দায় কার? নাঈমের মৃত্যুর কথাই ধরুন—ওই ক্লিনার গাড়ির স্টিয়ারিং ধরতে পারল কেন, তা-ও আবার ঢাকা শহরের মতো ব্যস্ত সড়কে? আসল ড্রাইভার কী করছিল? ময়লার গাড়িগুলো তদারকি করার দায়িত্বশীল লোক কে? ময়লার গাড়ি দিনের বেলা তো রাস্তায় চলাচলই করা কথা না—তাহলে চলল কেন? এই সবকিছুই এই মৃত্যুর সাথে জড়িত। কিংবা আমাদের রাস্তায় বিভিন্ন স্পিডের গাড়ি একই রাস্তায় কোনো রকম নির্দিষ্ট লেন ছাড়াই চলাচল করে, জেব্রা ক্রসিংয়ের অপ্রতুলতা আছে তো বটেই, তারপরও তা মানা হয় না। কে মানাবে?
রাস্তায় যেখানে-সেখানে ম্যানহোলের খোলা মুখ যেন হাঁ করে থাকে শিকার ধরার জন্য! ফুটপাত হকারের দখলে, রাস্তায় হাঁটতে বাধ্য পথচারী—কে ঠিক করবে? একটা বেশি ট্রিপ ধরার জন্য বেপরোয়া বাস ড্রাইভার—ড্রাইভারদের নির্দিষ্ট বেতন নেই কেন, তাদের নিয়োগপত্র কই, চাকুরির নিশ্চয়তা কই? এই সকল অব্যবস্থাপনার ফলাফল হলো—সড়কে মৃত্যু। ফলে এই মৃত্যুগুলোকে কোনভাবেই স্রেফ দুর্ঘটনা বলা যায় না; এগুলো নিশ্চিতভাবেই 'স্ট্রাকচারাল কিলিং বা কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড' ছাড়া কিছু নয়। ফলে এইসব মৃত্যুর দায়ও কাঠামোর সাথে যুক্তদেরই নিতে হবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের 'আশ্বাসবাণী' সমাধান নয়, সমাধান হলো—কার্যকর সড়ক আইন, কার্যকর সড়ক ব্যবস্থাপনা, সড়কের মাফিয়া সিন্ডিকেটের উচ্ছেদ।
গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার দাবিও কার্যকর আইন পাসের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত করতে হবে, কোনো মৌখিক নির্দেশনা বা আশ্বাস দিয়ে অতীতেও কাজ হয়নি আজও হবে না। হয়তো অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারে—শিক্ষার্থীদের 'হাফ পাস' কি আদৌ সম্ভব? কিংবা কেনই বা 'হাফ পাস' দরকার। সোজা কথায় বলি—শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে প্রাথমিক স্তর বাদ দিয়ে মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ১ কোটি ৯৯ লক্ষ ৮৬ হাজার ৬৪৯ জন। এর মধ্যে ২৮ শতাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন শহরে পড়াশোনা করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশের ৪২ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থান করে, এর মধ্যে শহরে ৩৫ শতাংশ। । আবার পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশান রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) তথ্য বলছে, করোনার প্রভাবে দেশে ২ কোটি ৪৫ লক্ষ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন, যার শতকরা হিসেব দাঁড়ায় ১৪.৭৫ শতাংশ। এর মধ্যেও প্রায় অর্ধেক শহরের। শহরের কথা বলছি এই কারণে যে, শহরের শিক্ষার্থীদেরই গণপরিবহণ বেশি ব্যবহার করতে হয় তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াতের জন্য। এই পরিবারগুলোর জন্য নতুন করে বর্ধিত ভাড়া বহন করা কতটা সম্ভব? আসুন একটা ছোট হিসাব করি—তেলের দাম ২৩ শতাংশ বৃদ্ধির পর ভাড়া বেড়েছে ২৭ শতাংশ, যদিও শহরের ভেতরে চলা বেশিরভাগ বাস গ্যাসে চললেও তারা ডিজেলের দামে ভাড়া নির্ধারিত রেটের বাইরেও অতিরিক্ত নিচ্ছে, যা আগেও নিয়েছে। এখন একজন নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের ছাত্র যদি মিরপুর থেকে মতিঝিলে কলেজে যাওয়া-আসা করে, তাহলে নতুন নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী তার প্রতিদিন প্রায় ৭০ টাকা খরচ হবে, মাত্র সাড়ে ১৬ কিলোমিটারের জন্য। সপ্তাহে ৪ দিন ছুটি ধরে, ২৬ দিনে তার খরচ হবে ১৮২০ টাকা। এটা শুধু পরিবহন খরচ। ওই পরিবারে যদি আরও একজন শিক্ষার্থী থাকে, তাহলে মাসে ৩৬৪০ টাকা। ওই পরিবার যদি ৩৫ শতাংশ শহুরে দরিদ্রের মধ্যে থাকে, তাহলে এই খরচ বহন করা তাদের পক্ষে কতটুকু সম্ভব?
শুধু দারিদ্র্যের বিবেচনাতেই নয়, দেশের সকল নাগরিকের বিকাশের স্বার্থেই শিক্ষার্থীদের বিশেষ সুবিধা দেয়া জরুরি। খোলাসা করে বলি—শিক্ষার্থীরা দেশের সম্পদ, শিক্ষার্থীদের পেছনে বিনিয়োগ মানে ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ। এই সহজ কথা না বোঝার কিছু নাই। আজকের যতটুকু বিকাশ আমরা দেখতে পাই, তার পেছনে অতীতের শিক্ষার্থীদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। এই সহজ কথাটা সারা দুনিয়ার বহু দেশ বোঝে এবং সেইমতো পদক্ষেপও নেয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, উন্নত দেশ যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রেও শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্নভাবে বিভিন্ন বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। হাফ ভাড়া, বিশেষ বাস সার্ভিস, রেলে বিশেষ ছাড়, স্টুডেন্ট ফেয়ার কার্ডের ব্যবস্থা ইত্যাদি কোনো নতুন বিষয় নয়। লুক্সেমবার্গ তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য গণপরিবহন পুরোপুরি ফ্রি করে দিয়েছে। দায় নিয়েছে রাষ্ট্র আর যারা করদাতা নাগরিক আছে, তারা। ফলে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার দাবি কোনো নতুন উদ্ভাবিত অযৌক্তিক দাবি নয়।
স্বাধীনতার আগে পাকিস্তানি শাসনমালেও হাফ ভাড়া কার্যকর করা হয়েছিল। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগারো দফার প্রথম দফাই ছিল শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার বিষয়ে। পাকিস্তানি স্বৈরশাসক ওই দাবি মানতে বাধ্য হয়েছিল। ২০২১ সালের বর্তমান সরকার তো নিজেদের গণতান্ত্রিক সরকার বলেন, শিক্ষাবান্ধবও বলেন! তাহলে তাদের সমস্যা কোথায়? নাকি মালিকরা নাখোশ হবে সেই ভয় পায় সরকার? পরিবহন মালিকদের দৌরাত্ম্য কতটা, তারা সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে, তার নজির আমরা সাম্প্রতিক সময়ে দেখেছি, যখন সরকার রাতের অন্ধকারে, বিইআরসি-র শুনানি ছাড়াই তেলের (ডিজেল ও কেরোসিন) দাম ২৩ শতাংশ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিল। তখন পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সংগঠন দেশব্যাপী ধর্মঘট ডাকল, তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে। পরে দেখা গেল তারা সরকারের সাথে মিটিংয়ে তেলের দাম কমানোর কথাই তুলল না, তুলল ভাড়া বৃদ্ধির কথা। তেলের দাম ২৩ শতাংশ বাড়লেও সরকার গাড়িভাড়া বাড়িয়ে দিল ২৭ শতাংশ। মালিকরা ধর্মঘট তুলে নিল। সরকার একবারও বলতে পারেনি ২৩ শতাংশের জায়গায় ২৭ শতাংশ কেন? সরকার এতটাই জিম্মি পরিবহন মালিকদের কাছে।
দৈনিক বণিক বার্তার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, পরিবহন সেক্টরে শুধু ঢাকা শহরেই দৈনিক ৪-৫ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয় বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নামে। সেই হিসেবে বছরে ১৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা শুধু ঢাকা শহরেই, আর সারাদেশে ২ হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। এর বাইরে আরও কত কী আছে তার হিসেব হয়তো আমাদের অজানা! এই টাকার গন্তব্য কোথায়? এটা অজানা নয় যে, পরিবহন সেক্টরের এই সিন্ডিকেটের সাথে সরকারের সম্পর্ক কতটা গভীর! সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী হয়েও পরিবহন শ্রমিকদের সংগঠনের নেতা থাকা গেলে বাস ভাড়া ২৩ শতাংশের বদলে ২৭ শতাংশ বৃদ্ধি তো হবেই!
বারবারই আমরা দেখেছি—আন্দোলনের সময় সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা বহু গালভরা আশ্বাস দেন। যেমনটা ২০১৫ সালের অক্টোবরে বিআরটিসি কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক আলোচনায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রাজধানীতে বিআরটিসির বাস ছাড়াও সকল গণপরিবহন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নেওয়ার ও ব্যত্যয় ঘটলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান। কিন্তু সেই নির্দেশনা কার্যকর হয়নি, নির্দেশনাতেই থেকে গেছে। সে কারণেই সুনির্দিষ্ট আইন দরকার, যা কার্যকর করার বাধ্যবাধকতা থাকবে এবং আইন অমান্যকারীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া যাবে। ব্রিটিশ আমলের, ১৯৪০ সালে 'মোটরযান আইন-১৯৪০' নামে একটা আইন এখনও আছে। তাতে বলা আছে—অনূর্ধ্ব-১২ বছরের জন্য গণপরিবহনের ভাড়া অর্ধেক আর অনূর্ধ্ব-৩ হলে ফ্রি। কিন্তু ১২ বছরের বেশি বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য ভাড়া বিষয়ক কোনো আইন নেই। যা প্রণয়ন করার সময় এসেছে।
একটা রাষ্ট্র যদি তার শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ সুবিধা না দেয়, শিক্ষা গ্রহণের জন্য সকল পথ যদি মসৃণ করার উদ্যোগ না নেয়, তাহলে বুঝতে হবে সেই রাষ্ট্রের পরিচালক সরকার দেশকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যে পরিণতি দেশের সকল নাগরিকের জন্যই অশনিসংকেত। ছাত্রসমাজ যদি দেশের ভয়ংকর পরিণতি ঠেকাতে উদ্যোগী হয়, তাহলে দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে এর মতো 'ভালোলাগা'র আর কী হতে পারে!
- লেখক: রাজনৈতিক কর্মী