মাখোঁর ইসলাম বিদ্বেষ যখন নির্বাচনী অস্ত্র
আসছে ২০২২ সালের ফরাসী নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি মাখোঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী লি পেন। এ মাসের শুরুর দিককার জনমত জরিপ অনুযায়ী জনপ্রিয়তায় তিনি ইতোমধ্যেই মাখোঁকে সামান্য কিছুটা পেছনে ফেলেছেন। লি পেনকে সংক্ষেপে বোঝা যাবে তার ২০১০ সালের এক ব্ক্তব্যে যেখানে তিনি ফরাসী মুসলমানদের নাজি দখলদারদের সাথে তুলনা করেছিলেন "কোন ট্যাঙ্ক বা সেনাবাহিনী তারা ব্যবহার করেছে না, কিন্তু তারপরও এটা দখলদারিত্বই এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপর এটা বিরাট বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে।" ২০১৭ সালের নির্বাচনেও লি পেনের প্রধান প্রচারণার অস্ত্র ছিল ফরাসি জাতীয়তাবাদ, ইইউ থেকে বের হয়ে আসার অঙ্গীকার এবং মুসলিম বিদ্বেষী প্রচারণা। এই নির্বাচনের চূড়ান্ত পর্বে এই লি পেন পেয়েছিলেন মাত্র ৩৩.৯ ভাগ ভোট, মাখো ৬৯.১ ভাগ। এ থেকেই খানিকটা আন্দাজ করা যায় মাখোঁর পরিবর্তিত বাস্তবতা।
নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্রপতি মাখোঁ প্রথম বক্তৃতায় লি পেনের বিভাজনকারী নীতির বদলে ফ্রান্সকে ঐক্যবদ্ধ করবার ডাক দিয়েছিলেন। আর এখন পরবর্তী নির্বাচনের মুখোমুখি হয়ে নিয়মিতভাবেই তিনি ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্য প্রচার করে যাচ্ছেন। এ মাসের গোড়াতেই, অক্টোবরের ৩ তারিখে তিনি ফ্রান্সের 'অসাম্প্রায়িক সংস্কৃতি' রক্ষার অঙ্গীকার করে কার্যত নাম উচ্চারণ করে ইসলাম ধর্ম একটা সঙ্কটে আছে, এমন মতামত ব্যক্ত করেন। তখন থেকেই অনুমান করা যাচ্ছিল যে, মাখোঁ পরবর্তী নির্বাচনের রণকৌশল ঠিক করে নিচ্ছেন, এবং সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বরাজনীতিতে ঘটে যাওয়া কিছু 'ফরাসী অভিজ্ঞতা' তার নির্বাচনী প্রচারাভিযানের ভাষা ঠিক করে দিচ্ছে। আর এখন মাখোঁ একটা নির্দিষ্ট ধর্ম সম্পর্কে এমন বক্তব্য দিচ্ছেন, যা কোন রাষ্ট্রপ্রধানের মুখ থেকে অভূতপূর্ব, রাষ্ট্রীয়ভাবে এমন ছবি প্রচারের ব্যবস্থা করছেন যাকে একটা ধর্মের অনুসারীরা অবমাননাকর হিসেবে বিবেচনা করেন।
২.
উদারনীতিবাদী হিসেবে পরিচিত একটা দেশের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা উভয়েরই প্রবল জাতিবিদ্বেষী ঝোঁকের মাঝে রাষ্ট্র হিসেবে ফ্রান্সের কোন শক্তিমত্তার ইঙ্গিত নেই। বরং আছে রাষ্ট্রটির ক্রমশঃ প্রভাব হারিয়ে ফেলবার ইঙ্গিত। সাবেক একটি উপনিবেশিক শক্তি হিসেব ফ্রান্সের একটা বিরাট প্রভাব বলয় রয়েছে আফ্রিকায়, বেশ খানিকটা আছে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি রাষ্ট্রের ওপর। কিন্তু পরিবর্তিত বিশ্ববাস্তবতায় সেগুলোতে নতুন নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীদের আবির্ভাব ঘটেছে, ফ্রান্সকে পিছু হটতে হয়েছে কোন কোন স্থলে, কোন কোনটিতে তার মিত্রদের দৃশ্যমান পরাজয় ঘটেছে। অধিকাংশ ইউরোপীয় উপনিবেশিক রাষ্ট্রেই একটি সাধারণ একটা বাস্তবতা পরিলক্ষিত হয়: অর্থনীতিতে সুদিন থাকলে রাষ্ট্রটি উদারনৈতিক ভাবাদর্শের চর্চা করে। অর্থনীতিতে দুর্দিন আসলে উদারনীতিবাদের মুখোশটি সরে গিয়ে বিদ্বেষ এবং ঘৃনা রাজনীতির ভাষা হয়ে উঠতে থাকে। ম্যাখোঁর বেলাতে এই ঘটনাটি আরও বেশি প্রকট আকারেই দেখা দিয়েছে।
নবীর ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন করায় চেচেন বংশোদ্ভুদ একজন কিশোর ১৬ অক্টোবর স্যামুয়েল পাটি নামের একজন শিক্ষককে হত্যা করার নৃশংস যে কাজটি করেছে, সেই ঘটনার তদন্ত-বিচার-শাস্তি এবং এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা নিশ্চিতভাবেই প্রয়োজন। কিন্তু নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড কিংবা পৃথিবীর আরও বহু স্থানে মুসলমান/ আফ্রিকান/ভারতীয় জনগোষ্ঠীর ওপর সমজাতীয় হামলাকে কোন বিশেষ ধর্মের সঙ্কট নিয়ে কেউ ভাবেন না বা বলেন না। কেননা একই ধরনের অসহিষ্ণু দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোবৃত্তি সকল ধর্মের মানুষের মাঝেই দেখা যায়। তাহলে কেন কেবল মুসলমানদের হাতে ঘটা হামলাগুলোকে এভাবে চিত্রিত করা হয়, তার মাঝে আছে বিশ্বসভ্যতা হিসেবে ইসলামের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিগত একটা উপনিবেশিক ধারাবাহিকতা, যার একটা বিস্তারিত আলোচনা রিচার্ড এম ইটন 'ইসলামিক হিস্টরি অ্যাজ ওয়ার্ল্ড হিস্টরি' নামের প্রবন্ধে করেছেন। পৌরানিক ভারত আর নিকৃষ্ট চীনা বিষয়ক পশ্চিমা মনোজগত গড়ে উঠেছিল তাদের যে উপনিবেশিক অভিজ্ঞতার কালে, তারও পুরনো সময় থেকেই মুসলমানদের মুখোমুখি তারা হয়েছিল বিজয়ী শক্তি হিসেবে স্পেনে, এবং রীতিমত ফ্রান্সের সীমানায়, ভূমধ্য সাগরে আর পূর্ব ইউরোপের বহু অঞ্চলে। পারস্পরিক শত্রুতার সেই ইতিহাস বোধের ধারাবাহিকতার পুনর্জাগরণ ঘটেছিল অষ্টাদশ ও ঊনিশ শতকের উপনিবেশিক আমলগুলোতে, কেননা এই দখলীকরণ প্রক্রিয়ায় বিশ্বের একটা বড় অংশ জুড়ে তাদেরকে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকেই মোকাবেলা করতে হয়েছিল। বিদ্যায়তনিক ইতিহাসশাস্ত্র চর্চায় এই উপনিবেশিক মনোবৃত্তি বহু বছর ধরেই প্রান্তিক হলেও জনপ্রিয় রাজনীতিতে তার যথেষ্টই চাহিদা আছে, আর ফ্রান্সের মত একটি দেশে সেটা রীতিমত একটা নির্বাচনী টেক্কা হতে সক্ষম। ঠিক এই কারণেই একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে ঘটা একটা হত্যাকাণ্ডের যে অপরাধ, তার তুলনায় বহুগুন উদ্বেগজনক অপরাধ ফরাসি রাষ্ট্র করে যাচ্ছে কার্যত গোটা একটা সম্প্রদায়কে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে। ফ্রান্সের এই আচরণ উভয় শিবিরেই আরও অজস্র বর্ণবাদী ও মৌলবাদী হামলাকে ইন্ধন দেয়ার সামর্থ্য রাখে।
৩.
মাখোঁর এই আপাত অধঃপতনকে বুঝতে মাখোঁর সময়েই ফরাসি রাষ্ট্রের কিছু ব্যর্থ তৎপরতা নিয়ে আলোচনা জরুরি। লিবিয়ার ঘটনাটাকেই আলোচনায় আনা যাক। লিবিয়ার ত্রিপোলী কেন্দ্রিক যে সরকারটি জাতিসংঘ, সেই অর্থে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত,তার সাথে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখে দেশটির বিপুল খনিজ সম্পদের ওপর এ যাবত একচেটিয়া আধিপত্য ছিল ইতালির। কিন্তু জেনারেল হাফতার নামের একজন যুদ্ধবাজ নেতাকে অস্ত্র-অর্থ-প্রশিক্ষন ও বিশেষজ্ঞ দিয়ে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয় কয়েকটি রাষ্ট্র। এর মাঝে আছে যেমন রাশিয়া, যার লক্ষ্য এই অঞ্চলের উত্তেজনা বজায় রেখে ইউরোপের গ্যাসের বাজারের ওপর একচেটিয়া যতদিন সম্ভব বজায় রাখা, তেমনি আছে ফ্রান্স, যার আগ্রহ আফ্রিকার এই অংশ ও ভূমধ্যসাগরে নতুন করে প্রভাব বিস্তার। মিত্র ইতালীকে ক্ষুদ্ধ করেও হাফতারকে দিয়ে ত্রিপোলীর সরকারকে উচ্ছেদের প্রাণপণ চেষ্টা চালায় তারা। কিন্তু তুরস্কের সামরিক উপস্থিতি ত্রিপোলীর আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সরকারকে শেষ মূহুর্তে রক্ষা করে। হাফতারের দখল থেকে মুক্ত হওয়া এলাকাগুলোতে যে বিপুল গণকবরের সন্ধান মিলেছে, সেটার দায় আরও কয়েকজন ইউরোপীয় মিত্রের মত মাখোঁর ওপর বর্তায়, শুধু তাই নয়, একটা বৈধ ও স্বীকৃত সরকারকে উচ্ছেদের চেষ্টার মধ্য দিয়েও মাখোঁ আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘনের অপরাধটি করেছেন। আজকে ইউরোপে শরণার্থীর যে ঢল নেমেছে, তার অন্যতম দুটি উৎস: একটি সিরিয়া, অন্যটি লিবিয়া। এবং এই বিপর্যয় দুটো ঘটানার পেছনে ন্যাটোর দায় একক, এতে বিশেষভাবে উৎসাহী ছিল ফরাসি রাষ্ট্র। অন্যদিকে এই ব্যর্থ কিন্তু লোভী তৎপরতাই ইউরোপের দেশে দেশে শরণার্থীর ঢল তৈরি করেছে, ডানপন্থী উত্থানে ইন্ধন জুগিয়েছে। তুর্কী রাষ্ট্রপতি এরদোগানের যুদ্ধংদেহী আচরণ নিয়ে যতটা আলোচনা পশ্চিমা গণমাধ্যমে মিলবে, তার ভগ্নাংশও ফরাসি রাষ্ট্রের এই রীতিমত যুদ্ধাপরাধ নিয়ে হয় না। মাখোঁর তৎপরতায় যে সবগুলো ইউরোপীয় রাষ্ট্র যে খুশী না, তা বোঝা যায় তুরস্কের ওপর অবরোধ আরোপে তার সবগুলো উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়াতে। মাখোঁ রীতিমত অপমানিত হন তুর্কী নৌবাহিনীর কর্তৃক একটি ফরাসী যুদ্ধ জাহাজকে লিবিয়ার উপকূলে নিবৃত্ত করার ঘটনায়, অধিকাংশ ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্রকে ফ্রান্স পাশ পায়নি। লিবিয়াতে পরাজয় পরবর্তী ফ্রান্সের ভূমধ্যসাগরীয় পরিকল্পনা কঠিন হয়ে যাওয়াই মাখোঁর নির্বাচনী ভাষা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। সেটা ইমানুয়েল পেটির হত্যাকাণ্ডের আগেই ঘটেছে।
৪.
কিন্তু এই ঘটনাটি কেবল আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ফ্রান্সের ব্যর্থতার ফল নয়। আলো ঝলমলে ফরাসি সভ্যতার একটা কম আলোচিত দিকও আছে। ফ্রান্সে অসহিষ্ণুতা আর বর্ণবাদের একটা পাকাপোক্ত ভিত্তি মজুদ রয়েছে সেখানকার সাবেক উপনিবেশগুলো থেকে আসা মানুষদের সাথে রাষ্ট্রটির আচরণে। ইউরোপের মাঝে সবচাইতে বড় আফ্রিকান জনগোষ্ঠী সেখানকার নাগরিক। এদের বড় অংশ অর্থনৈতিকভাবে দারুণ রকম পিছিয়ে আছেন, তারা থাকেন কতগুলো বস্তিপ্রায় অঞ্চলে। 'অপরাধপ্রবণ' হিসেবে চিহ্নিত এই অঞ্চলগুলোতে দারিদ্র, অশিক্ষা এবং বেকারত্বই প্রধানতম ঘটনা শুধু নয়, তাদের প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিও দারুণ রকম অবমাননাকর। বহু গবেষণায় দেখা গিয়েছে শহরতলীর এই অঞ্চলগুলোর বাসিন্দাদের কেউ যোগ্য হলেও ভালো চাকরিতে নিয়োগ পান না, আফ্রিকান বা আরব নাম হলেও একই পরিস্থিতি হয়। ভয়াবহ পুলিশী হয়রানির শিকার হতে হয় তাদের। ২০০৫ সালের ফরাসী শহরগুলোতে যে ভয়াবহ জাতিগত দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল, সে সময়কার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হুঁশিয়ার করেছিলেন দাঙ্গার সাথে জড়িত তরুণদের দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। অর্থাৎ, তাদের নাগরিকত্বও প্রশ্নাতীত নয়। এবছরের জুন মাসেও ফ্রান্স জুড়ে বর্ণবাদ বিরোধী বিশাল সব বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। সস্তা শ্রমের বিশাল এই উৎস হয়েও আরব ও আফ্রিকার মানুষদের উপস্থিতি ফরাসি সমাজে বিকট এক বর্ণবাদেরও উৎস। ফরাসি উপনিবেশিকতাবাদ ও ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ যে বিপুল মানুষকে ফ্রান্সে টেনে এনেছে, তাই আবার ফ্রান্সে ক্রমঘনায়মান জাতীয়তাবাদী ও বর্ণবাদী ঘৃনাকে প্রবল করছে।
৫.
ফ্রান্স জুড়ে আফ্রিকান বংশোদ্ভুত নাগরিকদের প্রতি বৈষম্যই শুধু নয়, পশ্চিম আফ্রিকা জুড়ে ফ্রান্সের একটা দখলদারিত্ব কায়েম আছে, আনুষ্ঠানিকভাবে উপনিবেশিকতার অবসান হলেও। এটাকে নানান ভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যও অনুমোদন দিয়ে এসেছে সোভিয়েত বিরোধী বিশ্বরাজনীতির অংশ হিসেবে। সত্যি বলতে কী, কোন শিল্পোন্নত দেশই আজকের দিনে আর এই রকম প্রত্যক্ষ লুণ্ঠনের ওপর নির্ভরশীল নয়, যতটা ফ্রান্স। আফ্রিকার ওপর ফরাসি নিয়ন্ত্রণের একটা পরিশীলিত চিত্র মিলবে ডয়েচে ভেলের এই প্রতিবেদনটিতে : লিঙ্ক t.ly/fxn1।
১৯৬০ এর দশক থেকে আফ্রিকা জুড়ে ফরাসি উপনিবেশগুলো মুক্ত হতে শুরু করলেও নানান রকম চুক্তি ও শর্তের মধ্য দিয়ে ফরাসিরা তাদেরকে কার্যত অধীনস্ত করে রেখেছে। কেননা, ফরাসী রাষ্ট্রপ্রধানরাও মনে করতেন, আফ্রিকার উপনিবেশগুলোকে নিজ কর্তৃত্বে না রাখতে পারলে ফ্রান্স উন্নত বিশ্বে ঠাঁই পাবে না। আইভরি কোস্টের মত কোন কোন সম্পদশালী সাবেক উপনিবেশকে স্বাধীনতা দেয়ার ঠিক আগে ফ্রান্স সেখানকার সংসদীয় রীতি বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতি ধরনের শাসন কায়েম করে, কেননা একটা সংসদকে নিয়ন্ত্রণ করবার চাইতে ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজতর। অনেকগুলো অভ্যূত্থান ও সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে, এবং প্রয়োজনে জনপ্রিয় ও সংস্কারকামী রাষ্ট্রপ্রধানদের হত্যা করে পছন্দমত শাসকদের বসানো, অপছন্দের শাসকদের উৎখাত কিংবা যু্দ্ধ জিইয়ে রাখার নীতিই হলো আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে 'ফ্রাঙ্কাফ্রিকানা' নামে পরিচিত আফ্রিকার এই রাষ্ট্রগুলোর সাথে ফ্রান্সের বিশেষ সম্পর্কের সারবস্তু। ফ্রান্সের প্রশিক্ষিত ও নিয়ন্ত্রিক সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য অভ্যূত্থান থেকে রেহাই পেতে এই রাষ্ট্রপ্রধানরা ফরাসি কোম্পানিগুলোকে খনিজ আহরণ, প্রকল্প নির্মাণ ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে একচেটিয়া ব্যবহার অধিকার দিয়ে রেখেছেন। ইউরেনিয়ামসহ নানান খনিজ সম্পদের ওপর তাই আজও এই দেশগুলোর সামান্যই নিজস্ব অধিকার আছে। অতি সাম্প্রতিক কালেও এই দেশগুলোকে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার অর্ধেক ফরাসী খাজাঞ্চিতে জমা রাখতে হতো, কার্যত এখন নতুন নামে সেটাও পুনর্নবায়ন করেছে ফ্রান্স। এই অর্থও আবার অনুদান ও ঋণ হিসেবেই আফ্রিকাতে আসে। আরও মর্মান্তিক হলো, দেশগুলোর কাছে কোন হিসেব নেই এভাবে কত পরিমান অর্থ স্বাধীনতার পর থেকে নেয়া হয়েছে।
বছরের পর বছর ধরে আফ্রিকার এই দেশগুলোতে যে শোষণ ফ্রান্স চালিয়ে এসেছে, তারই অনিবার্য ফল হলো অসন্তোষ ও বিদ্রোহ, এবং এই বিদ্রোহগুলো প্রায়শঃই ধর্মনিরপেক্ষ ফরাসি রাষ্ট্রের নির্যাতনের প্রতিবাদেই ধর্মীয় চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়। এটাকে আবার অঞ্চলটিকে সামরিকায়নের জন্য ফ্রান্স যৌক্তিকতা হিসেবে ব্যবহার করে। ফরাসীরা এই কারণেই একটি বিপুল সেনা উপস্থিতি আফ্রিকাতে মজুদ রাখে। অনুগত্যের বিনিময়ে এদেশগুলোর শাসকদের দুর্নীতি ও লুণ্ঠন এবং বিরোধীদের নির্যাতন বিষয়েও ফ্রান্স চোখ বুজে থাকে।
বিশ্বব্যাপী মার্কিন প্রভূত্বের কারণেই আফ্রিকা জুড়ে ফরাসি কর্মকাণ্ড সামান্যই আলোচনায় এসেছে এতদিন। বাকি দুনিয়ার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে চাইলেও লি পেন প্রকাশ্যেই ফ্রান্সের উপনিবেশ রক্ষা করতে চান, অন্যদিকে মাখোঁ বহুবার মুখে মুখে উপনিবেশিক আমলের ভুলের প্রতিবিধানের কথা বললেও কার্যত কোন বাস্তব অগ্রগতি ঘটেনি। অনেকেই মাখোঁর মাঝে একটা বদলের ইঙ্গিত দেখলেও তিনি আসলেই প্রথাগত ফরাসি উনিবেশিক বুদ্ধিবৃত্তিকরই প্রতিনিধি। নির্বাচিত হবার পরপরই আফ্রিকা কেন দরিদ্র, তার কারণ ব্যাখ্যা করতে তিনি বলেছিলেন, "আফ্রিকার সমস্যাটা সভ্যতাজনিত... সেখানকারী নারীরা সাত-আটটা করে প্রসব করেন।" ফ্রান্সের জন্য একটি শাঁখের করাত হলো নতুন প্রজন্মের আফ্রিকার তরুণ জনগোষ্ঠীর কাছে ফ্রাঙ্কাফরিককে বৈধ করার প্রয়াসে অনুতাপ করতে হয় উপনিবেশিক অতীতের জন্য, অন্যদিকে নিজ দেশের উগ্রজাতীয়তাবাদী ভোটারদের কাছে সেজন্য আবার ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়। ঠিক এমনটি ঘটেছে আলেজরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে নিপীড়নের জন্য মাখোঁর অনুশোচনার ঘটনাটিতে, এর পরপরই তিনি নিজের ভোটারদের অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। বস্তুত আফ্রিকার এই অংশের রক্তপাত ও দারিদ্রের জন্য যে ফরাসী অর্থনৈতিক শোষণ ও লুণ্ঠন প্রধানত দায়ী, সেখানে উলটো ফ্রান্সের সভ্যতাবিস্তারী ভূমিকা আবিষ্কার করাই সাধারণ ফরাসী বুদ্ধিবৃত্তিক অভ্যাস, ম্যাখোঁ তার থেকে ব্যতিক্রম নন।
কিন্তু আফ্রিকার ময়দানে সেই বাস্তবতার অবসান ঘটেছে ধীরে ধীরে। করোনার মহামারীর কারণে ফরাসি অর্থনীতি যেমন সঙ্কটের মাঝে পড়ছে, তেমনি নানান কারণেই বিশ্বরাজনীতিতে ফরাসি ভূমিকাও ক্ষয়িষ্ণু হয়ে আসছে। ফ্রান্কোফ্রিক বন্দোবস্তের কোন গুরুত্ব নতুন বিশ্বব্যস্থায় নেই, চীন সহ নানান দেশ 'ফ্রান্সের প্রভাববলয়' নামে পরিচিত অঞ্চলে নানান বিকল্প অর্থনৈতিক বন্দোবস্ত ও চুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হচ্ছে। সেই হিসেবে বলা যায়, পুরনো ফ্রান্সের এক রকম অবসানের সূচনা আমরা দেখতে পাচ্ছি। উত্তরোত্তর নতুন নতুন বাস্তবতার মোকাবেলা তাকে করতে হবে। নতুন দুনিয়ায় টিকে থাকতে হলে ফ্রান্সকে এবার মানসিকভাবেও মেনে নিতে হবে যে, পুরনো উপনিবেশিক যুগের অবসান ঘটেছে। ফ্রান্সের এই উগ্রজাতীয়তাবাদী মোচড় এই বদলে যাওয়া বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে না নিতে পারার ব্যধিরই উপসর্গ।
৬.
বাক স্বাধীনতার প্রশ্নটি যথেষ্টই স্পর্শকাতর। রাষ্ট্র হিসেবে ফ্রান্স যে অনালোচিত কিন্তু ভয়াবহ একটি বন্দোবস্ত আফ্রিকায় চালিয়ে এসেছে, তারই পরিণতি দেশটির বিশেষ সামাজিক গঠন। মাখোঁর বক্তব্যটিকে ফ্রান্সের পূর্বাপর পুরো প্রেক্ষিত দিয়ে বিচার করতে হবে। দার্শনিকদের রাষ্ট্র হিসেবে যে দেশটাকে আমরা চিনি, চিনি বাকস্বাধীনতার পীঠস্থান হিসেবে, শিল্পকলার কেন্দ্র হিসেবে, এই তার উলটোপিঠ। এই সামাজিক গঠনে লি পেনদের মত উগ্র জাতীয়তাবাদীদের উত্থান ঘটবে, সেটা খুব স্বাভাবিক। একই সাথে ক্ষয়িষ্ণু ফ্রান্সের বিপর্যয়কর লিবিয়া ও সিরিয়া নীতি শরণার্থীদের ঢল নিয়ে এসে পরিস্থিতিতে আরও বিপদজনক করে তুলেছে। ফলে ফ্রান্স পরিণত হয়েছে সম্ভাব্য ডানপন্থী উত্থানের একটি বড়সড় ক্ষেত্রে।
উগ্রজাতীয়তাবাদ ফ্রান্সকে অবশ্য সামান্যও সুবিধা দেবে না। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প বা ভারতে মোদী যেমন বহুক্ষেত্রে দেশকে বিভাজিত করেছেন ঐক্যবদ্ধ করবার বদলে, এবং বিশ্বে তার প্রভাব ক্ষুণ্ন করেছেন, মাখোঁ আর লি পেন সম্ভবত তারও বেশি কিছু করবেন। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ভিন্ন ধর্ম ও জাতি বিষয়ে ট্রাম্প ও মোদী কাছাকাছি রকমেরই মন্তব্য করেছেন। ব্যক্তির অপরাধের (এমনকি তা যদি হত্যাকাণ্ডের মত ভয়াবহও হয়), চাইতে অনেক বিপদজনক রাষ্ট্রনায়কদের কাছ থেকে এমন বার্তা আসা যা ভবিষ্যতে আরও বিভাজন ও বিদ্বেষের খনি হিসেবে কাজ করবে। যে কারণে ফ্রান্সে (এবং সাধারণভাবে ইউরোপে) ইহুদিবিদ্বেষী বক্তব্য আইনবিরুদ্ধ, সেই একই অধিকার সকল জাতিরই থাকা উচিত। অথচ ফ্রান্সে অসাম্প্রদায়িকতার নামে বোরখার মত পোষাকের ওপর অবমাননাকর বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, যেটা ইংল্যান্ড বা জার্মানির মত ইউরোপীয় রাষ্ট্রে করা হয়নি। অন্যের জন্য ক্ষতিকর নয়, এমন যে কোন সংস্কৃতি ও বক্তব্য ব্যক্তিনাগরিকের অধিকার হিসেবে থাকবে, এটাই গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র। রাষ্ট্র হিসেবে এর ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করবার এখতিয়ার সংরক্ষণ করে ফ্রান্স কার্যকরভাবে তার বর্ণবাদী ও জাতিবিদ্বেষী উপনিবেশিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছে। রাষ্ট্র কোন জনগোষ্ঠীকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করবে না, খলনায়ক হিসেবে দেখাবে না বা পৃথকীকরণ করবে না-- সেই রকম আদর্শ কোন ব্যবস্থা ফ্রান্সে আগেও অনুপস্থিত ছিল। কিন্তু যেটুকু আড়াল তার সামনে হাজির ছিল, সেটার অপসারণ ঘটেছে।
এ যাবত কাল ফরাসী 'উদারতাবাদ' যে লুণ্ঠনের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে ছিল, তার ক্রমশঃ দুর্বল হয়ে যাওয়া হয়তো ফরাসিদের নতুন আর্থ-সামাজিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করবে, যেখানে তাদের বাঁচতে হবে নিজেদের নিজস্ব যোগ্যতার ওপর ভিত্তি করেই, বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তার করতে হলে তাও করতে হবে নতুন কোন সমাজব্যবস্থার জোরেই। সেই সংস্কৃতি ও সভ্যতাই প্রকৃত উদারনৈতিক ও অসাম্প্রদায়িক, যার জ্বালানি একটা গোটা মহাদেশকে লুণ্ঠন করে আহরিত হয় না। তেমন একটি সভ্যতা ফ্রান্স গড়ে তুলতে এখনো সক্ষম হয়নি।