‘বিশ্বকে সন্ত্রাসীরা নয়, আমরাই বদলেছি’
গেল ১১ সেপ্টেম্বর ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলার ২০ বছরপূর্তি। এদিন বিশ্বকে চিরতরে বদলে দিয়েছে- এমন প্রতিধ্বনি দিবসটি উপলক্ষে আবারো শোনা গেছে। কিন্তু, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ওই হামলা আসলে পরিবর্তন আনেনি। আল-কায়েদার মতো রক্তপিপাসু গণহত্যাকারী খুনি দলের হাতেও কোনদিন পৃথিবী বদলানোর মতো ক্ষমতা ছিল না।
উগ্রবাদী ধর্মান্ধদের এই দলটি নিঃসন্দেহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাকে ঘৃণা করতো। ২০০১ সালের ওই হামলার পর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ বলেছিলেন- 'আমাদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, মুক্তবাকের স্বাধীনতা, ভোটদান ও বিক্ষোভ করার স্বাধীনতাকে- সন্ত্রাসীরা ঘৃণা করে।'
তবে বুশ যাই বলুন, এসব স্বাধীনতার ওপর সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ও বিপর্যয়কর হামলা এসেছে যারা এগুলোর রক্ষক, সেই রাজনীতিবিদ, আমলা ও সাংবাদিকদের কাছ থেকেই। নাইন-ইলেভেনের পরপরই এ প্রক্রিয়া শুরু হয় ।
বিশ্বে বদলে যাওয়া শুরু করে তখনই। যার মর্মান্তিক পরিণতিস্বরূপ আজ তালেবান ক্ষমতায় ফিরে এসেছে, আর সমগ্র মানব সভ্যতা এসে দাঁড়িয়েছে আজকের ক্রান্তিলগ্নে।
আজ ভারত হোক বা যুক্তরাষ্ট্র, উভয় দেশেই বুশ যে অভ্যন্তরীণ নৈরাজ্যবাদী শক্তির উত্থানের কথা বলেছিলেন, তারা গণতন্ত্রকে, রাষ্ট্রকে, মৌলিক স্বাধীনতার দিকগুলোকে অবরুদ্ধ করে ফেলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সকল প্রশাসন বৈষম্যের আগুনে ঘি ঢেলেছে। যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েড হত্যার পর দাবানলের আকার ধারণ করে। সেই পোড়ামাটিতে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের উত্থান ঘটে, যার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের অনন্ত সন্ত্রাসবাদী যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ায়ও দায়ী। বর্ণবাদী নীতিতে দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে অজস্র বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, অনির্দিষ্ট কাল আটক রাখা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গকারী নিরাপত্তা নজরদারি পরিচালনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
তাই আজকের বিশ্ব, আগের তুলনায় অনেক বেশি তমসাচ্ছন্ন। একদা প্রশংসিত যুক্তরাজ্য, ভারত ও ইসরায়েলের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কট্টর ডানপন্থী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও দল ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। অন্যদিকে, আরও বেশি একনায়কতন্ত্রী শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে চীন ও রাশিয়ায়।
এর জন্যও দায়ী, নাইন-ইলেভেন পরবর্তী সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধের আরোপিত নজিরবিহীন সহিংসতা, বর্বরতা ও নিষেধাজ্ঞা।
আজকের তরুণ প্রজন্মের হয়তো স্মরণে নেই, কীভাবে ২০০১ সালের হামলার পর চেচনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শুরু করেছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
নাইন-ইলেভেন হামলার পর, হোয়াইট হাউজে সমবেদনা ও সমর্থন জানিয়ে প্রথম টেলিফোনকারী বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন পুতিন। তিনি রাশিয়ার চেচেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সন্ত্রাসী বলে উল্লেখ করেন এবং তাদের দমনে বুশের সম্মতি লাভ করেন।
ফোনালাপের বিষয়ে তখন বুশ বলেছিলেন, তিনি রুশ নেতার সন্ত্রাসদমনে একান্ত আন্তরিকতা বুঝতে পেরেছেন। 'পুতিন একজন সহজসরল ও বিশ্বাসী নেতা' বলে মন্তব্য করেন বুশ।
সন্ত্রাস দমনের নামেই পরবর্তীকালে নিজের ক্ষমতাকে স্থায়ী ও সুসংহত করে একনায়ক হয়ে ওঠেন পুতিন।
অন্যদিকে, ১৯৮২ সালে নেবাননের বৈরুতে অগণিত নিরাপরাদ মানুষ হত্যায় জড়িত- ইসরায়েলের কট্টরপন্থী (সাবেক) প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারনের জন্যও সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের কারণে ক্ষমতায় ফিরে আসার পথ খুলে যায়। তিনি ফিলিস্তিনী পক্ষগুলোর সঙ্গে শান্তি আলোচনাকে সবরকম উপায়ে ব্যাহত করে একপ্রকার অসম্ভব করে তোলেন। তিনিও পুতিনের মতো দ্রুততার সাথে অধিকৃত অঞ্চলে, ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ দমনকে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধের নাম দেন।
এমনকি এককালের সোভিয়েত সমর্থিত ও সমাজতন্ত্র ঘেঁষা ফিলিস্তিনী নেতা ইয়াসির আরাফাতকে- তিনি ইসরায়েলের বিন লাদেন বলে ঘোষণা করেন।
২০০২ সালে ক্ষমতায় আসার পর, বুশ প্রশাসনের প্রকাশ্য সমর্থনে গাজায় তখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন শ্যারন। এই ঘটনা ফাতাহ ও পিএলও'র মতো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সংগঠনগুলোর প্রতি ফিলিস্তিনী জনতার আস্থায় চিড় ধরায়। অপরদিকে শক্তিশালী হতে থাকে, ইসলামিক জিহাদ ও হামাসের মতো কট্টরপন্থী সংগঠন।
২০০১ সালের ডিসেম্বরে নয়াদিল্লিতে পার্লামেন্ট ভবনে হামলা করে জঙ্গিরা, এ ঘটনাকে ভারতের নিজস্ব নাইন-ইলেভেন বলে শোর তোলে ভারতের হিন্দু জাতীয়বাদী শক্তিগুলো। সাথে সাথে পাকিস্তান সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়ে মোতায়েন হয় ভারতীয় সামরিক বাহিনী। কিন্তু, সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হলো, এরপর হিন্দুত্ববাদীদের সমর্থনে এমন সন্ত্রাসবিরোধী কালা কানুন পাস হয়, যেখানে অভিযুক্তের নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের কোনো সুযোগই রাখা হয়নি। পরবর্তীকালে এসব আইনই বৈষম্যমূলকভাবে শুধুমাত্র ভারতীয় মুসলমান সংখ্যালঘুদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে।
জাতিগত ঘৃণামূলক প্রচারণা ও ইসলামোফোবিয়ার এ বিষাক্ত আবহেই সংগঠিত হয় গুজরাট দাঙ্গা। যখন সরকারি হিসাবেই প্রায় ২ হাজারের অধিক মুসলমানকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। দাঙ্গার চাইতে একে গণহত্যা বলাই শ্রেয়, যা সংগঠিত হয় ৯/১১- এর মাত্র মাস ছয়েক পরই। তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ভারতীয় জনতা পার্টির অপেক্ষাকৃত নবীন নেতা নরেন্দ্র মোদি। অভিযোগ আছে, তিনি এ হত্যাযজ্ঞে প্রত্যক্ষ সমর্থন দেন।
নাইন-ইলেভেনের সবচেয়ে কলঙ্কিত উত্তরাধিকার হলো- সমাজে আইনি প্রক্রিয়ার অবক্ষয়। সন্ত্রাস দমনের নামে, দেশে দেশে চলে বিরোধীমত ও স্বাধীনতাকামীদের দমন প্রক্রিয়া। আইন প্রয়োগকারীদের হাতেই লঙ্ঘিত হয় গণমানুষের সাংবিধানিক অধিকার।
একক পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র গুয়ান্তানামো বে কারাগারে নির্বিচারে সন্দেহভাজনদের বন্দী ও নির্যাতন করার যে নজির সৃষ্টি করে, তা অনুসরণ করেই গণহারে উইঘুর মুসলমানদের বন্দী রাখার উৎসাহ পেয়েছে চীন।
অন্যদিকে, আধুনিক গণতন্ত্রের সূতিকাগার ব্রিটেনের রাজনীতিতে উগ্রবাদীদের যে উত্থান হয়েছে, তার সূত্রপাত হয়েছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোট বেঁধে ইরাক আগ্রাসনের সময় থেকেই। অন্যান্য মুসলিম দেশেও যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সহযোগী হয় ব্রিটেন।
তারপর যা হয়, তা প্রত্যাশিতই ছিল- লন্ডনের রাজপথে প্রতিহিংসামূলক হামলা চালাতে থাকে সন্ত্রাসীরা। তারপর অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস দমনের প্রক্রিয়ায় খর্ব হয় নাগরিক অধিকার। দেশটির গণমাধ্যমেও ভাইরাসের মতোই সংক্রামক আকার নেয়- মুসলিম বিরোধী প্রচারণার সংস্কৃতি। উদগীরিত হয় জাতিগত বিদ্বেষের বিষবাষ্প।
সবচেয়ে ক্ষতি হয়, যখন অগ্রগামী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গণমাধ্যম ব্যাক্তিত্ব ও নীতিনির্ধারকরা সকলের জন্য গণতন্ত্রের ধারণাকে ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকেন। ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়া থেকে শুরু করে যুক্তরাজ্যের স্পেকটেটরের মতো বিখ্যাত অনেক গণমাধ্যম- এসময় কট্টর ডানপন্থীদের নির্দিষ্ট একটি ধর্মবিশ্বাসীদের ব্যঙ্গবিদ্রূপ ও তাদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্র হয়ে ওঠে।
আজ যারা তাদের সমালোচনা করতে চান, তাদের আগে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের শবচ্ছেদ করা উচিত, যে যুদ্ধ ইসলামোফোবিয়া ও যুদ্ধান্মোদনাকে বৈশ্বিক রূপ দিয়েছিল। সংকীর্ণ করেছিলে বিরোধী মতচার্চার সুযোগ।
তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে আজ যে অভ্যন্তরীণ নৈরাজ্য দানা বেঁধে উঠছে- তা রাজনৈতিক অভিজাতবর্গ ও গণমাধ্যমের ওপর উগ্রবাদী জনতার অনাস্থারই ফসল।
সন্ত্রাসী হামলায় হাজারো নিরাপরাধ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া কোনদিনই ভোলার নয়। কিন্তু, আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে, সন্ত্রাসীরা টুইন টাওয়ার ধ্বংস করলেও, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের গায়ে আঁচড় দিতে পারেনি। বরং সুসংহত এসব প্রতিষ্ঠানকে বিনাশের মুখে ঠেলে দেন- সেগুলো রক্ষার শপথ নেওয়া রাষ্ট্রনায়কেরা।
লেখক: পঙ্কজ মিশ্র মার্কিন গণমাধ্যম ব্লুমবার্গের মতামত কলামিষ্ট। তার লেখা বহুল সমাদৃত গ্রন্থের মধ্যে- 'এজ অব অ্যাঙ্গার: এ হিস্টোরি অব প্রেজেন্ট,' 'ফ্রম দ্য রুইনস অব এম্পায়ার: দ্য ইন্টেকেলেকচুয়ালস হু রিমেড এশিয়া' এবং 'টেমটেশন্স অব দ্য ওয়েস্ট: হাউ টু বি মডার্ন ইন ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, তিব্বত অ্যান্ড বিয়ন্ড' অন্যতম।
সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত