নারী কৃষিশ্রমিক কি অধিকার, মর্যাদা ও স্বাস্থ্য সুবিধার বাইরে থাকা শুধুই ঘরের বউ?
যমুনা সেতু পার হওয়ার পর থেকেই দেখতে পাওয়া যায় পথের দু'পাশে জমিতে অনেক নারী কৃষি শ্রমিক কাজ করছেন। বীজ বপণ, ধান কাটা, মাড়াই এবং এমনকি জমিতে হাল দিতেও দেখা যায়। চাতালেও কাজ করছেন অনেকে। তামাক ক্ষেতেও নারীরা সক্রিয়। গত বছর গ্রামে যাওয়ার সময় মনে হলো, কৃষকের চেয়ে কৃষাণীর সংখ্যাই বেশি।
রংপুরের পীরগঞ্জে একটি চাতালে কাজ করেন মারুফা। সারাদিন থাকার পর, সিজন থাকলে তাদের মাঝেমধ্যে রাতেও সেখানে থাকতে হয়। রাতে যে তারা থাকেন, এর জন্য যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে কি না, জানতে চাইলে বললেন, 'সেইটা কোনো সোমোস্যা নোহায়। অনেকে একসাথোত থাকি। সোব্বায় সোব্বাক চিনে।'
তাহলে কোনো সমস্যা হয় না বলতে চাচ্ছেন? "হয় তো। কিন্তু আইতোত হয় না, হয় দিনোত। হামার তানে নাই কোনো পায়খানা-প্রশ্রাবখানা।" তাই তারা প্রায় সারা দিন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে পারেন না। রাতে একটু দূরে গিয়ে একজনের বাড়িতে 'কাজ' সারেন। ডিউটির সময় তা করা যায় না।
গ্রামে যারা জমিতে কাজ করেন, তাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। দূরে বাড়িতে গিয়ে এই কাজ করা যায় না বলে তারা প্রায় আটকে রাখেন। অনেকেই বিচ্ছিন্নভাবে এই কৃষি শ্রমিকদের টয়লেট সুবিধার কথা তুলেছেন, কিন্তু বিষয়টি মালিকরা ভাবেনই না।
বাংলাদেশে মোট ৫ কোটি ৬৭ লাখ কর্মজীবী মানুষের মধ্যে শতকরা ৪৭.৬ জন কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। আবার এদের মধ্যে শতকরা ৬৪.৮ জন নারী। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীরা জমির মালিক নন। তাই তদারকির দায়িত্বে নয়, বরং তাদের কাজ করতে দেখা যায় জমিতে।
এই যে এত সংখ্যক নারী কৃষি শ্রমিক সকাল থেকে রাত পর্যন্ত জমিতে কাজ করেন, কিন্তু তাদের জন্য কোনো শৌচাগার ব্যবস্থা নাই।
কেন নাই? কারণ নারীর এই কৃষি কাজটাকে একদিকে যেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে করে না সমাজ, অন্যদিকে নারীর একান্ত স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়গুলোও এখনো আমাদের কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।
সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, কৃষিতে মজুরিযুক্ত কাজে নারীর সংখ্যা মাত্র শতকরা ১৫ ভাগের কাছাকাছি। গবাদিপশুর লালন পালন ও খাদ্যশস্য উৎপাদনে নারীর অনেক বেশি অংশগ্রহণ থাকা সত্ত্বেও, এত অল্প সংখ্যা দেখে এটাই প্রমাণিত হয়, গ্রামীণ জীবনে আনুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক খাতে নারীর কাজের পরিধি এখনো খুবই সামান্য। 'পারিবারিক শ্রমিক' বলেই এখনো তারা নিজেদের ব্যক্তিগত ও স্বাস্থ্যগত সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
কয়েক মাস আগে এক খবরে দেখলাম, ভারতে কাজ বাঁচাতে জরায়ু কেটে ফেলছেন হাজার হাজার নারী কৃষি শ্রমিক। ভারতের এমন কিছু এলাকা আছে, যেখানে গ্রামের পর গ্রাম খুঁজেও ২০-৩০ বছরের এমন নারী পাওয়া যাবে না, যাদের জরায়ু রয়েছে।
এরা সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ। পিরিয়ড হলে মালিকের নানা গঞ্জনা শুনতে হয়, বেতন কাটা যায়, তাই অভাবের তাড়নায় মেয়েরা তাদের জরায়ু ফেলে দেন, যাতে কাজে বিঘ্ন না ঘটে।
এতে কাজে হয়তো বিঘ্ন সৃষ্টি হয় না তাদের, কিন্তু এর ফলে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা ভোগ করতে হয় নারী কৃষকদের।
জরায়ু ফেলে দেওয়ার এই জঘন্য কাজটি চলছে প্রায় ৬-৭ বছর ধরে। এই অপারেশন যারা করিয়ে নিচ্ছেন, তারা প্রায় সবাই কৃষি শ্রমিক। ক্ষেত থেকে আখ কাটেন। বছরে ছয় মাস এইসব আখ ক্ষেতে কাজ করতে আসেন হাজার হাজার নারী শ্রমিক। আখ কাটার কাজটি খুব শ্রমসাধ্য। তাই মেয়ে শ্রমিকরা এই সময় কামাই করেন বলে মালিকরা নিপীড়ণ করে তাদের ওপর। কাজের পরিবেশও অস্বাস্থ্যকর। মাঝেমাঝে রাতেও থাকতে হয়। এ রকম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দিনের পর কাজ করার ফলে তাদের নানা রকম ইনফেকশনও হয়ে থাকে।
মহারাষ্ট্রের রাজ্যসভায় নারীদের অবমাননাসূচক শারীরিক ক্ষতির প্রসঙ্গ উপস্থাপন করেন বিধায়ক নীলম ঘোরে। তার কথার সঙ্গে একমত হয়ে রাজ্যের তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, ৩ বছরে বীদ জেলায় ৪৬০৫টি হাইসটেকটমি সার্জারি হয়েছে। এই সার্জারিতে নারীর প্রজননতন্ত্রের অনেককিছুই কেটে ফেলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে নারী কৃষি শ্রমিকরা হয়তো এতটা কষ্টের মুখে এখনো পড়েননি, কিন্তু পড়তে কতক্ষণ?
গ্রামীণ নারীদের অনেকেই মনে করেন, তারা আগের চাইতে অধিক হারে অর্থনৈতিক কাজে অংশ নিতে পারলেও, নিজেদের অর্জিত টাকা ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এখনো তাদের সুযোগ খুব কম। নারীকে কাজ করতে হয় মূলত 'পারিবারিক শ্রমিক' হিসেবে; কাজেই তাদের আয়ের পরিমাণ খুবই সামান্যই রয়ে গেছে। আয় করে সব টাকা স্বামীর হাতে তুলে দিতে হয়; স্বামীই সিদ্ধান্ত নেন, এই টাকা কোন খাতে খরচ হবে।
গ্রামীণ সাপ্তাহিক বাজারে তাদের উপস্থিতি খুব একটা চোখে না পড়লেও, ইদানিং জীবিকার প্রয়োজনে অনেকেই আসছেন। যদিও তাদের বিক্রয়লব্ধ অর্থ তাদের স্বামী গ্রহণ করেন এবং এই টাকা ব্যয় করার অধিকারও তাদের নাই, তাই এই কাজে নারীর যে শ্রম ও সময় ব্যয় হলো, তা অবমূল্যায়িতই থেকে যায়। এর পাশাপাশি রয়েছে গৃহস্থালি ও সেবা কাজের চাপ। একজন কৃষাণী পারিবারিকই হোন আর মজুরিভিত্তিকই, তিনি কিন্তু তার দৈনন্দিন কাজের কোনো দাম বা প্রশংসা পান না।
এই তথ্যগুলো আবার নতুন করে উঠে এসেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) আয়োজিত 'কৃষিতে নারীর কাজের মূল্যায়ন' শীর্ষক সাম্প্রতিক এক গবেষণাপত্র থেকে। গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ড. ইসমত আরা বেগম।
যদিও গ্রামে মেয়েরা অধিক হারে পড়াশোনা করার সুযোগ পাচ্ছেন, এলাকায় কৃষি বিষয়ক তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের প্রবেশাধিকার সহজ হয়েছে এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যোগ দেওয়ার লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে সহায়তা করা হচ্ছে; কিন্তু এরপরও সব কাজের ক্ষেত্রেই নারী ও পুরুষের মধ্যে প্রকট বেতন বা মজুরি বৈষম্য রয়ে গেছে।
এই গবেষণাতে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, বাংলাদেশে কৃষি কাজের কতটা নারীর দ্বারা সম্পাদিত হয়? পরিবারের কতটা খাবারের যোগান দেন নারী? গ্রামীণ শ্রম বাজারে নারী কতটা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন? বিবিএস পরিসংখ্যানে কি গ্রামীণ নারীর কাজকে ঠিকমতো তুলে ধরা হয়েছে? এমন কি কোনো প্রমাণ আছে যে গ্রামীণ পুরুষরা লাভের আশায় কৃষিকাজ ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন এবং নারীরা কৃষি-ব্যবস্থাপনায় মূল চালিকাশক্তি হতে চলেছেন?
আমরা চাই সরকার প্রত্যক্ষভাবে হিসাব নেবেন, ধান উৎপাদন, গবাদিপশু পালন, হাস-মুরগি পালন এবং মাছ চাষে নারীর কাজ কতটা? এটা দেখা যে কৃষিখাতের নারী শ্রমিক তাদের কাজের পাওনা পাওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের চাইতে কতটা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন? গ্রামীণ নারী তাদের কাজের কতটা উৎপাদনশীল কাজে এবং কতটা অনুৎপাদনশীল কাজে ব্যয় করেন? এবং শ্রম বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে নারীর বড় বাধাগুলো কী কী?
শুধু যে গৃহস্থালি ও সেবামূলক কাজই গ্রামীণ নারীকে শ্রম বাজারে অনেক বেশি হারে প্রবেশে বাধা দেয়, তা নয়। গ্রামীণ নারীর অবদানকে স্বীকার করে নেওয়ার ক্ষেত্রে জেন্ডার অর্থনীতির মাপকাঠির যে তত্ত্বীয় পরিমাপক রয়েছে, তার ভিত্তিতে গ্রামীণ নারীর কাজকে বিচার করা হয়। এর পাশাপাশি তাদের অর্থনৈতিক কাজসমূহকে সিস্টেম অব ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টসের (এসএনএ) মাধ্যমে হিসেব করা হয়।
অথচ এই কাজগুলো কোনো অর্থনৈতিক লেনদেন বা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশা ছাড়াই গ্রামীণ নারী সংসারে ও সংসারের বাইরে করে থাকেন। তাদের এই কাজগুলো উৎপাদনের জাতীয় হিসাবের বাইরে থাকে বা জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতির (এসএনএ) বাইরে থাকে।
যেহেতু আর্থিক মূল্য ছাড়া কোনো কাজই বাজার অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত হয় না, আর তাই গ্রামীণ নারীর অবৈতনিক ও অমূল্যায়িত গৃহস্থালি, সেবামূলক এবং কৃষিকাজের মূল্যায়ন করে জাতীয় জিডিপিতে তা অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।
এজন্য এখন স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট সিস্টেমের কথা বলা হয়েছে। এটি এমন এক হিসাব পদ্ধতি, যা দিয়ে ঘরের অ-অর্থনৈতিক সেবামূলক বা গৃহস্থালি কাজ মাপা হয়। এই কাজগুলো কোনো অর্থনৈতিক লেনদেন বা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশা ছাড়াই গৃহিণীরা করে থাকেন। তাদের এই কাজগুলো উৎপাদনের জাতীয় হিসাব অথবা জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতির (এসএনএ) বাইরে থাকে।
আর্থিক মূল্য ছাড়া কোনো কাজই বাজার অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত হয় না বলেই অর্থনীতিবিদরা সাধারণত স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট সিস্টেমের ওপর নির্ভর করেন। স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে নারীর অমূল্যায়িত কাজ চিহ্নিত করে অর্থনীতিবিদরা জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতি বা সিস্টেম অব ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টসের (এসএনএ) কঠিন সীমাবদ্ধ চৌহদ্দি অতিক্রম করতে পারেন।
আমরা জানি, অনেক আগে থেকেই গ্রামীণ নারীরা কৃষিখাতে অনেক অবদান রাখেন। বিশেষ করে আবাদ পরবর্তী কাজ, গবাদিপশুর দেখাশোনা, দুধ আহরণ, ছাগলের চাষ, বাড়ির ভেতরের সবজি বাগান এবং বীজ সংরক্ষণের মতো জরুরি কাজটা নারীরাই করেন। নীরবে এইসব কাজ করার পাশাপাশি তারা পরিবারের সকল দায়িত্বও পালন করেন। আরও রয়েছে জমি তৈরি, চারা রোপণ, সার দেওয়া, পোকা নাশকের ব্যবহার, বীজ তৈরি, চাষাবাদ, শস্য জমি থেকে বাড়িতে নেওয়া, ফসল ভাঙানো, বাছাই ও প্যাকেটজাত করা।
ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের কৃষিতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় শতকরা ২০ ভাগ বেশি। যদিও বাংলাদেশ সরকার কৃষি, পুষ্টি এবং জেন্ডার লিংকেজ নিয়ে 'এঞ্জেল' নামে দেশব্যাপী একটি কর্মসূচি নিয়েছে, যার আওতায় নারী কৃষকদের খাদ্য বিষয়ক বৈচিত্র্য, পুষ্টি, আর্থিক লাভসহ স্বাস্ব্যখাতে কীভাবে খরচ কমানো যাবে, সেই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু নারী কৃষি শ্রমিকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পারিবারিক পরিচয়ে কাজ করেন, তাই এই সুবিধার বাইরেই থেকে যান তারা।
বহুদিন ধরে বিভিন্ন খাত থেকে দাবি জানানো হচ্ছে, যেহেতু ক্রমশ নারী কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে, কাজেই তাদের মূল সমস্যাগুলোর, বিশেষ করে স্বাস্থ্য সুবিধার দিকে দৃষ্টি দেওয়া হোক। মালিক ও গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের বাধ্য করতে হবে, যেন তারা নারী কৃষি শ্রমিকের সব ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করেন। বিশেষ করে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সুবিধাদি।
টয়লেট সুবিধা না থাকলে কোনো চাতাল মালিককে রেজিস্ট্রেশন করানো হবে না। কৃষি উপকরণ, সার, বীজ বিতরণ করার সময় নারী শ্রমিককে অগ্রাধিকার দিতে হবে; নারী কৃষককে খুলতে দিতে হবে ব্যাংক হিসাব। আর এটা দেখবে সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
যেহেতু ভূমির মালিকানার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা কঠিন, তাই গ্রামীণ নারীর কৃষিকাজ, গৃহস্থলি ও সেবা কাজকে অবশ্যই হিসোবের মধ্যে আনতে হবে।
- [৫ ডিসেম্বর ২০২০]
- লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন