নদী ও জীবন
মুসলিম বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক 'ইবন আল নাফিস'তার জীবদ্দশায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক শাখায় বিচরণ করছেন। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানে তার অবদান, তাকে করেছে বিশ্ববিখ্যাত।
১২১৩ সালে সিরিয়ার দামেস্কে জম্মগ্রহনকারী এ বিজ্ঞানীর আবিষ্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানের সমস্ত ধ্যানধারণা পরিবর্তন করে দেয়। ২০০ খৃষ্টপূর্ব থেকে গ্রীক বিজ্ঞানী গালেন- এর তত্ত্বই ছিল এনাটমি বা শরীরবিদ্যার একমাত্র প্রতিষ্ঠিত বিশ্লেষণ, এবং তার উপর ভিত্তি করেই চিকিৎসা করা হতো।
গালেন বলেছিলেন, রক্তনালী দিয়ে রক্ত এসে হৃৎপিণ্ডের ডান কোঠরে ঢুকে, সেখান থেকে সূক্ষ্ম জালির দেয়াল দিয়ে বাম কুঠুরীতে প্রবেশ করে, এবং স্পিরিট বা শক্তি সংগ্রহ করে। রক্ত সঞ্চালন এবং পরিশোধনের সাথে ফুসফুসের ভূমিকা সম্পর্কে কোন ধারণা তিনি দিতে পারেননি এবং পরবর্তী প্রায় হাজার দেড়েক বছর এই ভ্রান্তির উপরে ভর করেই চলছিল চিকিৎসা শাস্ত্র।
ইবন নাফিস প্রথম এই ভুল ধারণা সংশোধন করেন। তিনিই প্রথম ব্যখ্যা করেন কিভাবে রক্ত হৃৎপিণ্ডে আসে, সেখান থেকে ফুসফুস, পরে আবার হৃৎপিণ্ডে হয়ে সারা দেহে সঞ্চালিত হয়। আর এর সাথেই ঘটে শরীরবৃত্তীয় চিন্তাধারায় যুগান্তকারী পরিবর্তন, শুরু হয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের আধুনিক অধ্যায়।
এ ইতিহাস তুলে ধরার কারণ; রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতি সমন্ধে সঠিক ধারণা পাবার আগপর্যন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রায় স্থবির হয়েই ছিল, আর ছিল পথভ্রষ্ট।
মানবদেহে রক্ত সঞ্চালন অনেকটা যোগাযোগ ব্যবস্থার মত। পাকস্থলীতে খাবার বা জ্বালানি পরিশোধিত করা হয়। দেহ কোষ সে জ্বালানি পুড়িয়ে শক্তি উৎপাদন করে। জ্বালানি পোড়ানোর জন্য অক্সিজেনের প্রয়োজন পরে। কিন্তু সে অক্সিজেন আসে ফুসফুসে।
দেহের পাওয়ার হাউজ বা শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র হচ্ছে দেহ কোষ। কিন্তু, পাওয়ার প্লান্টে জ্বালানি নিয়ে আসা এবং সে জ্বালানি পোড়ানোর জন্য অক্সিজেন কোষে কোষে পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া।
পৃথিবীর জলবায়ু আবহাওয়া এবং সামগ্রিক জীবজগৎ ও এমন একটি সঞ্চালন চক্রের উপর নির্ভরশীল। সাগরের পানি বাষ্পীভূত হয়ে উর্ধ্বাকাশে গিয়ে মেঘ হিসেবে জমা হয়। সেই মেঘ বাতাসের টানে গিয়ে পর্বতমালার সংস্পর্শে এসে বৃষ্টি হিসেবে পতিত হয়। সে বৃষ্টির পানি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসে নদী রূপে, আর সে নদী আবার পানি নিয়ে যায় সাগরের মোহনায়।
সুজলা-সুফলা এই ধরনীতে নদী হল অনেকটা রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতির মতো। এই নদীর মাধ্যমেই বিস্তৃত স্থলভাগে ছড়িয়ে পড়ে পানি, যার অপর নাম জীবন। পৃথিবীর ভূভাগের যে সব অঞ্চলে নদনদীর আধিক্য, সেখানে জীবনেরও আধিক্য। বাংলাদেশ এমনই একটি অঞ্চল, যেখানে প্রতিটি কোণে কোণে রয়েছে নদী, ছড়িয়ে দিচ্ছে সঞ্জীবনী ধারা।
আমরা সৌভাগ্যবান যে, সৃষ্টিকর্তা মুক্তহস্তে 'পানি' অর্থাৎ জীবণের প্রধানতম উৎস দান করেছেন।
আবার গালেনের তত্ত্বে ফিরে যাই। ইউরোপীয় মধ্যযুগ পর্যন্ত রক্তসঞ্চালনের ভুল তত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে ছিল চিকিৎসা বিজ্ঞান, আর তাই বিজ্ঞানের এ ক্ষেত্রে তেমন কোন উন্নতিও হয়নি।
তেমনি নদনদী জলভাগ সম্পর্কে আমাদের ধারণা যতদিন স্পষ্ট না হবে, ততদিন স্রষ্টার এ মুল্যবান উপহারটির অপব্যবহার হবে, তথা; জনজীবন, জলবায়ু পরিবেশ হবে অসুস্থ।
সেই প্রাচীন যুগ থেকেই নাবিকরা সমুদ্রপথে ভ্রমনের বর্ণনা লিখে রাখত পরবর্তী প্রজন্মের জন্য, তাকে বলা হতো সেইলিং ডাইরেকশন। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা এর পেশাদার সংকলন করে। ফলশ্রুতিতে; পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্রগামী জাহাজে সেইলিং ডাইরেকশন বহন করা বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ এডমিরালটি এটি ছাপায়। পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি উপকূলীয় দেশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং উপকূলের জলভাগ সমন্ধে বিষদ বর্ণনা থাকে এই বইটিতে।
বাংলাদেশ সমন্ধেও বইটিতে একটি বর্ণনা রয়েছে- "সারা বছর নৌপরিবহনের উপযোগী নদনদীর কারণে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার বিচারে দেশটি চরম সুবিধাজনক পর্যায়ে রয়েছে।"
কিন্তু, আমাদের দেশের অনেকের কাছেই এমন একটি বক্তব্য হাস্যকর মনে হবে। বরিশালসহ দক্ষিনাঞ্চলের অনেকের কাছে নদী অভিশাপ, কারন অসংখ্য নদী-খালের জন্য সেখানে সড়ক যোগাযোগ তৈরী হয়নি উঁচু এলাকার মত, সেখানে নদী কিভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য আশীর্বাদ হতে পারে?
১৯৯৪ সালে ইংলিশ চ্যানেলের নীচ দিয়ে তৈরি হয় টানেল, সে যুগে যা ছিল এক প্রযুক্তির বিস্ময়। তখন মনে করা হতো; টানেল তৈরি করার পরপরই বন্ধ হয়ে যাবে ব্রিটেনের সাথে ইউরোপের সব ফেরি চলাচল।
অবাক ব্যাপার হলো; বিগত ২৭ বছরেও টানেল তার যাত্রী এবং যানবাহন পরিবহনে ফেরিকে অতিক্রম করতে পারে নি। এমন নয় যে, টানেল আর যানবাহনের চাপ নিতে পারছে না। আসলে এখনও টানেলটির সক্ষমতার ৫০ শতাংশ অব্যবহৃত, কারণ সিংহভাগ মানুষ ফেরিতে ভ্রমণ করতে বেশি পছন্দ করে।
এসব যাত্রীরা কিন্তু দরিদ্র জনসাধারণ নয় যে, স্বল্প পয়সার ডেকে বিছানা পেতে বাড়ি যাবে। এরা সবাই দামী গাড়ি নিয়েই ফেরিতে চড়ে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যস্ততম রুট হচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-কক্সবাজার। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এবং চাহিদা অনুযায়ী সড়ক এক লেন থেকে আট লেনে পরিণত হয়েছে, কিন্তু যাতায়াতের সময়ে কোন পরিবর্তন হয়নি। রাস্তা বড় হয়েছে, ট্রাফিক বেড়েছে, যানজট বেড়েছে।
আমরা এখনও চট্টগ্রাম যেতে সাত আট ঘন্টা সময় ব্যয় করি, কক্সবাজার যেতে ১০-১২ ঘন্টা। কিন্তু, চট্টগ্রামের দূরত্ব ২৫০ কি.মি আর কক্সবাজারের ৪০০ কি. মি। নৌপথের দূরত্বও প্রায় একই রকম। সড়কপথ উন্নয়নে হাজার কোটি নয়, লাখ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, কিন্তু নৌপথ সৃষ্টিকর্তা কিংবা প্রকৃতি তৈরি করে রেখেছিল হাজার লাখো বছর আগে থেকে।
নৌপথ ব্যবহারের জন্য কোন জমি অধিগ্রহণ কিংবা সড়ক নির্মাণের প্রয়োজন ছিল না, ছিল শুধুই কিছু আধুনিক যানবাহন এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। একটি আধুনিক নৌযান খুব আয়েশে ঘন্টা দশেকের মধ্যে আপনাকে কক্সবাজার নিয়ে যেতে পারে। শুধু আপনাকে নয়, আপনার গাড়িকেও সাথে নিয়ে যাবে, যেভাবে ব্রিটেন থেকে ইউরোপের দেশগুলোতে মানুষ গাড়ি নিয়ে ফেরিতে চড়ে যায়। ঢাকা থেকে গ্রিনলাইন ও সোহাগের মত বড় পরিবহনগুলো সারাদিনে যতগুলো বাস ছাড়ে, একটি বড় ফেরি সব বাসের যাত্রী এক সাথে নিয়ে যেতে পারে। আপনি যেখানে স্বচ্ছন্দে আর প্রকৃতির সৌন্দর্যের সাথে নির্মল বাতাসে শ্বাস নেওয়ার আনন্দ নিতে নিতে ভ্রমণ করতে পারবেন।
কিন্তু, সুন্দর নদী থাকার পরও আমরা সড়কের লেন বাড়িয়ে যাচ্ছি। ২০১৯ সালের বরাদ্দ অনুযায়ী ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের প্রতিবছর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ২০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। এই ২০০ কোটি টাকা যদি আধুনিক নৌযানের পেছনে ব্যয় করা হলে অনেক স্বচ্ছন্দে এবং স্বল্প খরচে মানুষ যাতায়াত করতে পারত।
আমাদের দেশের মতো এমন আত্মঘাতী যোগাযোগ ব্যবস্থা অন্য কোথাও আছে কিনা- তা আমার জানা নেই।
আবার ফিরে আসি রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়ায়। সুস্থ দেহের জন্য দুটি বিষয় খুবই জরুরি, পরিষ্কার রক্ত এবং জটমুক্ত রক্তনালী। তাই আমরা অসুস্থ হলেই প্রথমে রক্ত পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়। রক্ত পরীক্ষা করে দেখা হয় যে, তাতে আবর্জনা মানে যা থাকার কথা নয়, তা কতটুকু রয়েছে।
এখন যদি প্রশ্ন করা হয় , পৃথিবীতে কোন রোগটি সবচেয়ে ভয়াবহ? অধিকাংশে একবাক্যে বলবেন; কোভিড, কোভিড, কোভিড! তাই কি?
এ ধারণা সম্পুর্ণ ভুল।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু বা ১৬ শতাংশ মানুষ মারা যায় ইস্কেমিক বা রক্তসঞ্চালন সম্পর্কিত জটিলতায়। ১১ শতাংশ নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে স্ট্রোক। তৃতীয় অবস্থানে ক্রনিক রক্তসঞ্চালন ব্যাহত বা Chronic obstructive pulmonary disease, যা ৬ শতাংশ মৃত্যুর কারণ। তাই বলতে গেলে, ৩৩ শতাংশ বা এক-তৃতীয়াংশ মৃত্যুর কারণ সরাসরি রক্তসঞ্চালন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত।
এবার সামগ্রিক জীবন সঞ্চালন বা নদী বিষয়ে ফিরে আসি। আমাদের নদীর পানি ভাল, কিন্তু যায়গায় যায়গায় আমরা নদীতে বাধ দিয়ে বা সেতু তৈরি করে ব্লক সৃষ্টি করেছি। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করার পরেও একদিন হার্ট এটাক করবে কারণ আমরা নিজেরাই নদী বা রক্তনালী সংকুচিত করেছি।
ধরে নেওয়া যাক, যুগের তাগিদে এবং অজ্ঞানতার কারণেই আমরা আমাদের ধমনী সংকোচিত করে ফেলেছি, অনেক ব্লক তৈরি করে ফেলেছি- যা এখন আর নির্মূল করা সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে আমরা কী করব? এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসক আমাদের অনেক বিধিনিষেধ মানতে বলবেন। যেমন; রেডমিট খাবেন না, কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার খাবেন না, ধুমপান করবেন না, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
এসব মেনে চললে, যতটুকু ব্লক আছে- তা সহনীয় অবস্থায় থাকবে।
এক্ষেত্রে নদীর ব্যাপারে আমরা কি করছি?
শহরাঞ্চলের মোটামুটি সব ছোটখাট খাল আমরা বন্ধ করে দিয়েছি উন্নয়নের নামে। ঢাকা শহরে ধোলাইখাল এখন একটি জায়গার নাম, খালের নয়। সারাদেশে এরকম উদাহরণ অগুণিত। এখন ধরে নিলাম আর কোন ব্লক আমরা করবো না। কিন্তু তারপরেও আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে আমাদের রক্তপ্রবাহ যাতে নির্মল থাকে।
আমরা হাজারীবাগের ট্যানারী সাভার নিয়ে গিয়েছি, যদিও ইটিপি বা পানি পরিশোধনের ব্যবস্থা কতোটা করতে পেরেছে আমি জানি না, এবং জনসাধারণও জানে না। পৃথিবীব্যাপী নদীর তীরেই গড়ে উঠে সব শিল্প কারখানা, বাংলাদেশেও তাই। এসব শিল্পকারখানার বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা হচ্ছে, ধীরে ধীরে হয়ত আরও কঠিন নীতিমালা দিয়ে আরও পরিশুদ্ধ করা হবে। কিন্তু এখানেই কি শেষ?
আমদের দেশ এখনও শিল্পায়নের কৈশোরে। শিল্প কারখানা থেকে অনেক অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে এসে মিশছে, কিন্তু আমাদের দেশে নৌপথের সবচয়ে বড় শত্রু শিল্প কারখানা নয়। আমাদের বড় শত্রু নৌযান।
আমাদের নৌযানের মান প্রাগৈতিহাসিক যুগের, কিন্তু সংখ্যার বিচারে বা অভ্যন্তরীণ নৌযানের সংখ্যায় নাকি চীনের পর আমরা দ্বিতীয় অবস্থানে।
লাখো ডিঙ্গি নৌকা একটি শ্যালো ইন্জিন লাগিয়ে যন্ত্রচালিত নৌযানে পরিণত হয়েছে। একটি নৌযানে যখন ইঞ্জিন ব্যবহৃত হয়, একই সাথে সে তিনটি দূষণের কারণ হয়ে দাড়ায়; শব্দ, বায়ু এবং পানি। ডিজেল ইঞ্জিনের উৎকট শব্দের সাথে কালো ধোঁয়া। আর ইঞ্জিন থেকে বের হওয়া তেলের পানিতে মিশ্রণ।
আমাদের ট্যানারি ছিল হাজারীবাগে। সবাই অপবাদ দিত যে বুড়িগঙ্গা দুষণের বড় কারণ ট্যানারি। আমাদের পরিবেশবিদ, সাংবাদিক, সুশীল সমাজ, সবার বসবাস ঢাকা শহরে, সুতরাং তাদের চিন্তাভাবনা ঢাকা শহর কেন্দ্রিক।
তাদের পর্যবেক্ষণ; বুড়িগঙ্গা নদীর পানি কেন খারাপ? কে দোষী? অবশ্যই ট্যানারি।
আমাদের পরিবেশবিদরা চায়ের আড্ডায় বসেই পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করেন, ফলে তাদের পর্যবেক্ষণ কুয়োর ব্যাঙের চেয়ে বেশি কিছু হয় না।
তারা যদি একবার নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যার পাড়ে যেতেন, তাহলে অন্তত ভাবতেন, ট্যানারিটা কোথায়?
শীতলক্ষ্যার সবচেয়ে দূষিত এলাকা নারায়ণগঞ্জ শহরের পাশে। এরপর যতই উত্তরে উজানের দিকে যাওয়া হবে, পানি হবে ততই পরিস্কার। নারায়ণগঞ্জের আসেপাশে জাহাজের আধিক্য বেশী, রয়েছে অনেক ডকইয়ার্ড, সাথে বোনাস হিসেবে পানি দূষণ।
নৌ ম্যাজিসট্রেটরা মাঝে মাঝে অভিযান চালান, বালুবাহী জাহাজ কিংবা কার্গো-জাহাজের জরিমানা করেন কাগজপত্র না থাকলে এবং সেখানেই সব শেষ।
আর পরিবেশ? পরিবেশ কাহাকে বলে? আপনার জাহাজে বা লঞ্চে যে তেল মিশ্রিত পানি জমা হয়, তা কোথায় ফেলেন? না, এসব কোন ব্যাপারই নয়! জাহাজের কাগজপত্র থাকলেই চলবে।
ধারণ ক্ষমতা ১০০০ টনের বেশি, পৃথিবীতে এমন জাহাজের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৫৬,০০০। কিন্তু, এই ছাপ্পান্ন হাজার জাহাজ সম্মিলিতভাবে পাঁচটি মহাসাগরে যতটা পানি দূষণ করে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌযানগুলো সম্মিলিতভাবে তার চেয়ে অনেক বেশি দূষণ করে।
মহাসমুদ্রের মাঝখানে চলাচলের সময়ও জাহাজের ইঞ্জিনরুম থেকে যে পানি ফিল্টার করে বাইরে ফেলা হয়, তাতে মাত্র ১৫ পিপিএম তেল থাকতে পারে; মানে এক বালতিতে এক ফোটা সম-পরিমাণ। বন্দরে তো দূরের কথা, উপকূলীয় এলাকাতেই কোন পানি বাইরে ফেলা নিষিদ্ধ।
কিন্তু, আমাদের নদীর মধ্যে ছোট বড় যে হাজার হাজার নৌযান চলছে, তারা নিশ্চিন্তে তেল মিশ্রিত পানি ফেলে যাচ্ছে অবিরত।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নদীর এক নীরব ঘাতক হচ্ছে মানুষ, মানে যাত্রী। ইউনাইটেড নেশনস ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক- ইউনিস্কেপের দেওয়া তথ্যানুযায়ী শুধু ঢাকা, বরিশাল, ভোলা, নারায়ণগঞ্জ বন্দর থেকেই প্রতিদিন প্রায় এক লাখ যাত্রী চলাচল করে, আর সারা দেশে সর্বমোট তিন লাখ যাত্রী নৌপরিবহন ব্যবহার করে।
লঞ্চ যাত্রা দীর্ঘ হবার কারণে এসব যাত্রীদের অধিকাংশই যাত্রাপথে মলমুত্র ত্যাগ করে। প্রতিদিন প্রায় লাখ দেড়েক মানব বর্জ্য গিয়ে মিশ্রিত হয় মাত্র দেড়-দুইশ কিলোমিটার দীর্ঘ ব্যস্ত নৌপথে।
আমাদের গতানুগতিক ধারণা, এসব মলমূত্রের মাধ্যমে নানাবিধ অনুজীব ছড়িয়ে পরে এবং পানিবাহিত রোগের কারণ ঘটে। কিন্তু, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কখনোই আলোচনায় আসে না। যাত্রীবাহী লঞ্চ থেকে সরাসরি যেসব মলমুত্র পানিতে গিয়ে মিশছে, তা ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ডিকমপোজড হয় বা পচে যায়। কিন্তু, ডিকমপোজ করার জন্য ব্যাকটেরিয়ার প্রয়োজন হয় অক্সিজেন; যা সে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন থেকে গ্রহণ করে। যার ফলশ্রুতিতে অক্সিজেন পানিতে স্বল্পতার সৃষ্টি হয়।
এছাড়াও, এসব মলমূত্র মিশ্রিত পানিতে শৈবালের দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটায়, যাকে বলা হয় অ্যালগাল ব্লুম। শৈবালের অতিরিক্ত বংশবৃদ্ধি পানির স্বচ্ছতা কমিয়ে দেয়। ফলে, সূর্যের আলো পানির খুব গভীরে প্রবেশ করতে পারেনা। এছাড়া, শৈবালও পানির অক্সিজেন টেনে নেয়। মৃত শৈবাল তলদেশে জমা হয়। আবার, এসব শৈবালকে ডিকমপোজ করার জন্য ব্যাকটেরিয়া শুষে নেয় আরও অক্সিজেন। পানির অক্সিজেন শূন্যতা জলজ জীবজগতের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এর কারণে হারিয়ে যাবে অনেক প্রকার মাছ এবং জলজ প্রানী, নিশ্চিহ্ন হবে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় প্লাংকটন।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। কিন্তু দুখজনক হলেও সত্যি যে, আমরা একই সাথে নদী এবং নদীর পানিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছি প্রতিনিয়ত। আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে, হৃদরোগে মানুষ ধীরে ধীরে মরে না, হঠাৎ একদিন পটল তোলে।
নদী সংকোচন এবং পানি দূষণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে যে রোগ তৈরি করছি, তাতে হঠাৎ একদিন প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটবে, যেখান থেকে হয়ত ফিরে আসা সম্ভব হবে না।
- লেখক: নৌ কর্মকর্তা