‘পুরো বিশ্বকে টিকা দিতে পারলে জলবায়ু সংকট মোকাবিলা করতে পারবো’
চলতি বছরের শেষ নাগাদ বিশ্বের ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠী এবং ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে বিশ্বের ৬০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে টিকাদানের আওতায় নিয়ে আসতে মাত্র ৫০ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাম্প্রতিক এক হিসাবে এই তথ্য উঠে এসেছে। কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে আনতে বিশ্বব্যাপী টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনার পক্ষে সম্মিলিত আহ্বানে সর্বশেষ সংস্থা হিসেবে যোগ দিয়েছে আইএমএফ। সংস্থাটি বৈশ্বিক টিকাদান কার্যক্রমের অর্থনৈতিক কল্যাণের দিকে আলোকপাত করেছে। সামগ্রিক হিসাবে তা বিশাল। কিন্তু, বিশ্বব্যাপী টিকাদান পরিচালনার পেছনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে।
জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশ মিলিতভাবে কাজ করতে চাইলে বিশ্বে টিকাদান কর্মসূচীর ভূমিকা হবে অন্যতম প্রধান। সেজন্য, ভ্যাকসিন সরবরাহের পাশাপাশি একইসঙ্গে ভ্যাকসিনের সংস্থান, উদ্ভাবন, কৌশল অবলম্বন এবং ধনী ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে সত্যিকারের অংশীদারি সম্পর্কের প্রয়োজন হবে। নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে চলা কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলন এই অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করবে। কিন্তু তার আগে ধনী দেশগুলোকে বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন সরবরাহের প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি রাখতে হবে।
বর্তমান অবস্থা বিবেচনায়, ভ্যাকসিনের সহজলভ্যতা সব জায়গায় সমান নয়। বিশ্বের অধিকাংশ স্থানে স্বাস্থ্যকর্মী এবং বয়োঃবৃদ্ধরা যখন টিকার অপেক্ষায় আছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র শিশুদের টিকাদান শুরু করেছে। এপ্রিলের শেষ নাগাদ আফ্রিকার দুই শতাংশেরও কম জনগোষ্ঠী টিকা গ্রহণ করেছে। এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রে এবং ইউরোপে অন্তত একডোজ টিকা গ্রহীতার সংখ্যা যথাক্রমে মোট জনগোষ্ঠীর ৪০ এবং ২০ শতাংশ।
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ টিকা প্রস্তুতকারী দেশ ভারতে ৩ শতাংশ জনগণকে পূর্ণ টিকাদানের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। দেশটি এখনও দ্বিতীয় তরঙ্গের দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাওয়ায় সব ধরনের টিকা রপ্তানি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।
ঘটনা কোন দিকে মোড় নিতে চলেছে তা বেশ কিছু সময় ধরেই পরিষ্কার হয়ে উঠছিল। মহামারির শুরুতে বৈশ্বিক সংহতি স্থাপন নিয়ে বহু আলোচনা চলে। কিন্তু, পরবর্তীত সময়ে ধনী দেশগুলো ঠিকই নিজেদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে ভ্যাকসিন উৎপাদনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্বব্যাপী সরবরাহকে কোনঠাসায় ফেলে।
বিশ্বের মাত্র ১৬ শতাংশ জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল উচ্চ আয়ের ধনী দেশগুলো মার্চ নাগাদ ৫০ শতাংশ ভ্যাকসিন ডোজ কিনে নেয়। জাতিসংঘ সমর্থিত কোভ্যাক্স প্রকল্পসহ এসিটি অ্যাক্সিলেটর (অ্যাকসেস টু কোভিড-১৯ টুলস অ্যাক্সিলেটর) অংশীদারদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিশ্বের সবথেকে দরিদ্র দেশগুলোকে দুই বিলিয়ন ভ্যাকসিন প্রদানের কথা থাকলেও, এই মাসের হিসাব অনুযায়ী মাত্র ৮০ মিলিয়ন ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হয়েছে। কারণ কী? এর কারণ হলো অপর্যাপ্ত দান তহবিল এবং বিশ্বের সমৃদ্ধশালী দেশগুলোর সাথে ভ্যাকসিন নিয়ে প্রতিযোগিতা, যারা প্রয়োজন পড়লে চড়াদামে ভ্যাকসিন কেনার সামর্থ্য রাখে। ভবিষ্যতের জন্যও লাখ লাখ বাড়তি ভ্যাকসিনের মজুদ রাখার পরিকল্পনা করেছে এই দেশগুলো। বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, এ বছরের শেষ নাগাদ উন্নত দেশগুলোর কাছে ১০০ কোটি বাড়তি ভ্যাকসিন মজুদ থাকবে।
গৃহীত অর্থনৈতিক নীতিমালা থেকেই এই বৈষম্যের আভাস পাওয়া গিয়েছিল। ধনী দেশগুলো জনগণকে রক্ষা করতে বিপুল পরিমাণে ভ্যাকসিন কিনতে যেখানে জিডিপির ২০ শতাংশের বেশি অর্থ ব্যয় করেছে, সেখানে দরিদ্র দেশগুলো ভ্যাকসিনের পিছে জিডিপির মাত্র দুই শতাংশ অর্থ বরাদ্দ রাখতে পেরেছে। মহামারি শুরু হওয়ার পর বিশ্বে আরও প্রায় ১০ কোটি মানুষ হতদরিদ্রের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। লকডাউনের পর উন্নয়নশীল দেশগুলো অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি উপচে পড়া মর্গ এবং মৃত্যুহার নিয়ে দ্বিগুণ সমস্যায় নিমজ্জিত হয়েছে (উদাহরণস্বরূপ, ভারতে প্রথম লকডাউনের কারণে দেশটি জিডিপির প্রায় এক-চতুর্থাংশ হারায়)।
নৈতিক সহায়তা প্রদানে দরিদ্র রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়াতে উন্নত রাষ্ট্রগুলো চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের নিকট উন্নত বিশ্বের স্বার্থ সংরক্ষণ নিয়ে থাকা সন্দেহকেই তা জোরদার করেছে। সমন্বিত বৈশ্বিক উদ্যোগ এবং সৌভাগ্যের সমান অংশীদারিত্ব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চললেও কঠিন পরিস্থিতিতে সবাই নিজেদের কথাই আগে ভাবে।
জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে বিষয়টি বিধ্বংসী প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। কপ-২৬ সম্মেলনের সাফল্য বাংলাদেশ, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া এবং পাকিস্তানের মতো বৃহৎ উন্নয়নশীল দেশের ওপর নির্ভরশীল। জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় এই দেশগুলো তখনই ছাড় দিতে রাজি হবে যখন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স এবং কানাডার মতো দেশগুলো নিজেদের প্রতিশ্রুতিতে অবিচল থাকবে। কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ কমাতে সম্মত হলে উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজেদের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকেই হ্রাস করবে। এমনকি, তারা সস্তা, দূষণ সৃষ্টিকারী এয়ার কন্ডিশনারের মতো সরঞ্জামাদির ব্যবহার বাতিল করতে বাধ্য হতে পারে। ফলে, তাপদাহের মতো ইতোমধ্যে যেসব জলবায়ু বিপর্যয় দেখা দিয়েছে তা থেকে বাঁচার মতো তাৎক্ষণিক সুযোগও হারাবে দেশগুলো।
এই ত্যাগগুলো তখনই পরিশোধ করা সম্ভব যখন ধনী রাষ্ট্রগুলোও ভয়াবহ পরিস্থিতি এড়াতে নিজেরা সক্রিয়ভাবে কার্বন নিঃসরণ কমানোর উদ্যোগ নিবে। নিজ অবস্থান থেকে সচেষ্ট না হলে, আমরা নিজেরাই নিজেদের কবর খুঁড়ব।
কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে অন্য কোনো দুর্যোগ সামনে এলেও উন্নয়নশীল দেশগুলো সন্দেহ দূর হবে না। ধনী দেশগুলো যে পুনরায় অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে না তার নিশ্চয়তা কী? আর তাই, বিশ্বাস স্থাপনই হলো এখানে মূল চাবিকাঠি।
কপ-২৬ সম্মেলনে ধনী রাষ্ট্রগুলো অভ্যন্তরীণ জলবায়ু নীতিমালা নিয়ন্ত্রণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও উন্নয়নশীল দেশগুলো সম্ভবত এই দাবী-নামায় স্বাক্ষর করতে সম্মত হবে না। ধনী দেশগুলোর অপরিকল্পিত বিকাশের পূর্ব পাপের ফল হিসেবে বিশ্বের অনুন্নত রাষ্ট্রের কাছে ত্যাগের আহ্বান করা হচ্ছে বলে একটি ধারণার প্রচলন আছে। ধারণাটি প্রবল এবং পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত। সুতরাং, কোভিড বিপর্যয়ে ধনী রাষ্ট্রগুলো যখন বিশ্বের অপেক্ষাকৃত গরীব রাষ্ট্রগুলোর সহায়তা নিয়ে তেমন মাথা ঘামায়নি, তখন তা খুব একটা ভালো ফল নিয়ে আসবে না।
যুক্তিসঙ্গতভাবেই উন্নয়নশীল দেশগুলো কপ-২৬ এ দাবি করা কঠোর পদক্ষেপগুলোর পরিবর্তে ক্ষরিপূরণ দাবী করবে। কিং ক্লাইমেট অ্যাকশন ইনিশিয়েটিভ পরিচালনাকারী আমাদের জে-পাল এমআইটি ল্যাবের সহকর্মীদের গবেষণা অনুযায়ী, শর্ত আরোপিত ক্ষতিপূরণের বিষয়টি কার্যকর। উগান্ডায় প্রতি টন কাঠের বদলে মাত্র এক ডলারের কম ক্ষতিপূরণ দেওয়ায় জমির মালিকরা গাছ কাটা থেকে বিরত থাকে। ফলে, বৃক্ষ নিধন হ্রাস করার পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণ কমানোও সম্ভব হয়েছে। বিশ্বব্যাপী কার্যকর প্রমাণিত হতে পারে এরকম আরও ডজন খানেক উদ্ভাবনী নীতিমালা নিয়ে কাজ করছেন গবেষকরা। এর মধ্যে আছে, নিঃসরণ সংক্রান্ত বিনিময় থেকে শুরু করে প্রণোদনা এমনকি ফসল পোড়ানো রোধে গঠিত বিভিন্ন পরিকল্পনা।
তবে, এই পদ্ধতিগুলো কেবল তখনই কার্যকরী যখন উন্নয়নশীল দেশগুলো ক্ষতিপূরণ লাভের নিশ্চয়তা পায়। এ ধরনের প্রতিশ্রুতি আগেও দেওয়া হয়েছে। উন্নত অর্থনীতির দেশসমূহ আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের জলবায়ু ঝুঁকি প্রশমন ও অভিযোজনের লক্ষ্যে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের জন্য প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করতে সম্মত হয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে, উন্নয়নশীল দেশ এবং তাদের নাগরিকরা সমঝোতায় স্থির থাকতে উন্নত দেশগুলোকে ভরসা করতে পারবে কি না সেই প্রশ্ন তুলছে।
আমরা কীভাবে দ্রুত আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারি? এক্ষেত্রে, গত বছর যে ক্ষতিসাধন হয়েছে তা পূরণে বিশ্বব্যাপী টিকাদান কর্মসূচীতে বিনিয়োগ করা একটি সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। কোভিড সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে তা হিসাব করলে আইএমএফের ৫০ বিলিয়ন ডলারের মূল্য নির্ধারণ হিসাবজনিত ত্রুটি বলে মনে হবে। নিশ্চিতভাবেই শুধু অর্থ দিয়েই চলবে না। ভ্যাকসিনের উৎপাদন, সংরক্ষণ এবং সরবরাহও বজায় রাখতে হবে। ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বত্বাধিকার থেকে প্রাপ্ত মুনাফা অনুদানে প্ররোচিত করতে হবে। ভ্যাকসিন উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল সরবরাহে যেন বাধার সৃষ্টি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। পরবর্তীতে, ভ্যাকসিনগুলো কার্যকরভাবে বিতরণে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সক্রিয়ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।
বিশ্ব বর্তমানে সঠিক পথে আগানোর একটি দুর্বল ইঙ্গিতও মিলছে। জি-২০ দেশগুলো সম্প্রতি "এসিটি-অ্যাকসিলারেটরের উদ্যোগ বাস্তবায়নে তহবিল অপর্যাপ্ততাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা" করার কথা উল্লেখ করেছে। অন্যদিকে, কোভ্যাক্স সাম্প্রতিক সময়ে জনসন অ্যান্ড জনসনের কাছ থেকে ২০০ মিলিয়ন ভ্যাকসিন কিনতে চুক্তি স্বাক্ষর করে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন সীমিত সংখ্যক অব্যবহৃত ভ্যাকসিন দান করতে সম্মত হয়েছে (যথাক্রমে, ৮০ মিলিয়ন ও ১০০ মিলিয়ন)।
বাইডেন প্রশাসন সম্প্রতি কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের স্বত্বাধিকার তুলে নেওয়ায় ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে। ফলে, ভ্যাকসিন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো নিশ্চিতভাবেই তড়িঘড়ি করে সহযোগী খুঁজে উৎপাদন বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হবে। এদিকে, আইএমএফের পরিকল্পনায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধানরাও যৌথভাবে সমর্থন প্রদান করেছে।
কিন্তু, এ সবই বেশ সীমিত এবং ধীর গতিতে পরিচালিত হচ্ছে। বৈশ্বিক একক সম্প্রদায় হিসেবে একই পরিণতি বরণ করার বিষয়টিকে কেবল আলোচনায় সীমাবদ্ধ না রেখে টিকাদান কর্মসূচীর সফলতার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব হবে। আর তাই ভ্যাকসিনের মাধ্যমেই ঐক্যবদ্ধতার এই অস্তিত্ব প্রমাণের যাত্রা শুরু হোক।
অভিজিৎ ব্যানার্জি ও এস্থার ডুফলো নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ
- অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা