সাংবাদিকতা যেখানে অপরাধ!
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জাগোনিউজ২৪-এর ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি তানভীর হাসান তানুর ভাইরাল হওয়া একটি ছবি নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন। ছবিটিতে দেখা যায়, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন তানু, তার এক হাত বিছানার লোহার সঙ্গে হাতকড়া দিয়ে আটকানো। এর আগে গ্রেপ্তার হওয়ার পর পুলিশ হেফাজতে অসুস্থ হয়ে পড়লে তানুকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। এই ছবিটি একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়—সাংবাদিকতা করতে এসে তানু 'অপরাধ' করে ফেলেছেন।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা হাতকড়া পরানো তানুর ছবিটি তোলেন তার স্থানীয় সহকর্মীরা। তারপর তারাই ছবিটি ফেসবুকে পোস্ট করেন। ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণে সেটি দেশ-বিদেশের অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
তানুর 'অপরাধ' কী?
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন এবং তানু ও অন্য দুটি সংবাদমাধ্যমের স্থানীয় প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার নথি থেকে জানা যায়, ঠাকুরগাঁও আধুনিক হাসপাতালে একজন রোগী প্রতিদিন ৭০ টাকার খাবার পান। অথচ প্রত্যেক রোগীর জন্য সরকারি বরাদ্দ ৩০০ টাকা।
ব্যস, এটা নিয়ে প্রতিবেদন করেছেন তানু। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, এ প্রতিবেদন করা হয়েছে জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার উদ্দেশ্যে। এবং তাদের করা প্রতিবেদনের ফলে নাকি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।
গ্রেপ্তার হওয়া সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আরেকটি গুরুতর অভিযোগ হলো হাসপাতাল, হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মচারী এবং খাবার সরবরাহকারী ঠিকাদারের 'ভাবমূর্তি' নষ্ট করা।
খাবার সরবরাহে যে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে, তা খণ্ডন করার জন্য সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রতিবাদলিপি পাঠানোর মতো কোনো প্রতিষ্ঠিত পথে হাঁটেনি 'ক্ষুব্ধ' হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এমনকি হাসপাতালের ভাবমূর্তি 'নষ্ট' করার জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে মামলাও করেনি তারা। হাসপাতাল ও কর্মচারীদের মানহানি করার জন্য সংবাদমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে ফৌজদারি দণ্ডবিধি ১৮৬০ ধারাতেও মামলা দায়ের করেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
কর্তৃপক্ষের কাছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করাই যথোপযুক্ত মনে হয়েছে এবং বিরোধী মত ও সংবাদমাধ্যমকে দমনের জন্য নির্বিচারে ব্যবহৃত এই বিতর্কিত আইনের আওতায়ই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ দিয়েছে। তারা ভালো করেই জানে, ফৌজদারি দণ্ডবিধির আওতায় মামলার সব কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয় আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া মেনে। আদালতের নির্দেশ ছাড়া পুলিশ সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করতে পারে না।
কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় মানহানির অভিযোগে অভিযুক্ত যে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে পুলিশ। সুতরাং, কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। শনিবার মামলা দায়েরের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তানু গ্রেপ্তার হয়েছেন।
পরদিন আদালতে হাজির করার আগ পর্যন্ত তাকে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। পুলিশ হেফাজতে শ্বাসপ্রশ্বাসের জটিলতায় তানু অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর মাত্র কয়েকদিন আগেই, এক সপ্তাহও হয়নি, তার কোভিড পরীক্ষার ফল নেগেটিভ এসেছে। মাঝরাতে তানুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে লোহার বেডের সঙ্গে হাতকড়া পরানো অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখা যায়।
পুলিশ তানুকে ঠাকুরগাঁও আদালতে হাজির করার সময় তার হাতে হাতকড়া পরানো ছিল। আদালতে পুলিশ তানুর পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদনও করে।
তবে তানুর ভাগ্য অন্য সাংবাদিকদের চেয়ে একটু ভালো। তিনি জামিন পেয়েছেন, যদিও মামলার ঘানি তাকে টানতেই হবে। গ্রেপ্তার হওয়া বাকি সাংবাদিকদের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
প্রায় ২০ ঘণ্টা ধরে তানু যে শারীরিক ও মানসিক হয়রানি সহ্য করেছেন, তা নিশ্চয় স্থানীয় প্রশাসনের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করা স্থানীয় সাংবাদিকদের রীতিমতো আতঙ্কিত করে তুলেছে। এরকম পরিস্থিতি অসৎ কর্মকর্তাদের উপকার করতে পারে; কিন্তু যেসব সেবা পাওয়ার অধিকার জনগণের আছে, সেসবের মান উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না।
পূর্ববর্তী অনেক ঘটনার মতোই এবারও সাংবাদিককে হাতকড়া পরিয়ে পুলিশ সীমা লঙ্ঘন করেছে। এভাবে হাতকড়া পরানো দৃশ্যত অমানবিক ও অযৌক্তিক।
কুখ্যাত ও দুর্বৃত্ত অপরাধীদের হাতকড়া পরানো যায়, যাতে তারা পালাতে না পারে। এই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তো হত্যার মতো গুরুতর কোনো অপরাধের অভিযোগ আনা হয়নি।
অথচ তারপরও তানু অমানবিক ও অবমাননাকর আচরণের শিকার। পুলিশের এ আচরণ সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছে। সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে: 'কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।'
তানুকে এভাবে হাতকড়া পরানোতে পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল-এরও লঙ্ঘন হয়েছে। পুলিশ রেগুলেশনস, বেঙ্গল-এর ৩৩০ (ক) ধারায় হাতকড়া বা দড়ি ব্যবহার করা বেশিরভাগ সময়ই অপ্রয়োজনীয় ও অমর্যাদাকর উল্লেখ করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে।
ধারাটিতে বলা হয়েছে: 'পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তারকৃত বন্দি এবং বিচারাধীন বন্দিকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হস্তান্তরের জন্য বা জিজ্ঞাসাবাদের স্থানে নেওয়ার সময় তাদের পলায়ন বন্ধ করার জন্য যতটুকু প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি কড়াকড়ি করা যাবে না। হাতকড়া বা দড়ির ব্যবহার প্রায় ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয় এবং অমর্যাদাকর।'
সাংবাদিক তানুর সঙ্গে পুলিশ যে আচরণ করেছে, তা নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (প্রতিরোধ) আইন ২০১৩-এরও পরিপন্থী। এ আইন অনুসারে, অভিযুক্তকে অমানবিক, নিষ্ঠুর, অবমাননাকর শাস্তি দেওয়া এবং তার সঙ্গে এরকম আচরণ করা অপরাধ।
ঠাকুরগাঁওয়ের ঘটনাটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিগত দুই বছরে অনেক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে। প্রতিটি ঘটনা মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য একেকটি নতুন আঘাত হয়ে এসেছে।
ঠাকুরগাঁও হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ হয়তো ভুলে গেছে, তারা এমন এক স্বাস্থ্যখাতের অংশ, যা ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যা করেছে, তা মুক্ত গণমাধ্যমের প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে মনোভাব পোষণ করে তারই বহিঃপ্রকাশ। মহামারি শুরু হওয়ার পর ডাক্তার ও নার্সদের ওপর সাংবাদিকদেরকে কোনো তথ্য না দেওয়ার হুকুম জারি করে গণমাধ্যমের কাছে তথ্য প্রবাহ আটকাতে চেষ্টা করেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। গত সপ্তাহে ঢাকা জেলা সিভিল সার্জন অফিস নতুন করে এরকম আরেকটি নির্দেশ জারি করেছে।
কর্তৃপক্ষের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে, এমন 'মিথ্যা প্রতিবেদন' করার দায়ে সাংবাদিকের হাতে হাতকড়া পরানো সংবিধানপ্রদত্ত গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের সুস্পষ্ট প্রয়াস। এ ঘটনা আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নানা রকম বিধিনিষেধ মোকাবিলা করছে। এতে কি দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে না?
মুক্তমত ও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার নিয়ে ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে বিস্তর সমালোচনা হয়েছে। অতীতের এরকম আরও অন্যান্য ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে মানহানির অভিযোগে বিতর্কিত আইনের আওতায় সাংবাদিককে হাতকড়া পরানোর ঘটনাটি বৈশ্বিক গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান আরও ভালো করার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।
- লেখক: উপ নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
- মূল লেখা: Where journalism is a crime!
- ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মারুফ হোসেন