যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনী আইন পরিবর্তনের নয়া-রাজনীতি ও ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ
হঠাৎ করেই বিশ্ব গণমাধ্যমের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহতম অঙ্গরাজ্য টেক্সাস । অঙ্গরাজ্যটির কংগ্রেস টেক্সাসের প্রচলিত নির্বাচন আইনের পরিবর্তন আনতে চায়। 'ডাকযোগে' ভোট ও 'অনুপস্থিত' ভোট ইত্যাদি প্রশ্নে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট দলের প্রতিনিধিরা মুখোমুখি অবস্থান নেন।
রাজ্য প্রতিনিধি সভায় বিষয়টি ভোটাভুটিতে গেলে ডেমোক্রেটদের নিশ্চিত পরাজয় জেনে ডেমোক্রেট সদস্যরা এক বিশেষ বিমানে রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি'তে চলে যান। রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পরিচালিত কয়েকটি রাজ্যের অন্যতম টেক্সাস। বিতর্কিত নির্বাচনী আইন প্রণয়ন নিয়ে এই নাটকীয়তা শুরু হয় গত সপ্তাহে, যখন টেক্সাসের রিপাবলিকান গভর্নর গ্রেগ অ্যাবোট আইনসভার বিশেষ অধিবেশন আহবান করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে এই ক্ষমতা একমাত্র টেক্সাস গভর্নরের রয়েছে। গভর্নরের ৩০ দিনের এই বিশেষ অধিবেশনে সবাই অংশ নিতে বাধ্য।
গত ১৩ জুলাই রাজ্যটির সিনেটে 'নির্বাচন নিরাপত্তা' আইনটি সংস্করণটি ১৮-৪ ভোটে পাস হয়। কিন্তু, হাউজে বিলটি আটকে যায় ডেমোক্রেটদের অনুপস্থিতির কারণে। ১৫০ সদস্যের রাজ্য প্রতিনিধি সভায় ৮৩ জন রিপাবলিকান ও ৬৭ জন ডেমোক্রেট সদস্য। সংবিধান অনুযায়ী বিল পাস হতে হলে, অধিবেশনে কমপক্ষে ১০০ জন সদস্য উপস্থিত থাকতে হবে। কিন্তু, ৫১ জন প্রতিনিধি সভার সদস্য ও ৯ জন সিনেট সদস্য একযোগে রাজ্য ত্যাগ করায় প্রক্রিয়াটি থেমে যায়। অথচ, বিলটি আইনে পরিনত হতে হলে উভয় কক্ষেই পাস হতে হবে।
এ প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় ভীষণ ক্ষেপেছেন গভর্নর গ্রেগ অ্যাবোট। তিনি বলেন, 'তারা ফিরে আসা মাত্র গ্রেফতার করা হবে।'
রিপাবলিকানরা মনে করেন, ডাক ভোট এবং অনুপস্থিত ভোটোরের ভোটদান সুবিধা ডেমোক্রেটরা বেশি পেয়ে থাকে, ফলে আইন করে এটা বন্ধ করতে হবে। প্রস্তাবিত আইনে আরো বলা আছে, নির্বাচনী কর্মকর্তা নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ পেলে নির্বাচনের ফল উল্টে দিতে পারবে। অন্যদিকে, ডেমোক্রেটরা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলছে, এর মাধ্যমে মানুষের ভোটদানের অধিকার ক্ষুন্ন ও সংকুচিত হবে।
রিপাবলিকানরা বলছে, এই আইন নির্বাচনী নিরাপত্তার স্বার্থে' করা হচ্ছে। অন্যদিকে, ডেমোক্র্যাটরা এটাকে 'ভোটের অধিকার হরণের আইন' বলে অভিহিত করছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনে নির্বাচন সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাজ্যগুলোর নিজস্ব আইনপ্রণেতাদের হাতে। সেকারণেই এক রাজ্যে সাথে অন্য রাজ্যের নির্বাচন প্রক্রিয়ার মিল পাওয়া যায় না।
ধারণা করা হয়, গত নির্বাচনে রিপাবলিকানরা তাদের পরাজয় মেনে নিতে পারে নি। এখন তাদের রাজনৈতিক কৌশল হলো, ডেমোকক্রেটদের সম্ভাব্য সুবিধার জায়গাগুলো চিহ্নিত করা এবং তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যগুলোতে এমন রাজনৈতিক ও আইনগত সংস্কার সাধন করা -যেন অন্য পক্ষের রাজনৈতিক সুবিধা খর্ব করা যায়। এমনি রাজনৈতিক কৌশলের বিপরীতে ডেমোক্রেটরা কী কৌশল নেয়- তা এখন দেখার অপেক্ষা। তবে টেক্সাসের আইনপ্রণেতাদের অন্য রাজ্যে অবস্থান নেয়ার কৌশল যে বেশি কাজে দিবে না- তা অনুমান করা যায়। টেক্সাসের গভর্নর যতবার চাইবেন এ রকম বিশেষ অধিবেশন আহবান করতে পারবেন।
আমেরিকান সংবিধানে ক্ষমতার 'স্বতন্ত্রীকরণ' খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। টেক্সাসের গভর্নরের এই ক্ষমতা যেমন নিরঙ্কুশ; অন্যদিকে ক্ষমতার 'পরীক্ষা ও ভারসাম্যের' নীতি দুটির মধ্যে এক ধরনের সমন্বয় রক্ষা করে চলে।
যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের মূলনীতি প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র। এই ব্যবস্থায় জনগণ তাদের নিজেদের নেতা নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের শাসন করে। মার্কিন গণতন্ত্র বেশ কিছু আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত। যেমন: জনগণকে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত মেনে নিতে হবে। সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। নাগরিকদেরকে আইনি শাসন ব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করার জন্য সম্মত হতে হবে। মতামত ও ধারণার উন্মুক্ত আদানপ্রদানে কোন বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। আইনের চোখে সবাই সমান। সরকার জনগণের সেবায় নিয়োজিত হবে এবং সে ক্ষমতা জনগণের কাছ থেকেই আসবে।
আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমেরিকার প্রতিনিধি সভার সাথে ভারতের লোকসভা ও ব্রিটেনের কমন্স সভার সাথে কিছুটা তুলনা করা গেলেও আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। কোন অঙ্গরাজ্য থেকে কতজন নিন্মকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের কতজন সদস্য হবেন- তা নির্ভর করে ওই রাজ্যের জনসংখ্যার উপর।
যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো অঙ্গরাজ্যে প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য মাত্র এক জন করে, আবার কোন কোন রাজ্যে ৩৯ বা ৪৩ জন পর্যন্ত রয়েছেন।
১৯২৯ সালে আইন করে প্রতিনিধি সভার সদস্য সংখ্যা ৪৩৫ নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। মার্কিন কংগ্রেসে কোন বিল মন্ত্রী বা শাসন বিভাগ কতৃক উপস্থাপিত হয় না। আমরা বাংলাদেশ, ভারত বা যুক্তরাজ্যে দেখি মন্ত্রীরাই সাধারণত বিল উপস্থাপন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের কারণে কোন মন্ত্রী কংগ্রেসের কোন কক্ষের সদস্য নন। তারা অধিবেশনে যোগ দেন না। বিলও উপস্থাপন করতে পারেন না।
সে কারণে আমেরিকায় কোন 'সরকারি বিল' নেই। বিল উপস্থাপন করেন কোন একজন সদস্য। বিলের শিরোনামের উপর ভিত্তিকরে সংশিষ্ট স্থায়ী কমিটিতে প্রেরণ করা হয়। স্থায়ী কমিটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। কমিটি যেকোন বিশেষজ্ঞ মতামত নেওয়া থেকে শুরু করে গণশুনানী পর্যন্ত করে বিলটি চুড়ান্ত বা বাতিল করেন।
প্রতিটি বিল নিয়ে কংগ্রেসের উভয় কক্ষে চুলচেরা আলোচনা হয়। ওখানকার প্রতিনিধি সভায় কোন সংসদ নেতা নেই বা কোন ট্রেজারি বেঞ্চ নেই। ফলে নিজের মতামত নিয়ে কোন বাধা থাকে না। প্রতিনিধি সভা স্পিকারের তত্বাবধানে পরিচালিত হয়। উচ্চ কক্ষ সিনেটের ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা। কংগ্রেসের দুই কক্ষের অধিবেশন একই সাথে শুরু ও শেষ হয়। নিম্নকক্ষে পাস হওয়া বিল সিনেটে যায়্ সেখানে পাস হলে দুই স্পিকারের স্বাক্ষরে প্রেসিডেন্টের কাছে যায় এবং তিনি সম্মতি দিলে বিলটি আইনে পরিনত হয়।
প্রেসিডেন্ট বিলটি কংগ্রেসে ফেরত পাঠাতে পারেন অথবা ভেটো প্রয়োগ করতে পারেন। এখানেই আমেরিকার সংবিধানের 'ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ' এবং 'ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের' নীতির মূল ভিত্তি।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক