শিক্ষাবাজেট কেন বরাবর কম হবে?
২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে শিক্ষার জন্য অন্যান্য বছরের তুলনায় বাড়তি বরাদ্দ প্রত্যাশিত ছিলো। বিশ্বব্যাপী জাতীয় বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ বা জিডিপির ৬-৮ শতাংশ শুধু শিক্ষার জন্য বরাদ্দের কথা বলা হয়, কিন্তু বাংলাদেশে বরাবরই প্রয়োজনের তুলনায় কম বরাদ্দ দেওয়া হয় শিক্ষাখাতে। করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, করোনার কারণে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যে ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করেছে ও করছে, করোনা-পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থায় সেগুলো আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি, দেখা দিতে পারে কিছু বাড়তি সমস্যাও যেগুলো হয়তো এই মুহূর্তে আন্দাজ করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া একটি বড় সমস্যা; বিশেষ করে মেয়ে-শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি। করোনার কারণে সমস্যাটি অনেকটাই বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। মনে রাখা ভালো, এটি কেবল বাংলাদেশেরই সমস্যা নয়, বৈশ্বিক সমস্যাও বটে। ফলে, শিক্ষাব্যবস্থার নানা সমস্যা সমাধানে বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দের দাবি উঠেছিলে নানা মহল থেকে, যাতে এখন থেকেই এসব সমস্যা মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করা যায়।
২০২০-২১ সালে যখন বাজেট পেশ করা হয়, তার কিছুদিন আগে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও করোনা আঘাত হানে। মাত্র দুই মাসের লকডাউনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই সে-সময়ে শিক্ষাব্যবস্থার যেসব সমস্যা আন্দাজ করা হচ্ছিলো, তার প্রায় সবগুলোই এখন বাস্তবতা। তখনই জাতীয় বাজেটে শিক্ষার জন্য বাড়তি বরাদ্দের কথা বলা হয়েছিলো। কিন্তু, ২০২০-২১ সালের বাজেটে করোনা-পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি; বরং স্বাভাবিকভাবে শিক্ষাখাত যেরকম বরাদ্দ পায়, তারই প্রতিফলন দেখা গিয়েছিলো বাজেটে। এই এক বছরে শিক্ষার যে হতাশাজনক চিত্র দেখা গেছে, তা থেকে সহজেই বোধগম্য যে, করোনার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাব্যবস্থা সরকারের সুদৃষ্টি লাভে সমর্থ হয়নি।
২০২০-২১ অর্থবছরে শিক্ষার জন্য মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিলো ৬৬৪০১ কোটি টাকা যা সংশোধিত বাজেটে নেমে আসে ৬৬২০৭ কোটি টাকায়। মোট বাজেটের হিসেব অনুসারে মাত্র ১২.২৮ শতাংশ বাজেট শিক্ষাখাতে খরচ হয়েছে এবং জিডিপির হিসেবে এই হার ২০২০ সালে বাজেট পেশের সময় ২.০৯ শতাংশ ও ২০২১ সালে সংশোধিত বাজেটে ২.১৪ শতাংশ। পূর্বে যে জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ বা জিডিপির ৬-৮ শতাংশ বরাদ্দের কথা উল্লেখ করা হয়েছিলো, সেই তুলনায় বরাদ্দকৃত বাজেটের পরিমাণ অনেক কম। করোনা-মোকাবিলার পরিস্থিতিতে আরও বেশি আশা করা হলেও সেটির প্রতিফলন দেখা যায়নি।
একই চিত্র দেখা গেছে ২০২১-২২ অর্থবছরেও। এই নিবন্ধের সঙ্গে যুক্ত ছকটিতে জাতীয় বাজেটে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের জন্য বরাদ্দ বিভিন্ন খাতের হিসাব তুলনা করে দেখানো হয়েছে। এ থেকে দেখা যায়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৬৩১৪ কোটি টাকা। টাকার হিসেবে পরিমাণে প্রায় চারশ কোটি টাকা বাড়লেও মোট বাজেটের অনুপাতে এই বরাদ্দ গতবারের তুলনায় কম। অর্থাৎ করোনাকালে যেখানে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজন ছিলো, সেখানে উল্টো বাজেট কমে গেছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে কিছুটা বেড়েছে মনে হলেও এই বরাদ্দ মূলত স্বাভাবিক সময়ের বরাদ্দের মতোই; তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি সেখানে দৃশ্যমান নয়। করোনাকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোনো বরাদ্দ এই দুই বিভাগে দেওয়া হয়নি।
এদিকে শিক্ষার সাথে গতবছর যেমন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের বাজেট জুড়ে দেওয়া হয়েছিলো, এবারের বাজেটেও তাই করা হয়েছে। এতে শিক্ষাবাজেটের ছকে বরাদ্দের পরিমাণ একটু বেশি দেখা গেলেও আদতে এই দুটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের খরচ ও কার্যক্রম একেবারেই আলাদা। শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির জন্য সমন্বিতভাবে জাতীয় বাজেটের ১৫.৭২ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হলেও সেখান থেকে শেষোক্ত দুটো বাদ দিলে শুধু শিক্ষার জন্য বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র ১১.৯২ শতাংশ। এই হার ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায়ও কম।
২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপির পরিমাণ ৩৪৫৪০৪০ কোটি টাকা। জিডিপির হিসেবে ২০২০-২১ অর্থবছরে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিলো ২.০৯ শতাংশ যা সংশোধিত বাজেটে বেড়ে দাঁড়ায় ২.১৪ শতাংশে। বর্তমান বাজেট বক্তৃতায় শিক্ষার জন্য বরাদ্দ মাত্র ২.০৮ শতাংশ যা পূর্বের বাজেটের তুলনায় কম। অর্থাৎ যেভাবেই হিসাব করা হোক না কেন, শিক্ষার জন্য বাজেটে বরাদ্দ কম রাখা হয়েছে।
এই শিক্ষাবাজেট আলোচনার প্রসঙ্গে কিছু পূর্বের অভিজ্ঞতাও উল্লেখ করা প্রয়োজন। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ যখন সংসদে গৃহীত হয়, তখন শিক্ষানীতির বিভিন্ন কৌশল কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সেই প্রসঙ্গটিও আলোচিত হয়েছিলো। এ বিষয়ে একাধিক প্রস্তাব সরকারি মহলে আলোচিত হয়। এসব নানা প্রস্তাবের মধ্যে একটি যৌক্তিক প্রস্তাব ছিলো— শিক্ষানীতির কৌশলগুলো একত্রে বাস্তবায়ন না করে ২০১০ সাল থেকে ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হোক এবং ২০১৮ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের কাজ পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করা হোক। সেই বছর যে বাজেট প্রদান করা হয়, সেখানে আশা করা হয়েছিলো, শিক্ষানীতিকে সামনে রেখে বাজেটে শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ প্রদান করা হবে যা থেকে প্রমাণিত হবে শিক্ষানীতির কৌশলগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে। কিন্তু সে বছর তো নয়ই, তার পরবর্তী কোনো বছরেই শিক্ষানীতির প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনায় রেখে বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করা হয়নি। ফলে প্রায় ১১ বছর পরও শিক্ষানীতির অনেক প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়নি; এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাথমিক উদ্যোগই গ্রহণ করা হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষার আওতা বাড়িয়ে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করার বিষয়টি এক্ষেত্রে বড় উদাহরণ হিসেবে পেশ করা যায়। করোনার ক্ষতি আপাতত বাদ দিয়ে অন্তত এই দিকটিকে যদি ফোকাস করা হয়, তাহলেও বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দের পরিমাণ বাড়িয়ে অন্তত ২০ শতাংশ করা প্রয়োজনের প্রসঙ্গটি বলতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, বর্তমান শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে এক যুগের কাছাকাছি এবং সাম্প্রতিককালে শিক্ষানীতি পরিমার্জন বা নতুন অনেক কিছু যুক্ত করার কথা বলা হচ্ছে। সময়ের চাহিদায় এখন আরও এমন অনেক নতুন উপাদান শিক্ষানীতিতে যুক্ত হতে পারে যার জন্য বাজেটে আরও অধিক বরাদ্দের প্রয়োজন। কিন্তু দিনের পর দিন শিক্ষাবাজেটে বরাদ্দ যদি এভাবেই দেওয়া হতে থাকে, তাহলে শিক্ষার জন্য আনুপাতিক হারে বরাদ্দ কমে যাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করতে চাইলে বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর যেমন বিকল্প নেই, তেমনি বাজেট যাতে যথাযথভাবে ব্যয়িত হয়, সেই দিকেও নজর দেওয়া জরুরি।
করোনার কারণে শিক্ষার কী কী ক্ষতি ইতোমধ্যে হয়েছে এবং ভবিষ্যতে হতে পারে, সেগুলোর সাথে বাজেটে অধিক বরাদ্দের সম্পর্কটুকুও এখানে আলোচনা করা প্রয়োজন। আমরা দেখেছি যে, করোনার কারণে এক বছর তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ। বিকল্প উপায়ে লেখাপড়া চালানোর ব্যবস্থা কোথাও কোথাও করা হলেও তা কতোটুকু কার্যকর সে বিষয়ে বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন। ইতোমধ্যে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেসরকারি অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। ননএমপিওভুক্ত ও বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বেতন পাচ্ছেন না। শিক্ষক ছাঁটাই হয়েছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্যও অর্থের প্রয়োজন। শিক্ষকদের শিক্ষার মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন হবে বাড়তি প্রশিক্ষণের। অবকাঠামোগত উন্নয়নের চাহিদাও রয়েছে। শিক্ষার্থীরা যাতে ঝরে না পড়ে সেজন্য নিতে হবে বিশেষ ব্যবস্থা। এসব বিষয় নিয়ে শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারাবিশ্বেই আলোচনা চলছে অনেক।
প্রতি বছর এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে গ্লোবাল ক্যাম্পেইন ফর এডুকেশন শিক্ষাবিষয়ক গ্লোবাল অ্যাকশন সপ্তাহ পালন করে। এবারের গ্লোবাল অ্যাকশন সপ্তাহের স্লোগান ছিলো 'শিক্ষার জন্য অধিক ও মানসম্মত বিনিয়োগ', যেখানে দাতা গোষ্ঠীসহ বিশ্বের প্রতিটি দেশের সরকারকে শিক্ষার জন্য অধিক বরাদ্দের আহ্বান জানানো হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়াসহ শিক্ষার নানা সমস্যা মোকাবিলা, প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া মানুষের শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং করোনাকালীন ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষায় বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে বিশ্বের প্রতিটি দেশকে অন্তত জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ রাখার আহ্বান জানানো হয়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, করোনার কারণে শিক্ষার যেসব আশঙ্কা জাতীয়ভাবে অনুভূত হচ্ছে, সেগুলো কেবল জাতীয় বা আঞ্চলিক সমস্যা নয়, সেগুলো একই অর্থে বৈশ্বিক সমস্যাও্। শিক্ষার জন্য অধিক অর্থায়ন ও বিনিয়োগের জন্য অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ সরকারের কাছেও আহ্বান জানানো হয় এবং আশা করা হয়েছিলো, করোনা-বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে এবারের বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করা হবে।
কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে, তা কোনোভাবেই করোনার ক্ষতি মোকাবিলার উপযোগী করে তৈরি হয়নি। শিক্ষাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য নেই শিক্ষাভিত্তিক নির্দেশনাও। স্বাভাবিক সময়ে যে বাজেট বরাদ্দ করা হয় শিক্ষার জন্য, এবারেও তা-ই দেখা গেছে; বরং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যে পরিমাণে বাজেট কমেছে, তার প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক শিক্ষাবাজেটে। ফলে, করোনায় শিক্ষার যে ক্ষতি হয়েছে, সেগুলো সামাল দেওয়া কষ্টকর হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের শিক্ষা পিছিয়ে পড়বে কি না, সেই আশঙ্কাও এক্ষেত্রে অমূলক নয়। বাজেট ঘোষিত হলেও সরকারের সুযোগ রয়েছে নানাভাবে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর। আশা করবো, করোনার বড় ক্ষতিকে মোকাবিলা করার জন্য সরকার শিক্ষাখাতের অর্থায়নকে বড় গুরুত্ব প্রদান করবে।
- লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
- ইমেইল: [email protected]