সময় এসেছে ক্লারা জেৎকিনের নারী দিবসে ফিরে যাওয়ার
জার্মানির কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেৎকিনের প্রস্তাবে ১৯১১ সাল থেকে মার্চের ৮ তারিখ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ঘোষণাটি দেওয়া হয়েছিল ১৯১০ সালে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনে।
প্রায় ১১০ বছর পার করে এলেও ১৯১০ সালে ঘোষিত আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মূল যে বক্তব্য, সেটা অর্জন সম্ভব হয়নি। মূল বক্তব্য ছিল, শ্রমজীবী নারীদের অধিকার অর্জন করা এবং নারীর সার্বজনীন ভোটের অধিকার পাওয়া।
এ কথা পরিষ্কার করা ভালো যে, কমিউনিস্ট পার্টির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণা দিয়েছিলেন কোনো নারীবাদী বা ফেমিনিস্ট অবস্থান থেকে নয়। অর্থাৎ, এই ঘোষণা তিনি চেয়েছিলেন শ্রমিক নারীর দাবি দাওয়া পূরণের জন্যে। কারণ তিনি মনে করতেন, সেই সময়ের ফেমিনিজম ছিল শ্রমিক নারীর বিপরীতে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত নারীদের স্বার্থ রক্ষা করা। এখনো ফেমিনিজম বা নারীবাদ শহুরে মধ্যবিত্তদের গণ্ডি এবং তাদের চাওয়া-পাওয়া, নারীর অধিকারের প্রশ্নে তাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্যেই রয়ে গেছে, যা সাধারণ নারী-বিশেষ করে শ্রমিক নারীদের কাছে আদৌ পৌঁছাতে পারেনি।
ক্লারার আন্তর্জাতিক নারী দিবস এলিট বা অভিজাত নারীদের জন্যে ছিল না। শুরুতে এই দিনটি 'আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস' হিসেবেই পালিত হতো। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস ১৯০৯ সালে পালিত হয়েছে সেখানকার সোশালিস্ট পার্টির উদ্যোগে, বস্ত্র কারখানার শ্রমিকের দাবি আদায়ের প্রশ্নে।
ক্লারা ও তার সমকালীন ফেমিনিস্টরা, ফার্স্ট ওয়েভ ফেমিনিজমের (উনিশ এবং বিংশ শতাব্দী) অংশ ছিলেন। তারা মূলত নারীর ভোটের অধিকারের দাবি এবং নারী-পুরুষের অসম অবস্থার বিরোধিতা করেছিলেন। রাজনীতি ও ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে পুরুষের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল; সেখানে নারীর কোনো অংশগ্রহণ কল্পনাও করা হতো না। নারী কার্যত পুরুষের সম্পত্তির অধিক কিছু ছিল না। ভোটের অধিকারের দাবি ক্লারা এবং সমাজতান্ত্রিক নেত্রীদেরও ছিল।
ক্লারার ঘোষণার পর সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নে ৮ মার্চ নারীদের বিশেষ দিন হিসেবে পালিত হতো। দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর পর 'সেকেন্ড ওয়েভ' ফেমিনিস্টরা ১৯৬৭ সাল থেকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করতে শুরু করেন। এই সেকেন্ড ওয়েভ ফেমিনিজম (১৯৬০ থেকে ১৯৮০-এর দশক) নারীর প্রতি বৈষম্য, অসম মজুরি, অসম আইনি অধিকার ইত্যাদির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ধারণা তারাও গ্রহণ করেছিলেন নারীর প্রতি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য দূর করা এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে।
জাতিসংঘ দিবসটিকে ১৯৭৭ সালে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে বর্তমানে সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হচ্ছে। কিন্তু পুরানা ইতিহাস ও আন্দোলনের মর্ম থেকে অনেকটাই বিচ্যূত হয়ে। এই স্বীকৃতির পেছনে বিশ্বের বড় বড় দেশগুলোর মূলধারার ফেমিনিস্টদের ভূমিকা আছে। দিবসটির সাথে ক্লারা জেৎকিনের ঘোষিত দিবসের যে কারণ ছিল, তার সাথে মিল রেখে করা হয়নি। বছরের এই তারিখটি নারীদের জন্যে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়ে গেছে, সেই ধারাবাহিকতাই শুধু রক্ষা করা হয়েছে।
১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক নারী বর্ষ পালিত হয়েছিল, এবং ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক নারী দশক ঘোষিত হয়। তারই একটি অংশ হিসেবে ১৯৭৭ সালে নারী অধিকার এবং বিশ্ব শান্তির জন্যে মার্চের ৮ তারিখ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করার ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক নারী দিবস সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পালিত হয়। নারীর অধিকার আদায়ের প্রশ্ন আন্দোলন-সংগ্রামের রাজপথ ছেড়ে সরকারিভাবে দিবস পালনে গিয়ে ঠেকেছে।
এখন জাতিসংঘ থেকেই নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, কোন বছর কী বিষয় নিয়ে দিবসটি পালন করা হবে এবং সেভাবেই প্রতিটি সদস্য দেশের সরকার, এনজিও এবং নারী সংগঠনগুলো তাদের কর্মকাণ্ড নির্ধারণ করেন। কেউ উৎসবমুখর হয়ে ওঠেন, কেউ আলোচনা করেন, কেউ সংগ্রামের কথা বলেন।
আগে বেগুনি, সংগ্রামের রঙটাই ব্যবহার হতো; এখন তার সাথে শান্তির রঙ সাদা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। নারীরা অবশ্যই শান্তি চায়, কিন্তু সংগ্রামের পথ সব সময় শান্তিময় নাও হতে পারে।
ক্লারা জেৎকিনের আন্তর্জাতিক নারী দিবস যে আদতে শ্রমিক নারীর অধিকার আদায়ের জন্য, এ কথা বাংলাদেশের নারী শ্রমিকরা দীর্ঘদিন জানতেনই না। নারী সংগঠনগুলোও নারী শ্রমিকদের নিয়ে একত্রে কোনো কাজও করেনি। তবে ১৯৯০-এর দিকে বিষয়টি নজরে আনা হয়; এর মধ্যে নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার কাজ উল্লেখযোগ্য। তারা গার্মেন্ট শ্রমিক এবং শ্রমজীবী নারীদের বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করতে শুরু করে।
গার্মেন্ট শ্রমিক সংগঠনগুলোও দিনটি পালন করে তাদের দাবি নিয়ে। এ ছাড়া বাম জোটের নারী সংগঠনগুলোও এ বিষয়ে সোচ্চার হতে থাকে। তবে বেশি উৎসবমুখর হতে গিয়ে অনেক এনজিও এবং এলিট শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী নারী সংগঠন নারীবাদী 'আধুনিক' চিন্তা চেতনার প্রকাশ ঘটানো শুরু করে, যার সাথে সাধারণ নারীদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের বিষয় বাদ পড়ে যায়। বাংলাদেশে নারীকে তার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সত্তা হিসাবে না দেখে স্রেফ বায়োলজি হিসাবে দেখার প্রবণতা শুরু হয়।
জাতিসংঘের ইকোনোমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিল আসন্ন 'কমিশন অন দ্য স্টাটাস অব উইমেন'-এর ৫৬তম অধিবেশন (১৫-২৬ মার্চ ২০২১) উপলক্ষে ১৯ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। মহাসচিবের এই প্রতিবেদন মূলত জাতীয় জীবনে নারীর অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের অবস্থা তুলে ধরেছে। প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, এই পর্যন্ত মাত্র ২১টি দেশে নারী রাষ্ট্র প্রধান কিংবা সরকার প্রধান আছেন, এর মধ্যে ১০ জন রাষ্ট্র প্রধান, ১১ জন সরকার প্রধান; ১১৯টি দেশে কোনোদিনও কোনো নারী এই পদে ছিলেন না। এই গতিতে এগোলে আগামী ১৩০ বছরেও ক্ষমতার শীর্ষে নারীর সমতা অর্জিত হবে না।
মন্ত্রী হিসেবে নারীদের পাওয়া যায় মাত্র ২১% ক্ষেত্রে। মন্ত্রী পরিষদের সদস্য হিসেবে মাত্র ১৪টি দেশে ৫০% নারী আছেন, ৫৪টি দেশের কেবিনেটে নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ১০ থেকে ১৯.৯%। এভাবে চলতে থাকলে মন্ত্রী পরিষদের সমতা অর্জন করতে ২০৭৭ সাল হয়ে যেতে পারে, আরও ৫৬ বছর লাগবে।
জাতীয় সংসদে নারীর অংশগ্রহণ ১৯৯৫ সালের পর ২০২০ সালের মধ্যে দ্বিগুণ হয়েছে, কিন্তু এখনো ৭৫% আসন দখল করে আছেন পুরুষেরা। এই গতি থাকলে জাতীয় সংসদের মতো জনপ্রতিনিধিত্বমূলক স্থানে নারীর সমতা অর্জন ২০৬৩ সালের আগে হবে না, আরও ৪২ বছর লাগবে। কিছু ভালো খবরও আছে। যেমন চারটি দেশে জাতীয় সংসদে ৫০% নারী সদস্য রয়েছেন, ২৪টি দেশে ৪০%-এর বেশি আছেন। এই দেশগুলো ইউরোপ, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকায়। মাত্র ২০% ক্ষেত্রে নারী সংসদে স্পিকার হিসেবে আছেন। স্থানীয় প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২০ লক্ষ নারী (৩৬%) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত হয়েছেন।
জাতীয় সংসদের তুলনায় এই চিত্র ভালো দেখালেও সমতা অর্জনের জন্যে যথেষ্ট নয়। কিন্তু ৭০টি দেশে নারীর অংশগ্রহণ ১০ থেকে ৩৯% আর ১৫টি দেশে ১০%-এরও কম।
জনপ্রশাসন ও সরকারি চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণ ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৪৫% রয়েছে, এর মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদে আছে মাত্র ৩৪%। কোর্ট-কাচারিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ৩৫%, ২০০৮ সালের তুলনায়। ইউরোপের অনেক দেশে বিচারকদের মধ্যে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি, কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে তাদের অনুপাত কমে হয়েছে ৪১%, এবং প্রসেকিউশন অফিসে তাদের অংশগ্রহণ অনেক পিছিয়ে আছে।
প্রতিবেদনে নারী আন্দোলনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে দেখানো হয়েছে, বিশেষ করে কোভিড-১৯ পেনডেমিকের সময় অনলাইন আলোচনা, নারীর নানা সমস্যা সম্পর্কেও তুলে ধরা হয়েছে। তবে তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে, প্রতিবেদনে নারী শ্রমিকের প্রশ্নটি যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, শুধু আইএলও-এর একটি ধারায় নারীকে নির্যাতন ও হয়রানি থেকে রক্ষার কথা উল্লেখ আছে।
বাংলাদেশের দিকে একটু দেখা যাক। স্বাধীনতার ৫০ বছর পালন করার এই আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমাদের নারীরা কতদূর এগিয়েছেন? বাংলাদেশের নারীরা দেশের কোনো আন্দোলনেই পিছিয়ে ছিলেন না। তারা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ আন্দোলন, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ্ব এবং পরবর্তীকালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সব সময় থেকেছেন। ইতিহাসে স্বীকৃতি পাওয়ার ধার ধারেননি তারা। অন্যান্য আন্দোলনে শিক্ষিত নারীদের এবং মধ্যবিত্তদের বেশি দেখা গেলেও মুক্তিযুদ্ধ ছিল গ্রামের সাধারণ নারীদের বীরত্বের ইতিহাস। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে কী হলো?
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ দেখা যায় ১৯৭৯-এর নির্বাচন থেকেই। তিন শত আসনে ২১২৫ জন প্রার্থীর মধ্যে মাত্র ১৭ জন নারী ছিলেন, তারা কেউই জয়লাভ করেননি। স্থানীয় পর্যায়ে ১৯৭৩ সালে মাত্র একজন নারী চেয়ারম্যান হয়েছিলেন, এবং ১৯৭৭ ও ১৯৮৪-এর নির্বাচনে মাত্র ৪ জন নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। নারী যে এসব পদে থাকারই কথা নয়, এইসব পদের নামকরণ থেকেই বোঝা যায়। আজ পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ বা জেলা পরিষদ চেয়ার-ম্যান (পুরুষ) হিসেবেই রয়ে গেছে। নারী এই পদে গেলে বলতে হয় মহিলা চেয়ারম্যান।
বাংলাদেশ সরকার আপাতদৃষ্টিতে নারীবান্ধব মনে হলেও পরিসংখ্যান ভিন্ন কথা বলে। ইউএনডিপির 'জেন্ডার ইমপাওয়ারমেন্ট মেজার'-এর ৭৮টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ৭৬তম। জাতীয় সংসদে মাত্র ১৪% আসন (৩৩০ সাধারণ আসন এবং ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন) এবং স্থানীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ নারীর জন্যে বরাদ্দ করা আছে। সাধারণ আসনে নারীর অংশগ্রহণে বাধা নেই; তবে সেই সুযোগও সীমিত করে রাখা হয়েছে।
মন্ত্রী পরিষদ ও প্রশাসনে নারীর সংখ্যা বাড়ছে, এটা ইতিবাচক; তবে সমতা অর্জন হতে সময় লাগবে। সংসদের সাধারণ আসনে নারীর মনোনয়ন পেতে বড় রাজনৈতিক দল এখনো পুরুষকেই প্রাধান্য দেয় এবং যেখানে স্বামী (গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ) মারা গেছেন কিংবা কারাগারে আছেন, সেক্ষেত্রে আসনটি ধরে রাখার দায়িত্ব পান স্ত্রী, কন্যা বা বোন। স্ত্রী-কন্যা-বোন হওয়ার কারণে নারীর যোগ্যতা নির্ধারিত হয়।
সংসদে নারীদের জন্যে সংরক্ষিত আসনে যেভাবে মনোনীত করা হয়, তা অপমানজনক; নারী আন্দোলনের দাবি সরাসরি নির্বাচন দেওয়ার। নারী উন্নয়ন নীতিতেও তা উল্লেখ করা আছে। এখনো সেই দাবি মানা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনী ইশতেহারে ওয়াদা করলেও আজ পর্যন্ত তা রক্ষা করেননি। কথা ছিল ৮ই মার্চে এমন ঘোষণা আসবে, কিন্তু আসেনি।
প্রশ্ন উঠছে, রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে এক-তৃতীয়াংশ নারী থাকার বিধান নির্বাচন কমিশনের থাকলেও তা আজও পূরণ না করেই রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশনের কাছে বৈধতা পাচ্ছে কীভাবে? ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেই, বিরোধী দলগুলোও উদাসীন।
ফেমিনিজমের থার্ড এবং ফোর্থ ওয়েভও আছে। তারা এখন বর্ণবাদ ও শ্রেণি শোষণ বিরোধিতা, গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্ন তুলছেন। তারা শ্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে দেওয়ার পক্ষে নন। তারা ইনক্লুসিভ, সাদা-কালো সব বর্ণের নারীদের অধিকারের কথা বলেন। সমস্যা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে। যেমন, এখন যৌন হয়রানি, ধর্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি আন্দোলন হচ্ছে।
কিন্তু ফেমিনিজমের ধারার বাইরে আরও কিছু ঘটনা ঘটছে। যেমন, করপোরেশনগুলো বুঝেছে নারীদের মধ্যে তাদের বিশাল বাজার ও মুনাফার সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে তাদের 'গোলাপী' বা হাল্কা বেগুনি কোম্পানি শুভেচ্ছায় পত্র-পত্রিকা ভরে যায়। তারা এলিট নারীদের বিশাল বেতনে চাকরি দিয়ে নারীর উপকার করছে, এমন কথা প্রমাণ করতে চায়; যদিও তাদের যে পণ্য, তা নারীদের জন্যেই ক্ষতিকর হতে পারে। তারা প্রচার করে যে, বিশেষ হরলিক্স খেলে নারীদের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা বাড়ে, বিশেষ ক্রিম মুখে মাখলে নারীর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাবে, ক্যারিয়ারে উন্নতি হবে; এগুলোকে করপোরেট ফেমিনিজম হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।
এটা মোটেও আশ্চর্য হবার বিষয় নয় যে, ১৯১০ সাল থেকে ২০২১ পর্যন্ত পরিবর্তন বিস্তর হয়েছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন অনেক ক্লিশে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু নারীর সংগ্রাম ও অধিকার আদায়ের দিক থেকে দিবসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই গুরুত্ব বুঝতে হলে ক্লারা জেৎকিন কেন দিবসটিকে শ্রমিক নারীর দিবস হিসাবে পালন করতে চেয়েছেন, সেটা ভালোভাবে বুঝতে হবে। সেটা হচ্ছে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নারীকে সংগঠিত করা এবং নারীর স্বতন্ত্র সত্তার স্বীকৃতি আদায় করার পাশাপাশি পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পুরুষদের লড়াইয়ে সমান্তরালে শামিল থাকা। প্রচলিত বামপন্থার মধ্যে যে পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্ব ও আধিপত্য কাজ করে, তাকে নস্যাৎ করে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কে বিরুদ্ধে কার্যকর ও বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা।
সময় এসেছে ক্লারার নারী দিবসের তাৎপর্য নতুনভাবে উপলব্ধি এবং নারী আন্দোলনের অন্তর্গত বিষয় হিসাবে শ্রমিক নারীর লড়াইকে কাজে খাটানো। শ্রমজীবী নারীর পরিপ্রেক্ষিত থেকে সাধারণ নারীদের স্বার্থ– অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে নারীর অধিকার আদায়ের লড়াইকে শক্তিশালী করা।
এটাই এ কালে আমাদের কাজ।
- লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী