এমপির হাতে মার খাওয়ার পরেও শিক্ষককে কেন চেপে যেতে হয়?
সাম্প্রতিক সময়ে একজন সংসদ সদস্যের হাতে একজন কলেজ অধ্যক্ষের নিগৃহীত হওয়া, লাঞ্ছিত ও প্রহৃত হওয়া; কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে আরেকজন শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরিয়ে ঘুরানো; ধর্ম অবমাননার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় একজন শিক্ষককে আট বছরের কারাদণ্ড- এমনকী হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে একজন শিক্ষককে হত্যার ঘটনাগুলো আলাদা স্থানে, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ঘটেছে বলে এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে ভাববার অবকাশ আছে কি না—সেটিই এই মুহূর্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যদি ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন না হয়, তাহলে এর সঙ্গে পারস্পরিক যোগসূত্রতার রসায়ন কী—সেটি ভাবা দরকার। তার নির্মোহ বিশ্লেষণ হওয়া দরকার।
একাধিক সংবাদপত্র এবং জাতীয় অনলাইন পোর্টালের খবর বলছে, রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের সরকার দলীয় সংসদ-সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী গোদাগাড়ীর রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেছেন। এমপি ফারুক চৌধুরীর বেপরোয়া লাথি, কিল-ঘুসি ও হকিস্টিকের আঘাতে তার শরীরের বিভিন্ন স্থান কালো হয়ে গেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল ও আতঙ্কিত ওই শিক্ষক এখনো ভীতসন্ত্রস্ত্র। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে নগরীর রায়পাড়ার বাসায় পরিবারের সঙ্গে অবস্থান করছেন।
ঘটনার সময় গোদাগাড়ী উপজেলার বিভিন্ন কলেজের আরও সাতজন অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ উপস্থিত ছিলেন। প্রায় ১৫ মিনিট সময় ধরে সবার সামনে অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে বেপরোয়াভাবে পিটিয়ে জখম করলেও এমপি ফারুকের হুংকারে কেউ তাকে বাধা দিতে সাহস পায়নি।
এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আরেকটি কলেজের অধ্যক্ষ নাম প্রকাশ না করে সাংবাদিকদের বলেছেন, একজন সংসদ-সদস্য এমন জঘন্য কাজ করতে পারেন, সেটি তারা ভাবতেও পারছেন না। একজন কলেজ অধ্যক্ষকে গরুপেটা করে পেটানো-কী সাংঘাতিক ঘটনা উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন করেন, একজন আইনপ্রণেতা যদি শিক্ষককে পেটান, তাহলে তারা কার কাছে এর বিচার দেবেন?
যদিও এমপি এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, শুধু এমপি নন, এই ঘটনা অস্বীকার করে ফেসবুক পোস্ট দিয়েছেন ঘটনার শিকার অধ্যক্ষ সেলিম রেজা নিজেও। দাবি করেছেন, এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি।
একটা সমাজ ও রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন কোন পর্যায়ে পৌঁছালে একজন সংসদ সদস্যের হাতে মার খাওয়ার পরেও একজন কলেজের অধ্যক্ষকে লিখিত বিবৃতি দিয়ে বলতে হয়, ঘটনা সত্য নয়। এটা নাকি অপপ্রচার।
বাস্তবতা হলো, ঘটনাটি ঘটেছে। একাধিক গণমাধ্যমে রিপোর্ট হয়েছে। কিন্তু মুশকিল হলো, আমাদের দেশে সাম্প্রতিক যে প্রবণতা শুরু হয়েছে, তাতে কোনো ঘটনার ছবি, বিশেষ করে ভিডিও না থাকলে মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না বা প্রতিক্রিয়া জানায় না। যে কারণে ভিডিও ছিল বলেই ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জে শ্যামল কান্তি ভক্ত নামে একজন শিক্ষককে যখন স্থানীয় এমপি সেলিম ওসমানের উপস্থিতিতে কান ধরে ওঠবস করানো হলো এবং সেই ঘটনার ভিডিও যখন ছড়িয়ে পড়লো, তখন সারা দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়লো।
ভিডিও ছিল বলেই নড়াইলে একজন শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানোর ঘটনায় সারা দেশের মানুষ বিক্ষুব্ধ হলো। প্রশাসন দ্রুততম সময়ে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করলো। কিন্তু রাজশাহীতে এমপির হাতে একজন অধ্যক্ষের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় এখনও কোনো ভিডিও বা স্থির চিত্র প্রকাশিত হয়নি। যেহেতু ঘটনাটি অনেক লোকের উপস্থিতিতে ঘটেছে, ফলে ধারণা করা যায়, কারো না কারো ফোনে এর হয় স্থির চিত্র বা ভিডিও ধারণ করা আছে। আজ না হোক কাল, নিশ্চয়ই সেই ছবি প্রকাশিত হবে। তখন হয়তো ঘটনাটি অন্যদিকে মোড় নেবে। কিন্তু ছবি বা ভিডিও না থাকলেও রাজশাহীর ঘটনায় সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। শিক্ষা ও সামাজিক সাংস্কৃতিক বিভিন্ন সংগঠনের তরফে এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে অভিযুক্ত এমপির বিচার দাবি করা হয়েছে। কিন্তু যার সঙ্গে ঘটনা, সেই শিক্ষক নিজেই যদি অস্বীকার করেন; তিনি নিজেই যদি বিচার না চান, তখন পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যায়।
প্রশ্ন হলো, ওই অধ্যক্ষ কেন ঘটনাটি অস্বীকার করছেন? কেন তিনি চেপে যাচ্ছেন? তার উপরে যে এমপি সাহেবের চাপ আছে, সেটি বুঝতে গবেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু একজন শিক্ষক হয়ে এত বড় একটি অন্যায়কে তিনি প্রশ্রয় দিয়ে কি শিক্ষকতার মতো একটি মহান পেশাকেই অবমাননা করছেন না?
গণমাধ্যমের খবর বলছে, সাতটি কলেজের অধ্যক্ষের সামনে এই ঘটনা ঘটেছে। তাহলে ওই সাতজন অধ্যক্ষও কেন প্রতিবাদ করছেন না? তারা সবাই মিলে কেন একটা সম্মিলিত বিবৃতি দিচ্ছেন না? নাকি লাঞ্ছিত অধ্যক্ষের মতো তারাও নিজেদের চাকরি নিয়ে চিন্তিত। তারাও কি নিজেদের এবং পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে এতটাই উদ্বিগ্ন যে একজন সহকর্মীকে মার খেতে দেখেও এমপি সাহেবকে টু টা শব্দটি বলার সাহস পেলেন না? এত দুর্বল মেরুদণ্ড নিয়ে তারা কলেজের অধ্যক্ষ হলেন কী করে? তারা সবাই কি ভাবছেন যে বনে থেকে বাঘের সঙ্গে লড়াই করে লাভ নেই? তারা সবাই কি নিজেদের চাকরি নিয়ে ভীত? এরকম পরিস্থিতিতে ওই শিক্ষকদের পাশে কি রাষ্ট্র আছে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং স্থানীয় প্রশাসন কী করছে? তারাও কি এমপি সাহেবের ভয়ে তটস্থ? যদি তাই হয়, তাহলে রাষ্ট্রের সর্বসময় ক্ষমতার অধিকার প্রধানমন্ত্রী কি ঘটনাটি জেনেছেন? তিনি কি একজন শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষায় এগিয়ে আসবেন না?
নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠবস করানো হয়েছিল স্থানীয় এমপির উপস্থিতিতেই। ওই এমপি সাহেবের কিছু হয়নি। বরং শ্যামল কান্তিকেই জেল খাটতে হয়েছে। নওগাঁর শিক্ষক আমোদিনী পাল কিংবা মুন্সিগঞ্জের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে হেনস্থা ও হয়রানির ঘটনারও কোনো সুষ্ঠু বিচার হয়নি। এর প্রত্যেকটি ঘটনার পেছনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বা অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়ম-বাণিজ্য এবং স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সংশ্লিষ্টতা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। যার পেছনে রয়েছে বিরাট অংকের অর্থ এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার। এমনকি সাভারে যে শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করা হলো, সেখানেও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন রয়েছে।
কারণ রাজনৈতিক প্রশ্রয় ছাড়া একজন কিশোর বা তরুণ খুনি হয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু শিক্ষক লাঞ্ছনার মতো ঘটনার ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিচার হয় না। বিশেষ করে যেসব ঘটনার সঙ্গে স্থানীয় এমপি বা প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা যুক্ত থাকেন।
রাজশাহীর লাঞ্ছিত অধ্যক্ষ মহোদয় হয়তো একদিন ঠিকই স্বীকার করবেন, কোন পরিস্থিতি বা কোন চাপের কারণে তিনি মারধর ও লাঞ্ছনার কথা অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু ততদিনে নদীর জল অনেক গড়াবে। এই দেশে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন আরও অনেক ডালপালা মেলবে।
যে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে একজন শিক্ষককে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠবস করানো হয়; একজন শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরিয়ে ঘোরানো হয় কিংবা সন্তানতূল্য ছাত্রের হকিস্টিকের আঘাতে যে দেশে একজন শিক্ষককে প্রাণ দিতে হয়—সেই দেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই। আবার রাজনীতিবিদ ছাড়া অন্য কারো হাতে দেশটি নিরাপদও নয়। সুতরাং রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন রাজনীতিবিদদেরই দূর করতে হবে।
সাড়ে তিনশো এমপি কিংবা দুই হাজার নেতার মধ্যে একশো দুইশো দুর্বৃত্তকে সংসদ ও দল থেকে বের করে দিলে আওয়ামী লীগের মতো বড় দলের কিছুই যায় আসে না। ১৭-১৮ কোটি লোকের দেশে অসংখ্য ভালো ও যোগ্য মানুষ আছেন, যারা এই দলকে নেতৃত্ব দিতে পারেন। সুতরাং, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ববর্তী, স্বাধীনতার কাল এবং পরবর্তী প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে যে দলের নামটি উজ্জ্বল—সেই দল কেন শিক্ষক পেটানো নেতাদের অপকর্মের ভার বইবে?
- লেখক: আমীন আল রশীদ: নেক্সাস টেলিভিশনের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর।