বৈবাহিক চুক্তি ও রাষ্ট্রীয় আইনই যখন শিশু ধর্ষণের হাতিয়ার
টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার কালিয়া গ্রামের নূর নাহারের নামটি অন্তত: আমরা সবাই এতক্ষণে জেনে গেছি। মাত্র চোদ্দ বছরের এই অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী বাল্য বিবাহের জের হিসেবে ২১ বছরের বড় ও প্রবাসী শ্রমিক স্বামী রাজিব খানের (বয়স: ৩৫) হাতে বিয়ের পর টানা চৌত্রিশ দিন বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হয়ে ও ক্রমাগত রক্তপাতের ফলে গত ২৫শে অক্টোবর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছে।
স্থানীয় কালিয়া বিদ্যালয়ের এই ছাত্রী নূর নাহার লেখা-পড়ায় ভাল ছিল এবং ক্লাসে সে দ্বিতীয় হতো। তার বাবা-মা দু'জনেই দিনমজুর এবং প্রবল দারিদ্র্যের কারণেই হয়তো বাবা-মা'র রোজকার দাম্পত্য কলহ এত প্রবল ছিল যে নূর নাহারের মাতামহ লাল খান মাত্র চার বছর বয়সে দৌহিত্রীকে কালিয়া গ্রামে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। নাতনীকে স্কুলে পড়ানোর খরচ লাল খানই এতকাল তাঁর দিনমজুরির টাকা থেকে যুগিয়ে এসেছেন।
তবে এবছর কোভিডের কারণে লম্বা লকডাউনে শ্রমজীবী পরিবারগুলোর অবস্থা আরো খারাপ হয়ে পড়ার কারণেই কিনা কে জানে গত ২০শে সেপ্টেম্বর লাল খান পাশের গ্রামের রাজিব খান নামের এক ৩৪/৩৫ বছর বয়সী প্রবাসী শ্রমিকের সাথে নাতনীর বিয়ে দেন। রাজিব খান সংযুক্ত আরব আমিরাতে শ্রমিক। সম্ভবত: প্রবাসী রাজিবের 'মোটা বেতনে'র কারণেই মেয়েপক্ষ এইটুকু এক কিশোরীর সাথে বয়সে অত বড় এক পাত্রের বিয়ে দেয়। নাতনীর বিয়েতে লাল খান ত্রিশ হাজার টাকা খরচ করেন বলেও নানা পত্র-পত্রিকার বরাতে জানা যাচ্ছে। যেহেতু দেশে বিরাজমান 'দ্য চাইল্ড ম্যারেজ রেস্ট্রেইন্ট এ্যাক্ট'-এর আওতায় নূর নাহারের বিয়ের ন্যূণতম বয়স (১৮) হয়নি, সেহেতু লোভী বা অসচেতন মেয়ে পক্ষ বিয়েটি রেজিস্ট্রি না করেই নূর নাহারকে বাসাইলের ফুলকি পশ্চিমপাড়ায় তার শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।
বাংলাদেশ পৃথিবীর সেই মুষ্টিমেয় কিছু দেশের একটি যেখানে শিশু বিবাহের হার অত্যন্ত চড়া। শতকরা ৬৬ ভাগ মেয়ের এখানে আঠারোর নিচে ও ষোল বছর নাগাদ বিয়ে হয়ে যায়। এজন্যই বাংলাদেশের মোটামুটি প্রগতিশীল একটি সংবিধানে সমাজের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমতার (অনুচ্ছেদ ২৭) কথা বলা হলেও অথবা জাতিসঙ্ঘের 'নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপকারী সনদ' তথা সিডও কনভেনশনে আমরা স্বাক্ষরকারী দেশ হলেও শিশু বিবাহের হার আমরা কিছুতেই কমাতে পারছি না। এবং সেটা কমানো যাচ্ছে না বলেই প্রাথমিক শিক্ষায় বাংলাদেশে মেয়ে শিশুরা খুব চড়া হারে ভর্তি হলেও মাধ্যমিক স্তরে এসেই ড্রপ-আউট রেট, কিশোরী বিবাহ ও কিশোরী মাতৃত্ব কোনভাবেই প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। বিব্রত সরকার জাতিসঙ্ঘের 'সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা' বা 'মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল' বা হালে যাকে বলা হচ্ছে 'সাসটেইনাবল ডেভেলপমেন্ট গোল' বা 'টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা,' সেই লক্ষ্যমাত্রার নানা সূচকে অভাবনীয় সাফল্য লাভ করলেও এই একটি জায়গায় ঠেকে গিয়ে মাঝখানে বিয়ের বয়স আঠারো থেকে কমিয়ে ষোল করার কথাও ভেবেছে বা সেই লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন করতে চেয়েছে। অসংখ্য উন্নয়ন সংস্থা, নারী অধিকার ও মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থার কঠোর প্রতিবাদে সেই কাজ এখনো পুরো হয়নি। আর এসব কলরবের মাঝেই নূর নাহারের মৃত্যু একটি শীতল চড় হয়ে আমাদের সবার গালেই যেন চেপে বসেছে বা বসছে।
একটি ছোট রাষ্ট্র হলেও বাংলাদেশ তার জন্মলগ্ন থেকেই বিশ্বের সব প্রগতিশীল মানবাধিকার, শিশু অধিকার বা নারী অধিকার সনদে স্বাক্ষর করে এসেছে এবং ক্ষেত্র বিশেষে বাস্তবায়ন করারও চেষ্টা করেছে। একারণেই ১৯৭৯ সালের ১৮ই ডিসেম্বর জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত 'নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপকারী সনদ'-এ বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালে স্বাক্ষর করে এবং ২০০০ সালে সনদটির অপশন্যাল প্রটোকলেও স্বাক্ষর করে। প্রতি চার বছর অন্তর জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ সিডও সনদের আলোকে রাষ্ট্রপক্ষ হিসেবে তার নারীর প্রতি নানা বৈষম্য কতটা কমলো বা নারীর কতটা অগ্রগতি হলো সেই প্রতিবেদন দাখিল করে আসছে বেশ কিছু বছর। ২০১৬ সালে জেনেভায় ৬৫তম অধিবেশনে বাংলাদেশ তার অষ্টম প্রতিবেদন দাখিলের চার বছর পর ২০২০-এর নভেম্বরের শেষ নাগাদ আমাদের নবম প্রতিবেদনও প্রণীত হবে। রাষ্ট্র হিসেবে বিগত কিছু বছরে লৈঙ্গিক বৈষম্য বিনাশে ও সমতা সূচকে আমাদের একেবারেই কোন অগ্রগতি নেই তা-ও নয়। তবু এত এত প্রবৃদ্ধি বা এমনকি মানবসম্পদ উন্নয়নের সূচকের হিসাবও কখন যেন অর্থহীন হয়ে পড়ে যখন নূর নাহারের মত এক কিশোরী বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হয়ে টানা রক্তপাতে মারা যায়।
হ্যাঁ, বাংলাদেশ ২০১৫ সালে প্রথম বিশ্বব্যঙ্কের হিসেবে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের সারিতে প্রবেশ করেছে। জাতিসঙ্ঘের 'টেঁকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা' বা 'এজেন্ডা ২০২০'-এর আওতায় ১৭টি উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণেও দেশ হিসেবে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ। শিক্ষার ক্ষেত্রেই যেমন গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশে বালিকা শিক্ষায় সরকার থেকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। মাধ্যমিক স্তরেই কিশোরী মেয়েদের বিয়ে দেবার এবং ফলে স্কুল থেকে ড্রপ-আউট হবার প্রবণতা বেশি বলে গ্রামে গ্রামে স্কুলে মেয়েদের উপ-বৃত্তি হিসেবে গম দেয়া হচ্ছে। প্রাথমিক স্তরে আমরা দেখছি যে বালক-বালিকা মিলিয়ে ভর্তির হার ৯৭.২৪ শতাংশ তবে মাধ্যমিক স্তরে এটা ৬৯.৩৮ শতাংশে নেমে এসেছে। মেয়েরা প্রাথমিক স্তরে শুধু যে পড়া শেষ করছে তাই নয়, এমনকি মাধ্যমিক স্তরে যেখানে ৬৭.২৬ শতাংশ ছেলে স্কুলে ভর্তি হচ্ছে, সেখানে মেয়েদের ভেতর ৮১.৯০ শতাংশ ভর্তির হার। দরিদ্র পরিবারগুলো থেকে উপ-বৃত্তির টাকা বা গমের কারণেও মেয়েদের মাধ্যমিক স্তরে স্কুলে দেয়া হয় আর ছেলেদের সেই বয়সেই অনেককেই কাজে ঢুকতে হয়। কিন্তু তারপর? ২০১৮ সালের এক হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে মাধ্যমিক স্তরে ছেলেদের ভেতর স্কুল শেষ করতে পারার হার যেখানে ৬৩.৯৯ শতাংশ, সেই হার মেয়েদের ক্ষেত্রে ৫৯.৮১ শতাংশ। এর একমাত্র কারণ হলো বাল্য বিবাহ।
জাতিসঙ্ঘের 'টেঁকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা' বা এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের হিসেবে 'বৈশ্বিক লৈঙ্গিক বৈষম্য সূচক'-এর ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ কিন্তু ১৫৩টি দেশের ভেতর ৫০তম স্থান লাভ করেছে এবং নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ণে আমরা পৃথিবীতে সপ্তম। নারী উন্নয়নের নানা হিসেবেই দক্ষিণ এশিয়ার ভেতর আমরা পাঁচবারের মত সেরা স্থান দখল করেছি। কিন্তু তারপর সবচেয়ে কমিয়ে বলা হিসেবেও এদেশে ৫১.৪ ভাগ নারীর আঠারোর আগে বিয়ে হয় এবং পনেরোর আগেই দৈহিক সম্পর্কের অভিজ্ঞতা হয় অসংখ্য নারীর। শুধুমাত্র বাল্য বিবাহের এই অভিশাপ কাটাতে পারলে মাতৃ মৃত্যু ও শিশু মৃত্যুর হার আরো অনেকাংশেই হ্রাস পেতে পারত। এই যে আঠারো বা ক্ষেত্র বিশেষে ১৫-এর নিচেও যে মেয়েরা বধূ হচ্ছেন, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বামীর হাতে যৌন নিপীড়ন, দৈহিক সহিংসতা যেমন প্রহার এবং মনস্তাত্বিক নিপীড়নের শিকার ত' হয়েই থাকেন। একটি প্রাপ্তবয়সী মেয়ে যদিবা তার দৈহিক বা মানসিক গড়নের কারণে সেসব ধকল খানিকটা হলেও সামলাতে পারে, আঠারোর নিচে বা নূর নাহারের মত এক পনেরোর নিচে শিশুর পক্ষে সেই সব ধকল সয়ে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকাটাই কঠিন।
নূর নাহারের প্রসঙ্গে আবার ফিরি। এটা ভেবে বাস্তবিকই বেদনা ও অবাক বোধ হচ্ছে যে কোভিডের কারণে নূর নাহারের মাতামহ লাল খানের অবস্থা যদি খারাপই হয়ে পড়ে, ত্রিশটি হাজার টাকা সে ত' নাতনীর বিয়েতে খরচ করেছে! এতগুলো টাকা কেন খরচ করা হলো? নাতনীকে তড়ি-ঘড়ি কবরে পাঠাতে? ক্লাসে দ্বিতীয় হওয়া নূর নাহারের উচ্চ শিক্ষার জন্যও ত' এই টাকাটা জমিয়ে রাখা যেত। তবে হয়তো এত দ্রুত সে মারাও যেত না। পাশাপাশি বয়সের কোন তরুণের সাথে বিয়ের বদলে ২১ বছরের বড় বা বলতে গেলে নূর নাহারের বাবার বয়সী একজনের সাথে বিয়ে দেয়া হলো কেন? সে সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রবাসী শ্রমিক বলে? হায় আমাদের অসচেতন, গ্রামীণ পরিবারগুলো! রাজিব খান এটুকু শিশুকে বিয়ে করা ও বিয়ের রাতেই দৈহিক সম্পর্ক স্থাপণের পর নূর নাহারের রক্তপাত শুরু হবার পরও টানা চৌত্রিশ দিন বৈবাহিক ধর্ষণ চালিয়ে যাবার অপরাধে অপরাধী ত' বটেই, তবে একদিক থেকে দেখলে এই ভয়ানক অপরাধী রাজিবও 'অপরাধী' হয়েছে তার দারিদ্র্য ও অশিক্ষা থেকেই। কিভাবে? রাজিব আসলে বাংলাদেশের দরিদ্র শ্রেণির সেই অসংখ্য শিক্ষিত বা স্বল্প-শিক্ষিত মানুষের একজন যারা জমি বেচে হোক বা মা'র সোনার গয়না বেচে হোক, মধ্যপ্রাচ্য বা মালয়েশিয়া থেকে বসনীয়া অবধি পাড়ি জমায় সেখানে রাস্তা ঝাড়– দিয়ে বা টয়লেট সাফ করেও একটু টাকার মুখ দেখবে বা দেশে বাড়ির অবস্থা ফেরানোর আশায়। বিদেশে খুবই অমানবিক পরিবেশে বছরের পর বছর কাটায় তারা। টাকা-পয়সা জমিয়ে বিয়েও করে অনেক দেরিতে। সমবয়সী অনেক যুবকের তুলনায় অনেক শ্রমময়, অসম্মানিত ও বন্ধু-পরিবারহীন প্রবাস জীবন কাটে তাদের। সেই সাথে সেইটুকু শিক্ষা বা সংস্কৃতির আলো ত' তারা পায়নি বা পায় না যার ফলে দেশে ফিরে কুড়ি-পঁচিশের কোন মেয়েকে বিয়ে করবে সে।
শ্রমিক রাজিব হয়তো 'শিক্ষিত' মেয়েও চেয়েছে আর সেই চাওয়ায় অষ্টম শ্রেণি পড়া মেয়ে ত' খারাপ না! পুরুষ মানুষের জন্য পাত্রীর বাবার বয়সী হওয়া ত' কোন সমস্যা না। মেয়ে রজ:স্বলা হলেই হলো। গরমের দেশে মেয়েরা এমনিতেও দ্রুত রজ:স্বলা হয়। তাই বলে তাদের মানসিক সক্ষমতা তৈরি হয় কি? রাজিব আর নূর নাহারের অসম বয়সী দাম্পত্যের ছবিটিতে শাড়ি আর গয়নার আবরণের ভেতর থেকেও নূর নাহারের ভীত ও বিপন্ন চোখ ভাল করে দেখলে আপনাকে বিচলিত করবে।
নাতনীর মৃত্যুর পর নূরের মাতামহ লাল খান অবশ্য সাংবাদিকদের বলেছেন যে বিয়ের প্রথম রাতের পরই শ্বশুর-শাশুড়িকে রক্তপাতের কথা জানালে তারা তাকে এক কবিরাজের কাছে নিয়ে যায়। মেয়েটিকে কোন ডাক্তারের কাছে নেবার বদলে রাজিব ধর্ষণ চালাতেই থাকে। সে-ও হয়তো কিছুদিন পর আরব আমিরাতে ফিরে যেত আবার বহু বহু দিন অসম্মানজক, হাড়ভাঙ্গা শ্রম ও মানবসঙ্গহীন জীবনে। তার সব দায় মেয়ের বয়সী শিশুটির শরীরেই সে চোকাতে চেয়েছে। যাহোক, কবিরাজের ওষুধ খেয়ে নূর নাহারের অবস্থা আরো খারাপ হলে চতুর শ্বশুরবাড়ি অক্টোবরের ২২ তারিখে তাকে টাঙ্গাইলের একটি ক্লিনিকে নিয়ে যায় এবং মেয়েটির জন্মসূত্রে পরিবারের কাছেই কৌশলে হস্তান্তর করে। রোগীনীর অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হওয়ায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কুমুদিনী হাসপাতালে এবং সেখানেও আরোগ্য না হওয়ায় পাঠানো হয় ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে। নূর নাহারের দরিদ্র পরিবারের মেয়েকে হাসপাতালে নেবার টাকা ছিল না বলে গ্রামবাসী ৬০ হাজার টাকা চাঁদা তোলে। শ্বশুরবাড়ি একটি টাকাও খরচ করেনি এবং মেয়েটির জানাজা বা শেষকৃত্যে রাজিব খান আসেওনি। পুরুষ রাজিবের জন্য নতুনতর পাত্রী মিলবে নিশ্চিত।
কথা হলো, সেই ত' মেয়েটির দরিদ্র পরিবারকে বিয়ের জন্য ত্রিশ হাজার টাকা খরচ ও মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টায় ষাট হাজার টাকা দেনা করতেই হলো। সব মিলিয়ে প্রায় এক লাখ টাকার ধাক্কা! এই টাকা দিয়েই নূর নাহারের শুধু উচ্চশিক্ষা না (কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়), ধরা যাক তাকে একটি ছোট মুদির দোকানও খুলে দেয়া যেত। কিন্তু ঐ যে কন্যা সন্তান মানে যত দ্রুত বিয়ে দেয়া যায়! মেয়েটির শাশুড়ি বিলকিস বেগম মনে করেন যে মেয়েটির উপর 'জ্বিন ভর করেছিল' তবে বাসিল উপজেলা স্বাস্থ্য অফিসার মনে করেন যে বিয়ের প্রথম রাতে বালিকা বধূরা অনেকেই ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্থ হয়ে এমনটা হয়। মেয়েটির বাবা-মা শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে মামলা করলেও সবার আগে এই মেয়ে পক্ষের বিরুদ্ধেই 'চাইল্ড ম্যারেজ রেস্ট্রেইন্ট এ্যাক্ট ২০১৭'-এর আওতায় মামলা হওয়া উচিত যার শাস্তি দুই বছরের কারাদন্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা।
রাষ্ট্রীয় আইনে শিশু ধর্ষণের কোন শাস্তি আছে কি?
দু:খজনকভাবে রাজিব খানকে শিশু ধর্ষণের দায়ে আমরা কোন শাস্তি দিতে পারব না। সেই আদ্যিকেলে বৃটিশ আমলের 'দন্ডবিধি আইন ১৮৬০' অনুযায়ী তেরোর উপরে কোন বালিকা বধূর সাথে জোর করে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন বৈবাহিক ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে না। শুধুমাত্র বধূর বয়স বারোর নিচে হলে স্বামীটির বড় জোর দুই বছরের জেল বা শুধুই জরিমানা হতে পারে। স্বাধীণতার পর থেকে অদ্যাবধি আমাদের দেশে তিনবার নারীর প্রতি সহিংসতা (ধর্ষণ সহ) নিবারণে তিনবার বিশেষ আইন প্রণীত হয়েছে: ১৯৮৩, ১৯৯৫ ও ২০০০ সালে। কিন্তু তিনবারই 'বৈবাহিক ধর্ষণ' বিষয়টি নিয়ে বিশেষ কিছু বলা হয়নি বা কৌশলে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
২০১৫ সালে 'নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ক জাতীয় সমীক্ষা' থেকে দেখা যায় ২৭.৩ শতাংশ নারী স্বামীর হাতে সহিংস যৌন অপরাধের শিকার হন। 'বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো'র আর এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে ১৯,৯৮৭ জন বিবাহিত নারীর ভেতরে ৫,৩৯০ জন নারী জীবনে কখনো না কখনো 'বৈবাহিক ধর্ষণ' সহ্য করেছেন। এবং দেশের প্রচলিত আইনে কোন আদালতেই এর জন্য কোন বিচার চাওয়া যাবে না। চোদ্দ বছরের নূর নাহারকে যে ২১ বছরের বড় লোকটির হাতে নিগৃহীত হয়ে মরতে হলো, সেই লোকটি 'কাগজে-কলমে' তার স্বামী ছিল বলেই আমরা কোন বিচার চাইতে পারব না। বড় জোর 'চাইল্ড ম্যারেজ রেস্ট্রেইন্ট এ্যাক্টে'র ধারা ৭-এর আওতায় রাজিবকে দুই বছর কারাদন্ড বা জরিমানা দেয়া যেতে পারে।
এই যে সিডও সনদের ধারা-১০ অনুযায়ী মেয়েরা যেন বাল্য বিয়ের জন্য স্কুল থেকে ঝরে না পড়ে, সেজন্য কত সুন্দর সব কথা বলা হয়েছে! সুন্দর সব কথার ফুলঝুরি রয়েছে আমাদের সংবিধানে, আইনে ও বৈশ্বিক মানবাধিকারের নানা দলিলে। বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ। কার্তিকের মঙ্গায় মানুষ হয়তো এখন আর না খেয়ে মরে না। শুধু কোন বিষন্ন হেমন্তের সকালে একটি চোদ্দ বছরের মেয়ে অভাব-অশিক্ষা-অসচেতনতার দায়ে জোর করে দেয়া বিয়েতে টানা চৌত্রিশদিন রক্তপাতের পর মারা যায়। আলোকিত ও অগ্রসর কোন পুরুষ কবির মত এই বাংলায় শঙ্খচিল শালিকের বেশে ফিরে আসার শখ এই অভিশপ্ত কিশোরীর মৃত্যুক্ষণে হয়েছিল কিনা আমরা ত' কোনদিনই আর জানতে পারব না।
লেখক: কথাসাহিত্যিক।