তালেবান টিকে থাকলে কার লাভ কার ক্ষতি?
"শেষ হইয়াও হইলো না শেষ" – আফগানিস্তানের রাজনৈতিক গল্পটা অনেকটা এই বাংলা প্রবাদটির মতই। প্রথমে রাজতন্ত্র, এরপর একনায়কতন্ত্র, তারপর এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তালেবান নামক মৌলবাদী সরকার, এরপর আবার সোভিয়েত আক্রমণ, সেখান থেকে গৃহযুদ্ধের সূচনা এবং সব শেষে সন্ত্রাসবাদী অভিযানের শিকার আফগানিস্তানে ২০০১ সালে প্রবেশ ঘটে ন্যাটো বাহিনীর। এখন পর্যন্ত আফগান ভূমিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনীর উপস্থিতি থাকলেও তা এ বছরের ১১ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তার বাহিনী ফেরত নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে ন্যাটোভুক্ত অন্যান্য দেশ যেমন যুক্তরাজ্যও তার সৈন্য ফিরিয়ে নিচ্ছে। তবে এখানেও শেষ হচ্ছে না আফগানীদের দুর্দশা। যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার প্রক্রিয়া শুরু হতে না হতেই তালেবান তৎপরতা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে সেখানে যে, মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে ৩৭০ টি শহরের মধ্যে ৫০টি শহর দখল করে নিয়েছে তালেবান বাহিনী। জাতিসংঘ বলছে, তারা যেসব জেলা দখল করেছে, সেগুলো দেশটির বিভিন্ন প্রাদেশিক রাজধানীর চারপাশে অবস্থিত। অর্থাৎ, তাদের তৎপরতায় বলছে, আফগানিস্তান থেকে বিদেশী সেনা পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হলেই তারা প্রাদেশিক রাজধানীগুলো দখল করার জন্য অবস্থান নিচ্ছে।
বিদেশী সেনা চলে গেলে যে পরিস্থিতি এমন হবে সেই আভাস বিশেষজ্ঞরা প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই দিয়েছিলো। তাদের সেই ভবিষ্যৎবাণী একদম অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে চলেছে তালেবান বাহিনী। যদিও দেশটির সরকার বলছে তারা তালেবানদের প্রতিরোধে সক্ষম, কিন্তু বাস্তবে তার প্রমাণ মিলছে না। পহেলা মে থেকে যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার শুরু করেছে, আর আজ জুনের ২৬। অর্থাৎ দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে তালেবান গোষ্ঠী যে তাণ্ডব চালাতে শুরু করেছে তার পরিণতি যে আফগান সরকার এবং এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য ভয়াবহ হতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চীন ও ভারত ইতোমধ্যেই আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
২০০১ সালের ১১ ই সেপ্টেম্বর বিশ্বের ইতিহাসে এক ভয়াবহতম দিন এবং একই সঙ্গে বৈশ্বিক রাজনৈতিক ইতিহাসেরও এক "টার্নিং পয়েন্ট"। এইদিনে সন্ত্রাসবাদী আল কায়েদা গোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার ও প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দপ্তর পেন্টাগনে হামলা চালিয়ে প্রায় তিন হাজার মানুষকে হত্যা করে পুরো পৃথিবীকে এক ঘোর বিস্ময়ে ফেলে দিয়েছিলো। সেই বিস্ময়, শোক এবং ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই যুক্তরাষ্ট্র "ওয়ার অন টেরর" অর্থাৎ, "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ" ঘোষণা করে এবং এই অপারেশনের অংশ হিসেবেই আফগানিস্তানে তালেবান গোষ্ঠীকে শায়েস্তা করতে এবং এ অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদী হুমকি মোকাবেলা করতে অভিযান চালায়। এরপর কেটে গেছে দীর্ঘ বিশ বছর। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, তালেবান গোষ্ঠী আল কায়েদাকে আশ্রয় ও সমর্থন দিয়েছিলো। পরবর্তীতে তারা এর প্রমাণও পেয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ দুই দশকের এই অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র তথা ন্যাটো বাহিনী তালেবান গোষ্ঠীকে কতটা শায়েস্তা করতে পেরেছে তা গত দুইমাসে তালেবানীরা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের এতে তেমন মাথা ব্যাথা নেই। কারণ বিশ বছর আগের যুক্তরাষ্ট্রের প্রায়োরিটি লিস্ট এবং এখনকার লিস্টের মধ্যে যথেষ্ট ব্যবধান তৈরি হয়েছে। নাইন ইলেভেনের পরে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে সন্ত্রাসবাদই প্রধান হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। ফলে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সাড়াশি অভিযান চালিয়ে সন্ত্রাসবাদকে সব স্থান থেকে সমূলে উৎপাটন করতে না পারলেও নিজেদের ভূমিকে ঠিকই নিরাপদ করতে সক্ষম হয়েছে। তাই এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায়োরিটি লিস্টে সন্ত্রাসবাদ খানিকটা নিচে নেমেছে এবং প্রধান হুমকির সেই স্থানে চীন জায়গা করে নিয়েছে। আর মূলত একারণেই আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে যুক্তরাষ্ট্র অলাভজনক খাতে ব্যয় কমানোর পাশাপাশি প্রধান হুমকি চীনের উপরেও চাপ তৈরি করছে।
প্রশ্ন হতে পারে চীনের উপর কীভাবে চাপ তৈরি করছে? উত্তর মোটেই জটিল নয়। চীনের সঙ্গে আফগানিস্তানের সীমানা রয়েছে। তাই আফগানিস্তানে অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে যেসব দেশে এর "স্পিল ওভার ইফেক্ট" (Spill over effect) পড়বে তার মধ্যে চীন অন্যতম। জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলিম নির্যাতন ও সেই অঞ্চলের অস্থিরতা চীনের একটি বড় অস্বস্তির কারণ। স্পিল ওভার তত্ত্ব (Spill Over Theory) অনুযায়ী, কোনো দেশে সন্ত্রাসী তৎপরতা বৃদ্ধি পেলে বা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে তা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সন্ত্রাসী বা বিদ্রোহী দলগুলোর উপর প্রভাব ফেলতে পাতে পারে এবং তাদের তৎপরতাও বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই এদিক দিয়ে যেহেতু উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায় ও আফগানের তালেবানীদের মধ্যে ধর্মগত মিল রয়েছে, তাই নিঃসন্দেহে এটা চীনের অস্বস্তিকে আরও বাড়িয়ে দিবে।
শুধু চীনই নয় মধ্য এশিয়ার দেশগুলোও সামরিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায় পড়তে পারে। তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের সীমানা রয়েছে। সুতরাং এসব দেশেও আফগান অস্থিতিশীলতার রাডারের বাইরে নয়। এছাড়া এই দেশগুলোর সঙ্গে আফগানিস্তানের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। তাই যেকোনো ধরণের অস্থিতিশীলতা ঐ অঞ্চলের অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকেও বিঘ্নিত করবে। আর মধ্য এশিয়ায় যেকোনো ধরণের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হওয়া মানে তার একটি পরোক্ষ প্রভাব চীনের উপরে পড়বে। সেটা কীভাবে? সেটা হলো চীনে "বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ" (বিআরআই) প্রকল্প বাস্তবায়নের পথকে আরেকটু কণ্টকময় করে তোলা।
চীনের অর্থনৈতিক মাস্টার প্ল্যান বিআরআই এর বেশ কয়েকটি রাস্তা, তেল ও গ্যাস পাইপলাইন গিয়েছে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর ভিতর দিয়ে। এ অঞ্চলে বিআরআই প্রকল্পের বেশকিছু কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তাই আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ায় ঝামেলা তৈরি হওয়া মানে বিআরআই প্রকল্পের এ অঞ্চলের কার্যক্রমে বাধ-সাধার মতই হবে।
এছাড়া আফগানিস্তানের দক্ষিণে রয়েছে পাকিস্তান। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধিকাংশ স্কলার মনে করেন পাকিস্তান একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র, যেখানে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসী দল গা ঢাকা দিয়ে থেকেছে বা এখনো থাকছে। আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তানেই পাওয়া গিয়েছিলো। তাই ধারণা করা হয়, আল-কায়েদার কিছু সদস্য ইসলামিক স্টেট নামক জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়েছে এবং কিছু সদস্য এখনও পর্যন্ত আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তবর্তী অঞ্চলে লুকিয়ে আছে। পশ্চিমা বাহিনী প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গেই এইসব জঙ্গি বাহিনীর সদস্যরা যে তৎপর হয়ে উঠবে না এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। এসব জঙ্গি বাহিনী তালেবানের সঙ্গে যোগ দিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে। আবার এককভাবেও তাদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পারে। এটা অনেকটাই নির্ভর করবে তালেবান গোষ্ঠীর মর্জির উপর।
তাছাড়া এ অঞ্চলে ইসলামিক স্টেটের (ISIS) শাখা 'ইসলামিক স্টেট খোরাসানের' উপস্থিতি রয়েছে, যেটা ধীরে ধীরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং মধ্য এশিয়ার জন্য বড় ধরণের হুমকি হয়ে উঠতে পারে। তবে পশ্চিমা বিশ্ব এটাকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে না। কারণ ইসলামিক স্টেট দ্বারা তাদের আক্রান্ত হওয়ার তেমন সম্ভবনা নেই।
মোদ্দাকথা হলো, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার মাধ্যমে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করেছে। প্রথমত, আফগান অভিযান আরও দীর্ঘায়িত না করে বড় ধরণের সামরিক ব্যয় কমিয়েছে। দ্বিতীয়ত, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান চ্যালেঞ্জ চীনের উপর কিছুটা হলেও মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করতে পেরেছে। কিন্তু এখানে চীনের সঙ্গে সঙ্গে যে অন্যান্য দেশও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে এটা পশ্চিমাশক্তিকে আপাতত খুব একটা ভাবাচ্ছে না। যদি পশ্চিমা বাহিনীর অনুপস্থিতিতে এ অঞ্চলে সন্ত্রাসী কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি পায় তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে এর প্রভাব এই অঞ্চলে পড়লেও ধীরে ধীরে তা পশ্চিমাদেরও জন্যও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তবে এই মুহূর্তে আফগান পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর জন্য উত্তম হবে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে নিজেদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে আরও শক্ত করে তোলা।
- লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
- ইমেইল: [email protected]
আরও পড়ুন :