তৈরি পোশাক খাতের ওপর দীর্ঘ লকডাউনের প্রভাব
গত ২৩ জুলাই বাংলাদেশে নতুন করে লকডাউন দেওয়া হয়। এর আগে গত দেড় বছরের মহামারির ধাক্কা দ্রুত কাটিয়ে উঠছিল দেশের তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাত।
২০২০ সালের গোড়ার দিকে মহামারি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের খুচরা বাজার সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাংলাদেশের আরএমজি খাত একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ে। অনেকেই ধারণা ছিল খাতটি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহায্য ও দূরদৃষ্টি এবং জনগণের প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে বাংলাদেশের আরএমজি খাত দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ায়।
২০২০-এর এপ্রিল-মে মাসে কোভিড মহামারির শুরুতে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প কিছুদিন বন্ধ থাকে। তারপর খুলে দেওয়া হয় সব গার্মেন্ট কারখানা। গত ১৪ মাস মহামারির মধ্যেও সফলভাবে কাজ চালিয়ে গেছে সবকটি কারখানা। কঠোর স্বাস্থ্যবিধি, নিরাপত্তা প্রটোকল ও নিয়মকানুন মেনে কাজ করায় এ সময়ে শ্রমিকদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার মাত্র ১ শতাংশ।
গত কয়েক বছরে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উন্নতি, নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল কাজের পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, টেকসই উৎপাদন ও সবুজ বিপ্লবের মতো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি এসেছে আরএমজি খাতে। এর ফলে প্রতি বছর রপ্তানি বেড়েছে; সেইসঙ্গে দেশের অর্থনীতিতে খাতটির অবদানও বেড়েছে।
আমাদের অগ্রগতি এবং উন্নয়ন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে। প্রশংসা কুড়িয়েছে সারা বিশ্বে।
কিউআইএমএ (হংকংভিত্তিক কোয়ালিটি কন্ট্রোল সাপ্লাই চেইন অডিটস)-এর ২০২০ সালের কিউ২ ব্যারোমিটার প্রতিবেদনে নৈতিক উৎপাদনে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছে।
এই স্বীকৃতির জন্য মূল যেকটি মানদণ্ড পূরণ করতে হয়, সেগুলোর কয়েকটি হলো—স্বাস্থ্যবিধি, স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, শিশু ও তরুণ শ্রম, শ্রমচর্চা, বলপূর্বক শ্রমের অন্তর্ভুক্তি, শ্রমিকের প্রতিনিধিত্ব, শৃঙ্খলার চর্চা ও বৈষম্য এবং কাজের সময় ও মজুরি।
মানদণ্ডগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবং এই মানদণ্ডগুলো অর্জন করতে পেরে গোটা জাতি ও তৈরি পোশাক খাত অত্যন্ত গর্বিত।
বিজিএমইএ এক সংবাদ সম্মেলনে নৈতিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে আরএমজি খাতের দুর্দান্ত অর্জনের কথা জানিয়ে বিনীত ও সুস্পষ্ট ভাষায় বর্তমান অর্জনগুলো ধরে রাখার এবং এসব বিভাগে ধারাবাহিক উন্নতি করার প্রয়োজনীয়তা জানিয়েছে।
পরিবেশগত স্থায়িত্বের দিক থেকে দেখলে, সবুজ শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশি পোশাক কারখানাগুলো বিশ্বে নেতৃস্থানীয়।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সবুজ কারখানা রয়েছে। আমাদের দেশের ১৪৩টি কারখানা ইউএসজিবিসি-র লিড (LEED) সনদপ্রাপ্ত। এর মধ্যে ৪১টি কারখানা প্লাটিনাম রেটিংপ্রাপ্ত এবং ৮৯টি কারখানা গোল্ড রেটিংপ্রাপ্ত।
এছাড়াও আরও পাঁচ শতাধিক পোশাক কারখানা লিড সনদপ্রাপ্ত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
এই খাতটির কঠোর ও নিরলস সাধনার স্বীকৃতি হিসেবে ইউএসজিবিসি বিজিএমইএকে '২০২১ লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড'-এ ভূষিত করেছে।
শিল্প পর্যায়ে পরিবেশগত স্থায়িত্ব অর্জনের লক্ষ্যে ইউএনএফসিসিসি, জার্মান গ্রিন বাটন উদ্যোগ এবং জিএফএর সঙ্গে একটি সার্কুলার ফ্যাশন প্রকল্পেও যোগ দিয়েছে বিজিএমইএ।
সামগ্রিকভাবে, 'মেড ইন বাংলাদেশ'-এর ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়ছিল। বৈশ্বিক আরএমজি বাজারে নিজের অংশগ্রহণ বাড়ানোর অবস্থানে চলে গিয়েছিল বাংলাদেশ।
সুরক্ষা ও স্থায়িত্বের মানদণ্ড অর্জনের সাথে সাথে বাংলাদেশ খুচরা বিক্রেতা ও বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছে। বিক্রেতা ও নামীদামি ব্র্যান্ডগুলোর মনে আস্থা জন্মেছিল, বাংলাদেশ এমন এক দেশ যেখানে কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই পণ্য উৎপাদন করা যায়।
কঠোর নিয়মকানুন ও নিরাপত্তা প্রটোকল মেনে গত ১৪ মাস ধরে পোশাক শিল্পকে উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এ সময়ে আরএমজি খাতে কোভিড সংক্রমণের হার ছিল ১ শতাংশেরও কম।
এ সময় কোভিডের ডেল্টা ধরনের প্রকোপে ভারতের তৈরি পোশাক খাতের কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মিয়ানমারের পোশাক উৎপাদনও ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয় এ সময়।
পশ্চিমা বিশ্বে পোশাকের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ফলে দক্ষতার সাথে অতি দ্রুত ও সময়মতো পণ্য সরবরাহ করার সক্ষমতা থাকায় পশ্চিমের তৈরি পোশাক ক্রেতাদের নির্ভরযোগ্য গন্তব্য হয়ে ওঠে বাংলাদেশ।
গণটিকাদানের সুবাদে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ উভয় অঞ্চলেই সব দোকানপাট ও কর্মস্থল খুলে দেওয়া হয়। ফলে লোকজনের বাইরে যাতায়াত ও কাপড় কেনাকাটা বেড়ে যায়।
খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো এত জলদি এত বেশি চাহিদা সৃষ্টি হওয়ার কথা ভাবতে পারেনি। বিক্রেতাদের যেহেতু ২০২১-এর বসন্ত ও গ্রীষ্মে খুব বেশি মজুদ রাখার পরিকল্পনায় ছিল না, তাই দোকানে পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয়।
এসময় বাংলাদেশের পোশাক কারখানা খোলা ছিল, অর্ডারের তেমন চাপও ছিল না তাদের ওপর। তাই আরএমজি শিল্প প্রচুর 'চেজ' বা 'স্পট অর্ডার' পেতে থাকে। স্পট অর্ডার হচ্ছে চলতি অর্ডারের সঙ্গে বাড়তি অর্ডার যোগ করা।
এ কারণে ২০২০ (কোভিডকাল) ও ২০১৯ (কোভিডপূর্ব)-এর তুলনায় এ বছরের মে ও জুনে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে।
পশ্চিমা বাজারে খুচরা বিক্রি বাড়ছে দেখে খুচরা বিক্রেতা ও ক্রেতারা তাদের ছুটির মৌসুমে (পশ্চিমা বিশ্বে নভেম্বর-জানুয়ারি) বড় অর্ডার দেওয়ার পরিকল্পনা শুরু করে।
কেবল মে ও জুনেই যুক্তরাষ্ট্রে পোশাকের খুচরা বিক্রি ২.৬ শতাংশ বেড়েছে এবং এই বিক্রি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ওভেন, নিট ও সোয়েটার কারখানাগুলোসহ আরএমজি কারখানাগুলো—যেগুলো এই মুহূর্তে পশ্চিমা 'ছুটির মৌসুমে'র জন্য উৎপাদন করছে—২০২০ সালের চেয়ে অনেক বেশি অর্ডার পেয়েছিল। কোভিডপূর্ব সময়ে যে অর্ডার পেত, সেই পরিমাণ অর্ডার পেয়েছে কারখানাগুলো।
সদ্য উৎপাদিত ছুটির মৌসুমের অর্ডারগুলো যখন সবে সরবরাহ করা শুরু হয়েছে, ঠিক তখনই দীর্ঘ অপরিকল্পিত লকডাউনের ধাক্কা খেল পোশাকশিল্প।
কোনো রকমের পূর্বঘোষণা ছাড়াই লকডাউন দেওয়া হয়েছে। ফলে কোনো বিকল্প পরিকল্পনা তৈরি করার সময়ও পায়নি আরএমজি শিল্প। তাছাড়া পোশাক শিল্পের কারণে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের হার বেড়েছে, এমন কোনো ইঙ্গিত বা তথ্যও নেই।
প্রকৃতপক্ষে শৃঙ্খলা ও নিয়মকানুন মেনে চলার কারণে এ শিল্পে সংক্রমণের হার ন্যূনতম ছিল।
কাজেই ঠিক কী কারণে সরকার দীর্ঘ শাটডাউনের সময় আরএমজি খাতকেও বন্ধ রেখেছে, তা অনেক অর্থনীতিবিদ, চিকিৎসক এবং আরএমজি শিল্প বিশেষজ্ঞদের কাছে এক রহস্য।
২৩ জুলাই থেকে আরোপ করা দীর্ঘ লকডাউনের আগে গার্মেন্টস খাতে সফলভাবে অত্যন্ত সাহসী ও আগ্রাসী টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছিল।
১৮ জুলাই গাজীপুরে কর্মচারী আইডি ও জাতীয় পরিচয়পত্রভিত্তিক স্পট রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে তিনটি বৃহৎ পোশাক কারখানার ১২ হাজার কর্মীকে সফলভাবে টিকা দেওয়া হয়। পরের দিনও একই পদ্ধতিতে আরও ১৭ হাজার আরএমজি কর্মীকে সফলভাবে টিকা দেওয়া হয়। এ কাজে সহায়তা করে কেয়ার বাংলাদেশ এবং বাছাই করা প্রশিক্ষিত আরএমজি কারখানার চিকিৎসা ও এইচআর কর্মীরা।
সরকার পোশাক কারখানাগুলোকে প্রয়োজনীয় টিকা সরবরাহে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। তবে পুরো আরএমজি খাতকে গণটিকার আওতায় আনতে টিকার মজুদ থাকাটাই মূল সমস্যা।
কারখানাগুলোতে টিকাদান ও সাধারণ টিকাদান কর্মসূচির সাফল্য এবং অ্যাপ ও ওয়েবভিত্তিক নিবন্ধন প্রক্রিয়ার সাফল্যের ভিত্তিতে আমাদের বিশ্বাস, যথেষ্ট পরিমাণ টিকা থাকলে সব মানুষকে সফলভাবে টিকা দেওয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে।
দেশে যেহেতু টিকার মজুদ রয়েছে এবং প্রতিদিনই টিকা আসছে, সেজন্য দীর্ঘ লকডাউনের পরিবর্তে দেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের গণটিকাদানের আওতায় আনা উচিত।
পোশাক কারখানাগুলো দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ করে না দিয়ে কোভিডের বিস্তার রোধের জন্য উচিত ছিল স্থানীয় সরকারের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এবং আরএমজি খাতের বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিয়ে টিকাদানের পথ বেছে নেওয়া।
বাংলাদেশের মোট রপ্তানিতে তৈরি পোশাক খাতের অবদান ৮৪ শতাংশ। এই খাতটি গত ১৪ মাস ধরে মহামারির মধ্যেও টেকসই উৎপাদন ও সময়মতো পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে ক্রেতাদের মনে যে আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করেছিল, তা মুছে যাবে এই আকস্মিক লকডাউনের কারণে।
২০১৯-২০২০ সালে আরএমজি খাতের রপ্তানি ঘাটতি ছিল ৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২০২১ সালে খাতটি সেই ঘাটতি কাটিয়ে উঠছিল। এমনকি কোভিড মহামারির মধ্যেও কয়েক বিলিয়ন ডলার বাড়তি রপ্তানি আয় হতো। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া বিরাট ধাক্কা খেল হঠাৎ দেওয়া লকডাউনের কারণে।
কারখানাগুলো খোলা রাখার সুযোগ পেলে পোশাকশিল্প ও দেশের অর্থনীতি যেমন উপকৃত হতো, তার পাশাপাশি উপকৃত হতো জীবন নির্বাহের জন্য এ শিল্পের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল লক্ষ লক্ষ মানুষ।
তবে পোশাক কারখানাগুলো অবিলম্বে ২০২০ সালের মতো পর্যায়ক্রমে খুলে দিলে এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যাবে।
এ দেশের আরএমজি খাত আগেও সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দৃঢ়তা দেখিয়েছে। আমি নিশ্চিত, এবারও এ খাত আগের মতোই দৃঢ়ভাবে সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে। মহামারিকালে দেশের আরএমজি কারখানাগুলো সমস্ত নিয়মকানুন ও শৃঙ্খলা বজায় রেখে এবং কোভিড-১৯-এর সমস্ত প্রটোকল মেনে কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। আমি নিশ্চিত, কারখানাগুলো এবারও তা করতে পারবে।
নিয়মকানুন কঠোরভাবে মেনে চলার সঙ্গে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশের সমস্ত পোশাক শ্রমিককে—প্রায় ৪৪ লক্ষ—টিকার আওতায় আনার লক্ষ্যে গণটিকা কর্মসূচি শুরু করা উচিত।
এর ফলে বিশ্ববাসী যেমন জোর বার্তা পাবে, আমাদের পোশাক খাতও ফিরে পাবে ক্রেতাদের আস্থা।
কারখানাগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন অব্যাহত রাখার একমাত্র উপায় হলো পোশাক কর্মীদের গণটিকাদানের আওতায় আনা। কারখানায় উৎপাদন অব্যাহত থাকলে অন্ন সংস্থান হবে এ খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত লক্ষ লক্ষ মানুষের।
ঈদের ছুটির সঙ্গে লকডাউন মিলিয়ে প্রায় ১৯ দিন বন্ধ থাকবে পোশাক কারখানা। এর ফলে আরএমজি খাত এক থেকে ৩ বিলিয়ন ডলারের মতো রপ্তানি আয় হারাবে। পরিণতিতে বিরাট লোকসানে পড়বে খাতটি।
আরএমজি খাত নিয়ে তাই নতুনভাবে ভাবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। সেই ভাবনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত টিকার ওপর।