বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের ‘ছবক’ দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের একি হাল!
ওয়াশিংটন ডিসিতে ট্রাম্প সমর্থকদের কার্যকলাপ দ্বারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের যে চেহারা প্রকাশ পেয়েছে তার বিরুদ্ধে চীনসহ তৃতীয় বিশ্বের সকল দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের একসঙ্গে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা উচিত। দীর্ঘকাল যাবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়গুলোকে সামনে এনে একের পর কর্তৃত্ববাদীতা দেখিয়েছে সারা বিশ্বের ওপর এবং অনেকক্ষেত্রেই তা চাপিয়ে দিয়েছে।
রাশিয়া, চীন, কিউবা ইউরোপের দেশ পোল্যান্ডসহ বহু দেশের রাজনৈতিক কাঠামো পাল্টে দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের গণতান্ত্রিক ধারণা। ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা তুলে ধরে আজ সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই করুণ চেহারা তৃতীয় বিশ্ব কিংবা নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের দেশগুলোকে সাহস যোগাবে যে তারা যা করছে তা সঠিক!
এদের নেতৃত্বে আছে চীন । চীনের নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র আজ নতুন রূপ ধারণ করল। গত রাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে এই প্রথম ১৮১২ সালের পরে কংগ্রেস ভবন আক্রমণ করা হলো। ১৮১২ সনে ব্রিটিশর সৈন্যরা এই ভবনটিতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল তারপর ২০৮ বছরে ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই রাজধানীতে এই ভবন কখনো সন্ত্রাসের শিকার হয়নি। কিন্তু ট্রাম্প এবং ওই দেশের ৭ কোটি ভোটার তাদের চরিত্র প্রকাশ করল। তার বাইরে যারা বাইডেনের সমর্থন করছেন তারা নিজেদেরকে ট্রাম্পের জায়গা থেকে আলাদা করে দেখবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাইডেনের নেতৃত্বে এই রাজনৈতিক দল অতীতে বিশ্ব মানবাধিকারের প্রশ্নে খুব ভালো কোন রেকর্ড দেখাতে পারেনি। সে কারণে আজকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘটনা পৃথিবীর কাছে গণতন্ত্রের নতুন সংজ্ঞা দাবি করে কিনা তাই বিবেচনা করতে হবে।
যে বহুবাদীত্ত্বের কথা আমরা বহুকাল ধরে জেনেছি, তা অর্জনের জন্য আন্দোলন করেছি তা যে কতোটা ভঙ্গুর হতে পারে সেটি প্রমাণ করলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ট্রাম্প ও তার দল রিপাবলিকান পার্টির এই পদক্ষেপের ফলে জর্জিয়াতে প্রথম একজন আফ্রিকান-আমেরিকান সিনেটে জয় লাভ করলেন। সিনেটের অপর আসনটিও ডেমোক্র্যাটদের দখলে চলে যাচ্ছে। পরিণামে প্রায় দীর্ঘ ১০ বছর পর ডেমোক্রেট পার্টি সিনেটে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ফেরত পাচ্ছে। মার্কিন কংগ্রেস বৃহস্পতিবার বাইডেনকেই আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিজয়ী ঘোষণা করেছে। গত দুই মাসের তীব্র বিরোধীতার পর গতকালের ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটায় ট্রাম্পও তার পরাজয় মেনে নিয়েছেন।
সিনেটের সভাপতি হিসেবে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের ভোটের ভোটের অধিকার আছে। বর্তমান অবস্থায় দেখা যাচ্ছে ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকানরা প্রায় ৫০:৫০ আসনে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। সেই কারণে কমলা হ্যারিসের কাস্টিং ভোট সব সময় ডেমোক্রেটিক পার্টি কে জয়যুক্ত করবে। যদি তারা কোন ইস্যুতে দলগতভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকে তাহলেই কেবলমাত্র এই মেজরিটি ফেরত পাওয়ার ভেতর থেকে বাইডেন তার সরকার চালাতে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে কথা বলা যায়।
কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী সে দেশের নির্বাচিত কংগ্রেস সদস্য অথবা সিনেট সদস্যরা নিজের ইচ্ছা মতন দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন। এই বিষয়টি তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশ থেকেই আলাদা। যেমন আমাদের দেশের সংবিধানের ৭০ এর (ক) ধারার কারণে বাংলাদেশের সংসদ সদস্যরা সরকারের উত্থাপিত কোন বিল এর বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন না। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস এবং সিনেট সদস্যদের এই অধিকার আছে। ফলে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যাবেনা জো বাইডেনের উত্থাপিত সকল ধরনের আইন কিংবা প্রস্তাবনা তার দলীয় বিবেচনায় গৃহীত হবে। সেখানে অনেক কংগ্রেস সদস্য কিংবা সিনেট সদস্য তাদের ভিন্নমত প্রকাশ করতে পারেন।
গতরাতে ঘটে যাওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ভবনে নিহত একজন নারীসহ যে চারজন মানুষ জীবন হারালো তাদের এই মৃত্যুর জন্য অবশ্যই ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়ী। গতকাল ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে তার সমর্থকদের সামনে বক্তব্য রেখেছেন। এরপরই কংগ্রেসের অধিবেশন চলাকালে তার সমর্থকরা ক্যাপিটল ভবনে ন্যাক্কারজনক হামলা চালায়। এখন দেখার বিষয় হবে আগামী দিনগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার এবং প্রশাসন বিভাগের স্বাধীনতা ও সক্ষমতা কতখানি। যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টে আজকের এই ঘটনা সংঘটিত করলো তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয় সেটার দিকে তাকিয়ে থাকবে বিশ্ব। এই হত্যাকাণ্ডের দায়ভার কোথায় যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার জন্য তা একটি পরীক্ষা-ই হবে বটে। এই ঘটনার পরে আগামী দিনগুলোতে আমরা দেখতে পাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন এবং বিচার বিভাগ কতটা নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালন করছেন।
আজকে জর্জিয়ার যে দুটি আসন হারালো রিপাবলিকান দল তার জন্যও ট্রাম্প একমাত্র দায়ী একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদীতার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটানোর জন্য নভেম্বরের নির্বাচনের ফলকে মানতে অস্বীকার করে বারবার যে দাবি সামনে তুলে ধরেছিল তা জর্জিয়ার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। জর্জিয়া বরাবরই রিপাবলিকানদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। অথচ সেখানেই জিতে গেলেন আফ্রিকান-আমেরিকান বংশোদ্ভূত ডেমোক্র্যাট প্রার্থী রেভারেন্ড রাফায়েল ওয়ারনক। এতে বোঝা যায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২রা নভেম্বর উত্তর অবস্থানের কারণে এই রাজ্যে রিপাবলিকান দলের এই করুণ পরাজয়।
রিপাবলিকান দলের এই পরাজয় বিশ্বকে একটি নতুন রাজনৈতিক পোলারাইজেশন করার সুযোগ এনে দিলো। এতে ইরানের বিষয়ে মার্কিন অবস্থানের পরিবর্তন হবে, ভারতের ক্ষেত্রে মার্কিনীদের অবস্থান পরিবর্তিত হতে পারে। কিন্তু ফিলিস্তিনের জন্য তেমন কোনো বার্তা বহন করবে না জো বাইডেনের সরকার। সেই জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আগামী দিনগুলোতে বিশ্ব রাজনীতি কোন দিকে প্রবাহিত হয় সে দিকে। ট্রাম্পের বিগত চার বছরের 'আমেরিকা ফার্স্ট' শব্দটি রাজনৈতিক অঙ্গনে কীভাবে বাইডেন মোকাবেলা করে তা দেখার মতো হবে।
চীনের উত্থাপিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ডলারের পরিবর্তে বাই-লেটারাল কারেন্সি করা সম্ভব কিনা তা আমাদের দেশকে গভীরভাবে ভাবতে হবে। বিশ্বব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামরিক কর্তৃত্ববাদীতা যদি দুর্বল করতে হয় তাহলে বিশ্ববাণিজ্যে ডলারের ক্ষমতাকে পাল্টে দিতে হবে। যা বিশ্ব শান্তি ও মানবতা প্রতিষ্ঠার জন্য একান্তই প্রয়োজন।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক