‘সব চড় নিজের গালেই ফিরে আসে’
পীরগঞ্জের ভিডিওচিত্র দেখার পর কাল সারারাত আর ঘুম এলো না। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে, গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। মনে হল ঘরে পরিবার-পরিজন নিয়ে আমরা আরাম করে ঘুমাচ্ছি, আর অন্যদিকে এই মধ্যরাতে আমাদেরই মতো অসংখ্য মানুষের বাড়িঘর নিষ্ঠুরতার আগুনে জ্বলছে। কতগুলো অসহায়, দরিদ্র ও আশ্রয়হীন মানুষের বাঁচার জন্য চিৎকার, ঘরবাড়ি রক্ষার জন্য আর্তনাদ যেন মগজের মধ্যে ঢুকে গেল।
পীরগঞ্জের যে এলাকাগুলোতে "ইসলাম ধ্বংসের" কথা বলে হামলা চালানো হয়েছে, সেখানে খুব দরিদ্র, নিপীড়িত মানুষের বাস। যারা নিজেদের জীবনই চালাতে পারেননা, যারা পূজার মতো উৎসবে সন্তানকে একটা ভাল কাপড় কিনে দিতে পারেন না, যারা নিজেদের সমাজেই গোত্রহীন- সেই মানুষগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে ইসলাম ধর্মঅবমাননার।
কারো ঘরে যখন আগুন লাগে, কারো ক্ষেতখামার যখন পুড়িয়ে দেয়া হয়, কারো দোকানে হামলা চালিয়ে লুটপাট করা হয় এবং সর্বোপরি পরিবারের শিশু ও নারীরা নিজেদের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালানোর চেষ্টা করে, তখন সেই চিত্র হয় ভয়াবহ। আমাদের কাছে এই অভিজ্ঞতা নতুন নয়, পুরোনো ক্ষত আমাদের জীবনে। আছে ছাইচাপা দেয়া আগুন।
আমাদের পাকিস্তানি ভাইরা, রাজাকার বাঙ্গালী ভাই মুসলিম বলে কিন্তু ১৯৭১ সালে এদেশের অগণিত নারীকে রেহাই দেয়নি। তারা আমাদের সম্ভ্রম কেড়েছে, পুরো দেশে আগুন জ্বালিয়েছে এবং লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। পীরগঞ্জ, কুমিল্লা ও নোয়াখালির চিত্র কিন্তু সেই ছবিকেই মনে করিয়ে দেয়। সেদিন যে অপশক্তি ওই নির্মম কাজ করেছিল, তারাই আজকের দিনে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
এখন তারা বেছে নিয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের। সংখ্যায় কম বলে, দুর্বল বলে, প্রান্তিক মানুষ বলে এদের উপর হামলা করা, হত্যা করা, বাড়িঘরে হামলা চালানোটা সহজ। কাজেই একবার এই মানুষগুলোকে হটাতে পারলে তাদের জায়গা জমি হাতিয়ে নেয়া সহজ হবে। এ এক রাজনীতির খেলা, এ এক দখলদারিত্বের খেলা। আজকে তারা প্রান্তিক মানুষের উপর হামলা চালাচ্ছে, সময় সুযোগ পেলে প্রগতিশীল মুসলিমদের উপরও হামলা চালায়। একে একে কতজন বুদ্ধিজীবি, লেখক, ব্লগারকে আমরা হারিয়েছি, সেই হিসাবটাও এখন ভুলতে বসেছি।
কোন আর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক জিঘাংসা থেকে কিছু অমানুষ এই নারকীয় তাণ্ডব চালাচ্ছে, সেই বিশ্লেষণে যদি নাও যাই, তাও কিছু কথা, কিছু কান্না, কিছু দংশন আমাদের মতো মানুষকে অস্থির করে তুলছে। ভয়ে, ঘৃণায়, শোকে পাথর হয়ে আছি। অধিকাংশই হয়ে আছি উটপাখি।
ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির সামনে শূন্যদৃষ্টিতে বসে থাকা পীরগঞ্জের নন্দরাণী যখন বলেন, 'বাড়ি পুড়ি ফেলাইছে, গরু নিয়া গেইছে, চাউল-ডাউল, ট্যাকা-পয়সা সব নিয়া গেইছে। সোনা আছলো এক ভরি- তাকো নিয়া গেইছে। হামরা এখন কী করি খামো বাবা, কী করি খামো।' (নিউজ বাংলা)
এই কথা শোনার পর আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে একসময়ের সহকর্মী সালমা আপার কথা। ঠিক এইভাবেই রাউজানে তাদের বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানী বাহিনী। এই আগুনে হারিয়ে গিয়েছিল তার একমাত্র ছোট ভাইটি। কোনভাবে পরিবারটি জানে বেঁচে গেলেও সব হারিয়েছিল নন্দরাণীর মতো। সালমা আপারা তাদের ভিটেমাটি কিছু ফিরে পায়নি স্বাধীনতার পর। সব অন্যের দখলে চলে গেছে।
অসংখ্য উন্মত্ত মানুষ যখন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গ্রামের চারপাশ দিয়ে ঢুকে হামলা চালায়, তখন সেই এলাকার মানুষের মধ্যে যে ট্রমা হয়, তাতে করে অসহায় মানুষ পালিয়ে বাঁচতে চায়। সহায়-সম্পত্তি সব ছেড়ে চলে যায় শুধু নিরাপত্তার কথা ভেবে। রংপুরের পীরগঞ্জের জেলে পল্লীর মাছ ব্যবসায়ী জগদীশ চন্দ্র দাস ঠিক এরকমই একজন মানুষ যিনি, এই হামলার পর তার লুট হয়ে যাওয়া বাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করছেন, "আমরা এখন কীভাবে থাকব? আমরা কি তাহলে চলে যাব?"
জগদীশ চন্দ্র দাসের মতো অনেককেই চলে যেতে হবে নিজের ভিটা ছেড়ে। কারণ হামলাকারীরা তাদের উদ্দেশ্যে গালাগালি করে বলেছে, হিন্দুদের এ দেশে থাকতে দেওয়া হবে না। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী বোঝা যাচ্ছে পীরগঞ্জ, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালিতে একই কায়দায়, একই কথা বলে হামলা চালানো হয়েছে। বাড়িঘর, সম্পত্তি, মন্দির, দেবী-প্রতিমা ঠিক একইভাবে ভাঙচুর করা হয়েছে। লাঠি ও অস্ত্র নিয়ে ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সী তরুণ-যুবকরা হামলার অগ্রভাগে ছিল।
এর মানে দাঁড়াচ্ছে যে, দেশজুড়ে যারাই এই কুকর্মগুলো করছে, তারা খুব সংঘবদ্ধভাবে করছে। তরুণদের দল যখন লাল জার্সি পরে পুলিশ-প্রশাসনের অবরোধকে উপেক্ষা করে পূজা বন্ধের দাবি জানায়, প্র্রতিমাগুলো টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলতে চায়, মণ্ডপের শামিয়ানা টেনে নামাতে চায়, তখন বুঝতে হবে এরা হঠাৎ করে উদয় হয়নি। বহুদিনের প্রস্তুতির ফল এই হামলা। তারা যে শ্লোগান দিয়েছে, তাও বেশ ভয়ংকর সময়কে ইঙ্গিত করে। এরা জনতাকে ক্রমাগত উস্কানি দিয়েছে হামলা চালানোর জন্য। বলেছে, 'বন্ধ বন্ধ, পূজা বন্ধ', 'লেগেছে রে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে'- এ আগুন আসলে ধ্বংসের আগুন।
আপনারা যারা এই লেখা পড়ছেন, আসুন একবার ভাবি যতনের চার বছরের ছেলে আধিত্যর কথা। আপনার, আমার যে কারো সন্তান হতে পারতো এই আধিত্য। শিশুটি প্রতিদিন বাবার সাথে বসে রাতের খাবার খেতো। সে জানে না ধর্ম কী, ধর্মবিদ্বেষ কী, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ কী, অন্যের সম্পত্তি দখল করা কী, ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়া কী? সে জানে বাবার সাথে খেলতে হয়, খেতে হয়, বেড়াতে যেতে হয়। ছোট্ট আধিত্যের বাবা যে আর কোনো দিন ফিরে আসবে না, তার সাথে ভাত খাবে না, খেলবে না, আদর করবে না একথা তাকে কেমন করে বোঝাবে তার মা!
গত শুক্রবার বিকালে নোয়াখালীর চৌমুহনীতে ইসকন মন্দির এবং বিজয়া সার্বজনীন দুর্গা মন্দিরে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছেন আধিত্যর বাবা যতন। নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে আধিত্যর বাবাকে। কোন ধর্ম, জাত বা বর্ণহিসেবে নয়, ভাবুন একটি সন্তান তার বাবাকে হারিয়েছে।
যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সেই বাংলাদেশকে আমরা হারাতে শুরু করেছি। এরপর থেকে সাম্প্রদায়িক ঘৃণার আগুনে দেশ বারবার জ্বলে উঠছে। ধর্ম রক্ষার দোহাই দিয়ে বারবার অর্গানাইজড ক্রাইম হচ্ছে। পাবনার সাথিয়ায়, কক্সবাজারের রামুতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে, সুনামগঞ্জের শাল্লায় এমন ঘটনাই ঘটেছিল।
বাংলাদেশে গত বুধবার থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দির, স্থাপনা ও বাড়িতে হামলার ঘটনায় ৭১টি মামলা হয়েছে এবং ৪৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। গত পাঁচ বছরে এই একই ধরনের আরো অন্তত তিনটি বড় ঘটনা ঘটেছে, যেখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননাকর পোস্ট দেবার অভিযোগ তুলে হিন্দুদের বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়েছে। অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, এসব ক্ষেত্রে, পরে তদন্ত করে দেখা গেছে ধর্মীয় অবমাননাকর পোস্টগুলোর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে সেসব ঘটনার কোনটিরই এখনো পর্যন্ত বিচার হয়নি, কোনটির তদন্ত এখনো শেষ হয়নি, কোনটি আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় আছে। এমনকী ঘটনার পর ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও এখনো হয়নি। (বিবিসি)
হয়তোবা এবারেও পীরগঞ্জ, চৌমুহনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রামের হামলারও কোন বিচার হবেনা। কিছু মানুষ শুধু হারিয়ে যাবে এই ভূখণ্ড থেকে। আজকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর, দেবালয়, সম্পত্তি যারা পুড়িয়ে দিচ্ছে এবং দখল করছে, কালকে তাদের হাত আরো সম্প্রসারিত হবে। অন্যের দেবালয় ধ্বংস হচ্ছে বলে আমরা যারা চোখ বন্ধ করে আছি, তারা আদতে কতদিন নিজের দেবালয়কে রক্ষা করতে পারবো?
একটা সময় ছিল যখন এরকম সাম্প্রদায়িক হামলা ঠেকানোর জন্য মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে পথে নেমে এসেছিল। তাই প্রতিক্রিয়াশীল চক্র খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি। যেকোন ধরণের নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে মানুষ রুখে দাঁড়াতো। কিন্তু এখন সময় বদলেছে, আমাদের বিশেষ করে তরুণ্যের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেছে। রাজপথ গরম করার পরিবর্তে আমরা সবাই সামাজিক মাধ্যম গরম করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। এ বছর দেশে ৩২ হাজারেরও বেশি পূজামণ্ডপ হয়েছে বলে, যারা আনন্দে ভাসছেন, তাদের বলি এত পূজামণ্ডপ হয়ে লাভ কী, যদি না তা নিরাপদ হয়!
দিন শেষে কবির কথাটাই সত্য,
" সব চড় নিজের গালেই ফিরে আসে
সব থুতু নিজের মুখেই মেখে বসে আছি
জীবন বা মিলনের খবর নিতেও ভয় হয়
অনিমেষ কল্যাণীতে মিলের শ্রমিক --
জমির অনেক দাম। গোপাল দাসেরা চলে গেলে
এখানে দোকানপাট হবে। উঠতি নেতারা মহড়ায় আছে
জয়ধ্বনি, জিন্দাবাদ ঘুরেফিরে আসে" ---
#সৃষ্টিসুখ
- লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন