মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করে সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়
ধারণা করা হচ্ছিল বিচারিক আদালত হয়তো রোজিনাকে সামগ্রিকতার বিচারে জামিন প্রদান করে আপাতত বিষয়টির নিষ্পত্তি করবেন। তা হলো না। রোজিনাকে কারাগারের আশ্রয় নিতে হলো। নারী সাংবাদিক হিসেবে এদেশে একটি বিরল ঘটনা ঘটলো। গতকাল প্রায় সারাদিন গণমাধ্যমকর্মীরা বিষয়টিকে প্রতিবাদের জায়গা থেকে তুলে এনেছে। দিনভর চলতে থাকা গণমাধ্যম কর্মীদের প্রতিবাদ প্রশাসনের পর্যায়ে পৌঁছায় নাই বলেই ধরে নেয়া যেতে পারে। গতকাল দিন শেষে জানা গেল, রোজিনাকে যে ধারার মামলায় কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে তা গত ৫০ বছরের ইতিহাসে গণমাধ্যম কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়নি। সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশ্যেই এই ধারাটি তৈরি করা হয়েছে বলে আইনজীবিদের অনেকেই বলছেন। এই ধারা গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য প্রযোজ্য নয়।
অতীতের মতোই এ দেশের বুদ্ধিজীবী দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন। দ্বিধাবিভক্তির মধ্যেই কখনও কখনও তাদের মত প্রকাশ করে থাকেন, তেমন মতামত আজকের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, ১১ জন বিশিষ্টজনের বক্তব্য হিসাবে। রোজিনা অব্যাহতভাবে গত প্যানডেমিকের পুরো সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়ে নানান সংবাদ দেশের মানুষকে জানিয়ে আসছিলেন। পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। রোজিনার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ একটি ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেয়। সেই ইতিহাসের সঙ্গে আজকের বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র কিভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠলো তার একটা ইতিহাস পর্যালোচনা করা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনী ছিল 'ধর্ম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা' নিয়ে। সময়টা ছিল ১৭৮৯ থেকে ১৭৯১ পর্যন্ত। মার্কিন সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর দেশটির নানান বিষয় সামনে চলে আসে। দেশটির আকার ছিল ১৩টি রাজ্যের একটি ছোট্ট দেশ। সেই সংবিধানের জোরে মার্কিন রাষ্ট্র আজকের পর্যায়ের বিস্তৃতি লাভ করেছে। আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫০টি রাজ্য নিয়ে গঠিত। যে রাজ্য পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রাজ্য হিসেবে যোগদান করেছে কেউ বলতে পারবেনা যে তাদের যুদ্ধের মাধ্যমে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছে বা যুদ্ধের মাধ্যমে আমেরিকা সীমানা বৃদ্ধি করেছে।
রোজিনার ঘটনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে ঘটনাটি সামনে চলে আসে তা হল ১৯৭১ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ সংক্রান্ত তথ্য-রিপোর্ট। প্রতিদ্বন্দ্বী দুই মার্কিন পত্রিকার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। আর যে মানুষটি এই কাজ করেছিলেন তিনি ছিলেন একজন ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী ভিন্নমতাবলম্বী। নিউইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্ট এরা উভয়েই সেই রিপোর্টটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। রিপোর্টটি ছিল পেন্টাগনের একটি গোপন দলিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধ সংক্রান্ত। রিপোর্ট প্রকাশের প্রথম তিনদিন পর প্রাথমিকভাবে রাজ্য পর্যায়ে এ রিপোর্ট প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে আদালত। পেন্টাগনের পক্ষ থেকে আদালতে বলা হয় যে, এই রিপোর্ট দেশের স্বার্থ বিঘ্নিত করবে। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পত্রিকার মধ্যে এ বিষয়টিকে নিয়ে সমঝোতা গড়ে ওঠে। নিউইয়র্ক টাইমস সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়, তার সঙ্গে যোগ দেয় ওয়াশিংটন পোস্ট। সুপ্রিম কোর্টের ৬ সদস্যবিশিষ্ট জুরি ৬-০ ভোটে নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে দেয়। সেই রিপোর্টটি প্রকাশের পর এই মার্কিন জনগণের মধ্যে ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী তীব্র মতবাদ গড়ে ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজয় মেনে নিয়ে ভিয়েতনাম ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল।
আরেকটি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের টেলিফোনে আড়িপাতার ঘটনা- এমন সব ঘটনার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজকের শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় আড়াই শত বছর আগে মার্কিন কংগ্রেসের আইন প্রণেতারা উপলব্ধি করেছিলেন, মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা সর্বাগ্রে। যা দেশটির সামাজিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংঘটিত করবে। কার্যত তাই হয়েছে। সেই সময়ের কৃষিনির্ভর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ বিশ্বের প্রধান অর্থনীতি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ১৯৭১ সালে বিশ্বব্যাপী প্রচারিত এই ভূখণ্ডের হত্যাযজ্ঞের খবর প্রকাশ পেয়েছিল বলেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন পেয়ে ছিলাম।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির সময়ে যে ঘটনাটি এদেশে ঘটলো তা একটি দীর্ঘ ব্যর্থতারই ফসল। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়টি দীর্ঘকাল যাবৎ এই ভূখণ্ডে আলোচিত। প্রথমদিকে সংবাদকর্মীরা নিজেরাই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করতেন। তখন দেখা যেত সংবাদপত্রের সংবাদকর্মীরা দাবি তুলছে, পত্রিকার সম্পাদক পত্রিকার মালিক হতে পারবেন না। যদিও এই ধরনের দাবি এখন আর টিকে নেই। দু'একটি পত্রিকা ছাড়া সম্পাদক-প্রকাশকের নামে মালিকের নাম পাওয়া যায় না। কিন্তু গত ২০ বছরের বিবর্তনে একটি জিনিস লক্ষ্য করা গেল তা হচ্ছে, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের মালিকানা মূলত কর্পোরেট হাউজের কাছে নিয়ন্ত্রিত এবং সেই ভাবেই দেশের গণমাধ্যম পরিচালিত হচ্ছে। রোজিনার ঘটনার রাতে থানার সামনে হাতেগোনা কয়েকজন সাংবাদিককে অবস্থান নিতে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু এদেশের ইতিহাস আছে এ ধরনের গ্রেপ্তারের ঘটনায় বহু সংখ্যক সংবাদিক একত্রিত হওয়ার ফলে তাৎক্ষণিকভাবে থানা থেকে সংবাদকর্মীকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। রোজিনাকে আটকের পর গণমাধ্যমে টকশোপন্থীদের টকশো করতে দেখা গেছে। তাতে খুব প্রতিষ্ঠিত সংবাদকর্মীদের উপস্থিত হতে দেখা গেছে ঠিক। যারা প্রত্যেকে এই ঘটনাটি নিয়ে সমালোচনা করেছেন। এমনকি ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম বহুল পরিচিত শক্তিশালী গণমাধ্যমও রোজিনার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ফল কিছু হয়নি। আমলাতন্ত্রের কাছে গণমাধ্যম পরাজিত হয়েছে। এদেরই কর্মকাণ্ড সরকারকে সহায়তা করছে নাকি সমালোচিত করছে তা বোঝার জন্য সরকারের অভ্যন্তরে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত আছেন তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। ২০০১ নির্বাচনের পরে সংবাদপত্র বেশকিছু সহিংস ঘটনার তথ্য জনসমুক্ষে তুলে ধরেছিল। ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলার বিবরণ তুলে ধরেছিল সংবাদপত্রগুলো। সাভারের রানা প্লাজায় সাংবাদিকদের জীবন বাজি রেখে সংবাদ সংগ্রহ করতে দেখা গেছে। মাদক চোরাচালানের ঘটনার বিবরণ সামনে নিয়ে আসছে সংবাদপত্র অব্যাহতভাবে। খবর প্রকাশ করায় বাবুল আক্তারদের ঘটনা সামনে আসছে।
সমাজ উন্নয়নের পূর্বশর্ত গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা। সমাজের উন্নয়ন না ঘটলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন স্থায়ী হয় না, এটি স্বীকৃত মতবাদ। আর সমাজ উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে, মত প্রকাশের অধিকার।