যে নদী শুকালো মরুতে
১৩ বছরের নদীকে গত বছর সৌদি আরবে পাঠানো হয়েছিল কাজ করতে। পাসপোর্টে ১৩ বছরের নদীর বয়স লেখা হয়েছিল ২৭।
ধন্য আমাদের দারিদ্র্য বিমোচন, ধন্য কন্যাশিশুর প্রতি পিতা-মাতার ভালোবাসা: কখনো ১৪'র মেয়েকে ৩৫-এর অভিবাসী শ্রমিক পাত্র বা ৫৪ বছরের বুড়ো চেয়ারম্যানের হাতে তুলে দেওয়া হয় সংসারে একটি খাবারের মুখ কমাতে। কখনো আবার দূর প্রবাসে গৃহকর্মীর কাজে ঝট করে বয়স ১৩ থেকে ২৭ বা এক কথায় ১৪ বছরও পাসপোর্টে বাড়িয়ে পাঠানো যায়। কিন্তু, একদা সুজলা-সুফলা বা শস্য-শ্যামলা, নদীমাতৃক বাংলার নদী দূর মরুভূমিতে গিয়ে বাঁচেনি। স্বচ্ছতোয়া নদী শুকিয়ে গেছে আর সবশেষে ফিরেছে কফিনে।
যে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে নদীকে পাঠানো হয়েছিল সৌদি আরবে কাজের জন্য, তারাই পাসপোর্টে নদীর বয়স ২৭ বছর করে দিয়েছিল। পাসপোর্টে সে ১৯৯৩ সালে জন্মেছে দেখানো হলেও পরে জানা যায় সে আসলে জন্মেছিল ২০০৭ সালে। কিন্তু বিমানবন্দরের ডেস্কে যে কর্মকর্তারা বসা থাকেন, তারা কি পাসপোর্টে নদীর বয়সের সঙ্গে তার চেহারার মিল-অমিল কিছু খেয়াল করেননি? তেরোর শিশু আর সাতাশের প্রাপ্তবয়ষ্ক নারী তো কখনোই দেখতে এক হতে পারে না।
অবশ্য চতুর মানবপাচারকারী এজেন্সিগুলো সৌদি আরবে পাঠানোর অজুহাতে পুরোপুরি বোরখা আচ্ছাদিত করে পাঠালে চট করে তেরোর শিশু আর সাতাশের নারীর পার্থক্য ধরা না-ও যেতে পারে। কিন্তু বিমান বন্দরে যাত্রীদের ছেড়ে দেবার আগে নারী সিক্যুরিটি অফিসাররাও তো থাকেন। তারা কি দেহ তল্লাশি করার সময় বোঝেননি?
বোঝা যাচ্ছে, গোটা সিস্টেমের ভেতরেই প্রচণ্ড গলদ আছে। সর্ষেতে থাকা ভূতের মতোই।
সৌদি আরবে পাঠানোর পরদিন থেকেই যে বাড়িতে সে কাজ পেয়েছিল, সেই বাড়ির মালিকেরা তাকে নির্যাতন করা শুরু করেছিল বলে নদী তার মাকে জানিয়েছিল। নদীর মা নদীকে যে রিক্রুটিং এজেন্সি পাঠিয়েছিল, তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন মেয়েকে ফেরত আনার জন্য; কিন্তু ওই এজেন্সির কাউকেই আর পাননি।
এ বছরের আগস্টে মারা গেছে নদী। সৌদি গণমাধ্যম একে 'আত্মহত্যা' বলে দাবি করলেও নদীর মা এই দাবি অস্বীকার করে বলেন, মেয়ের শবদেহের সর্বত্রই তিনি আঘাতের চিহ্ন পেয়েছেন। নদীর নিয়োগকর্তারা তাকে প্রদেয় বেতনের একটি টাকাও পরিশোধ করেনি।
নদীর এই গল্প অবশ্য নতুন কিছু নয়। 'দ্য ডেইলি স্টার'-এর সূত্রমতে, গত চার বছরে ৪৭৩ জন নারী ও কিশোরী যারা মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মী হয়ে গিয়েছিলেন সংসারে দু'টো টাকা পাঠাবেন বলে, তারা সবাই লাশ হয়ে ফিরেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশের ভেতরে সৌদি আরবেই সর্বোচ্চ সংখ্যক নারীশ্রমিক মৃত্যুবরণ করেছেন।
তবু, নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পা রাখা আমাদের জনপদ থেকে একটি কফিন আসা মাত্রই, সেই কফিনের নারী লাশটিকে প্রতিস্থাপিত করে দূর আরবে গৃহকর্মী হিসেবে যাবার জন্য আরও অনেক নারী কর্মী মুহূর্তে মিলে যায়। আমাদের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো নিজের ঘরের ভাই-বোনদের বিদেশে সবচেয়ে কম দামে বিক্রি করছে, আর সৌদি নিয়োগকর্তারা দাস শ্রমের মতো সুলভে কিনে নিতে পারছে আমাদের শ্যামল নদীদের।
ভয়ানক বিষয় হচ্ছে, গড়ে প্রতি বছর মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের একশো জন নারী শ্রমিক মারা গেলেও এ নিয়ে কারোরই যেন কোনো মাথাব্যথা নেই। গত পাঁচ বছরে মধ্যপ্রাচ্যে মারা যাওয়া ৪৭৩ জন নারী গৃহকর্মীর ভেতর ১৭৫জনই মারা গেছেন সৌদি আরবে। এদের ভেতর ৫১ জন আত্মহত্যা করেছেন। গোটা মধ্যপ্রাচ্যে সব মিলিয়ে ৮১ জন বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মী আত্মহত্যা করেছেন। এ বছরই জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ অন্তত ৬৩ জন নারী শ্রমিকের লাশ দেশে ফিরেছে এবং এদের ভেতর ২২ জনই মারা গেছেন সৌদি আরবে।
গত ১ অক্টেবর দৈনিক 'প্রথম আলো'র ইংরেজি সংস্করণে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, এ বছর বিশেষত অতিমারি বা কোভিড-১৯-এর কারণে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার অভিবাসী নারী গৃহকর্মী কাজ হারিয়ে ও বিনা বেতনে, শূন্য হাতে দেশে ফিরেছেন। এদের কেউ কেউ অতিমারির সময় মালিকপক্ষের হাতে বাড়তি নিগৃহীতও হয়েছেন।
ওই প্রতিবেদনমতে, এ বছর ১ এপ্রিল থেকে ৩ অক্টোবর নাগাদ মোট ১৭ হাজার ১৮২ জন অভিবাসী নারী গৃহকর্মী মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশ থেকে কাজ হারিয়ে দেশে ফিরেছেন। এই গৃহকর্মীদের অনেকেই জোর করে কাজ থেকে বিতাড়ন, কয়েক মাসের বেতন না দেওয়াসহ নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন। অসহায় এ নারী গৃহকর্মীরা অনেকেই আরব মালিকদের বাসায় দিনে ২০ ঘণ্টাও কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন। অতিরিক্ত শ্রমঘণ্টা কাজের জন্য বাড়তি টাকা পাওয়া তো দূরের কথা, অনেককেই চুক্তিমতে পাওনা বেতনটুকুও দেওয়া হয়নি। পাশাপাশি দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন, খাবারের স্বল্পতা এবং মালিক পরিবারের সদস্যদের হাতে যৌন নির্যাতনের ঘটনা তো রয়েছেই।
মুন্সীগঞ্জের ৩৭ বছর বয়সী নারী গৃহকর্মী ফিরোজা বেগমকে এ বছরের জুলাইয়ে সৌদি আরব থেকে দেশে পাঠানো হয়। রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে তার 'আউট-পাস' দেওয়া হয়। কাজ থেকে ছাঁটাইয়ের আগের পাঁচ মাসের বেতন মালিকপক্ষ তাকে দেয়নি এবং তার পাওনা বেতনের পরিমান ৫ হাজার সৌদি রিয়াল বা ১৩০০ মার্কিন ডলার। ঘর-গেরস্থালীর সব কাজ করেও মালিকপক্ষের কাজ থেকে বেতন তো মেলেইনি, উল্টো মালিকের তিন মেয়ে প্রায়ই তাকে মারধর করত।
২০১৯-এর জুলাইয়ে দেশের এক রিক্রুটিং এজেন্সিকে নগদ ৩০ হাজার টাকা দিয়ে সৌদি আরবে গিয়ে পাওয়া এই অভিজ্ঞতা ফিরোজার জন্য খুব সুখকর হয়নি। অতিমারিতে চাকরি থেকে ছাঁটাই না করার জন্য অনেক অনুরোধ করলেও মালিকপক্ষ তাকে জোর করে দেশে পাঠিয়ে দেয়।
বরিশালের হাসি সৌদি আরবে এক বাড়িতে প্রতি মাসে ২০০ ডলার বা ৮০০ রিয়াল বেতনে কাজ করেছেন। তবে, ওদেশ থেকে চলে আসতে বাধ্য হবার আগের মাস বা জুলাই মাসের শেষ ২০০ ডলার বেতন হাসি পাননি। দিনে কখনো কখনো ২০-২২ ঘণ্টাও কাজ করতে হয়েছে হাসিকে। কখনো কখনো এমনকি ভালোমতো ঘুমানোর সুযোগও মেলেনি তার।
এমন আরেক গৃহকর্মী পারুল আখতার (৩২) লেবানন থেকে এ বছরের আগস্টে চাকরি হারিয়ে দেশে ফেরেন। শেষ আট মাস মালিকপক্ষ তাকে কোনো বেতন দেয়নি। করোনার কারণে লেবাননে এখন কাজের সংকটও রয়েছে।
আট বছর আগে পারুল লেবাননে গিয়েছিলেন একটি রিক্রুটিং এজেন্সিকে ৪৫ হাজার টাকা প্রদানের মাধ্যমে। তখন তার মাসিক বেতন ছিল ১৫০ ডলার। প্রতি মাসে শুধু মালিক নয়, মালিকের নানা আত্মীয়ের বাড়িতেও তাকে কাজ করতে হয়েছে।
গত দু'বছর ধরেই নিয়মিত বেতন পাননি পারুল। ছাঁটাই হবার আগের শেষ আট মাস মূল মালিকের এক আত্মীয়ের বাড়িতে তাকে কাজ করতে হয়েছে, যেখানে বেতন তো দূরের কথা, ঠিকমতো খাবারও খেতে পাননি তিনি। বকেয়া পাওনার কথা বলতে গেলে উল্টো মালিকপক্ষের প্রহার জুটেছে কপালে। পারুলের বকেয়া বেতনের মোট পরিমাণ ৪ হাজার মার্কিন ডলার।
ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের (বিএমইটি) একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত দশ লক্ষ বাংলাদেশি নারী বিদেশে গেছেন। এদের শতকরা আটানব্বই ভাগই গৃহকর্মী ও বাকি মাত্র দুই শতাংশ মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশে পোশাক শ্রমিক হিসেবে যাচ্ছেন।
১৯৯০ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার কর্তৃক গৃহীত 'ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন দ্য প্রটেকশন অব দ্য রাইটস অব অল মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স অ্যান্ড মেম্বার্স অব দেয়ার ফ্যামিলিস'-এ 'অভিবাসী শ্রমিক ও তার পরিবারে'র সুরক্ষা বিষয়ক নানা অনুচ্ছেদ থাকলেও একাকী অভিবাসী নারী শ্রমিকের ভিনদেশে মালিকপক্ষের দৈহিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন থেকে আত্মরক্ষার নানা উপায় বিশদভাবে বলা হয়নি বলেই মনে হয়। সেটা তখনো এত বিপুল পরিমাণে তৃতীয় বিশ্ব থেকে অদক্ষ নারী শ্রম ধনী দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েনি বলেই হয়তো তাদের বিষয়টি সেভাবে আসেনি।
২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘে সিডও সনদের যে অষ্টম প্রতিবেদন পাঠানো হয়, তার প্রেক্ষিতে জাতিসংঘের সিডও কমিটি তাদের প্রেরিত 'সমাপনী মন্তব্য প্রতিবেদনে'র ২০নং অনুচ্ছেদে নারী ও কিশোরীদের বিদেশে পাচার ও পতিতাবৃত্তিতে অবৈধ ও ছদ্মবেশী নানা রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো যেন ফায়দা ওঠাতে না পারে, সে বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকতে বলেছে। ২০১৭-এর সেপ্টেম্বরে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের যে বিপুল ঢল আমাদের দেশের কক্সবাজার অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়েছে, সেই শরণার্থীদের শিবিরগুলো থেকে কক্সবাজারের নানা হোটেলে অসহায়, উদ্বাস্তু নারীদের অভ্যন্তরীণ পাচারসহ বিদেশেও তাদের বিপুলহারে পাচারের একটি চোরাপথ কিন্তু রয়েই গেছে। সে বিষয়েও আমাদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
ঢাকায় অবস্থানকালে ব্রিটিশ সিভিল সার্জন জেমস ওয়াইজ রচিত (১৮৮৩) 'পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জাতি, বর্ণ ও পেশার বিবরণ'-এর ভূমিকাতেই ওয়াইজ বাংলার গণমানুষের বিপুল ধর্মান্তর সম্পর্কে লিখেছেন, 'বাংলা কখনোই খাঁটি আর্যদের ছিল না।... আর কোথাও হিন্দু ধর্ম এত অনাচারগ্রস্ত হয়নি। অথবা এত অধঃপতিত হয়নি। আর কোথাও গণমানুষকে হেয় জ্ঞান করে এত দূরে সরিয়ে রাখা হয়নি। এত অমানবিক আচরণ করা হয়নি কোথাও।'
যে লক্ষ লক্ষ কোটি মানুষ একসময় এই ব-দ্বীপে হয়তো গভীর অভিমান ও দ্রোহ থেকেই এবং ন্যূনতম সামাজিক সমতার আশায় দূর মরুদেশ থেকে আসা সৈন্য, বণিক ও সূফী সাধকদের প্রভাবে নিজের অতীত নাম-পরিচয় মুছে ফেলে গ্রহণ করেছেন নতুন পরিচয়, নাম ও বিশ্বাস এবং শুধুই অতীত মায়া থেকে হয়তো পোশাকি নামের পাশে ডাকনামটি যাদের থেকে যায় বাংলা ভাষায়, দূর আরব নানা কারণেই তাদের কাছে পূণ্যভূমি। বর্ণাশ্রমের ভয়াবহতা এ দেশে বসে না বুঝলেও, অন্তর্জালে ওপার বাংলার সবচেয়ে প্রাগ্রসর অংশেও আজকের দিনেও নিতান্ত পদবী নিয়ে সূক্ষ উচ্চন্মন্যতা-হীনন্মন্যতার অবিশ্বাস্য নানা প্রকাশ বা আজো সেদেশে দ্বিজ থেকে মতুয়াসহ নানা বর্গে মানুষকে বিচার করার ভয়ানক আয়োজন দেখলে স্তম্ভিত হতে হয়।
এই জনপদের লক্ষ লক্ষ নদীর মতো মেয়েদের পূর্বপুরুষ তাই এক সময় বিশ্বাস বদলেছেন আর তাদেরই উত্তরসূরীদের অনেকেই আজ 'পূণ্যভূমি' আরবে তাই সন্তান-সন্ততিকে পাঠাচ্ছেন সেইসব দেশে কাজ করতে- সরল বিশ্বাসে এবং খানিকটা স্বচ্ছলতার আশায়। কিন্তু সেই দূর মরুতে গিয়েও বাঁচতে পারছে না তারা। শুকিয়ে গিয়ে, আহত-নির্যাতিত-অবমানিত হয়ে কফিনে ফিরতে হচ্ছে তাদের।
আমাদের অভিবাসী সব নারী গৃহকর্মীর জীবন-সম্মান রক্ষায় সরকারকে সচেষ্ট হতে আবেদন জানাই।
- লেখক: কথাসাহিত্যিক