বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়েছে, তবে প্রতিবেশীর কাছ থেকে আরও শেখার আছে
স্বাধীনতার ঠিক ৫০ বছর পূর্তির পর কোভিড-১৯ মহামারির মাঝে আরেকটি বড় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় বাংলাদেশ। গত বছর জাতিসংঘ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির নাম অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়। এমনকি বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের চেয়ে বেশি। তবে উদযাপনের বিষয়টি ব্যাহত হয়েছে এক কড়াঘাতে। বাংলাদেশ এখন এক কঠিন মুদ্রা ঘাটতির সম্মুখীন যা থেকে বের হতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সহায়তা প্রয়োজন।
২০২৬ সালে জাতিসংঘ বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণের সময় নির্ধারণ করলেও ভারসাম্যহীনতার কারণে বাংলাদেশ কি লক্ষচ্যুত হবে? তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো আগামী ২০ বছরে ১৬ কোটি মানুষ নিয়ে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পরবর্তী মাইলফলক অর্জনের অগ্রগতি কি স্তিমিত হয়ে পড়বে? এক্ষেত্রে বাংলাদেশের বৃহত্তর প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে কিছু ধারণা ও নসিহত দিতে পারে।
ডলার প্রতি ৮৬ টাকা মূল্য ধরে রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত বছরের তুলনায় ১৩ শতাংশ কমে ৪০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। বর্তমান রিজার্ভে আগামী চার মাসের আমদানির অর্থ পরিশোধ করা সম্ভব হবে। যেহেতু তিন মাসের কম সময়ের সামর্থ্য থাকা বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচিত হয়, তাই বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে আগেভাগেই ঋণ চাইছে। নইলে দেশের অবস্থা দেউলিয়া শ্রীলঙ্কার মতো হতে পারে, যেখানে কর্তৃপক্ষ ঋণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
তবে সমস্যাটি হলো টাকাকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিলম্ব করা। আনুষ্ঠানিকভাবে ডলারের মূল্য ৯৫ টাকায় নেমে আসলেও গত সপ্তাহে মুদ্রা বাজারে ১১২ টাকায় ডলার কেনাবেচা হয়েছে। অর্থাৎ, অভ্যন্তরীণ ভারসাম্যহীনতা বাড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে কর্তৃপক্ষ।
টাকার মান কমলে আমদানিকৃত জ্বালানি ব্যয় বেড়ে নয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৬ শতাংশ হারের মুদ্রাস্ফীতি আরও ত্বরান্বিত হবে।
এদিকে উচ্চমূল্যের প্রাকৃতিক গ্যাসের ঘাটতির কারণে ২০২৬ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ ঘাটতি মারাত্মক রূপ ধারণ করার শঙ্কা দেখা দিয়েছে যার মূল ভুক্তভোগী হবে শিল্প-কারখানার উৎপাদনকারীরা। রিপল ইফেক্টও দেখা দিতে পারে। ডলারের সংকট যদি গভীর মন্দার সৃষ্টি করে এবং এর ফলে খারাপ ঋণ বৃদ্ধি পায়, তাহলে করদাতাদের অর্থ দিয়ে সরকারের আর্থিক খাত উদ্ধারের চেষ্টায় জাঙ্ক-গ্রেড ক্রেডিট রেটিং (মুডি'স ইনভেস্টর সার্ভিসের মতে যা বিএ৩) আরও নামবে।
এখানেই নীতিনির্ধারকরা দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি ভারতের সঙ্গে বিষয়টি মিলিয়ে শিক্ষা নিতে পারে। প্রথম বিষয়টি হলো হার্ড-কারেন্সি সংকটের (যা প্রায় প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশকে মাঝেমধ্যেই বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে) কারণে অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হলে অনেককিছু ধীরগতির হয়ে যাবে।
১৯৯০-৯১ সালে যখন আমদানির জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার ফুরিয়ে গিয়েছিল তখন নয়াদিল্লি আইএমএফের দ্বারস্থ হয়। ভারতের মাথাপিছু আয় তখন ৩৯০ ইউএস ডলার। এরপর মাথাপিছু আয় ১০ ডলার বৃদ্ধি পেয়ে ৪০০ ডলারে আসতে দেশটিকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এই দীর্ঘ সময় লাগার কারণ তিন বছরের স্থিতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থার পরেও ভারতীয় ব্যাংকিং সিস্টেমের সম্পদের প্রায় এক-চতুর্থাংশই ছিল নন-পারফর্মিং।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো দুর্বল বছরগুলোতে অবশ্যই এমন সব সংস্কার করতে হবে যা অর্থনীতিকে নতুন করে প্রবৃদ্ধি অর্জনে সাহায্য করবে। ভারতের ক্ষেত্রে তা ছিল বাণিজ্য বাধা কমানো, শিল্প লাইসেন্স অগ্রাহ্য করা এবং আন্তর্জাতিক পুঁজির সঙ্গে স্থানীয় উদ্যোগগুলো যুক্ত করা। এই বিষয়গুলো ভারতের আর্থিক খাতের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করে যার ফলে ২০১২ সালের মধ্যে দেশটির মাথাপিছু আয় চারগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১৫০০ ইউএস ডলারে এসে দাঁড়ায়।
কিন্তু ভারত আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে যথেষ্ট উদ্যোগী না হওয়ায় মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের বড় প্রকল্পগুলোর জন্য গৃহীত ঋণ শেষ পর্যন্ত ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ভারত যখন গতি হারাচ্ছিল, তখন বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে। মাত্র এক দশক আগে মাথাপিছু আয় ১,০০০ ইউএস ডলারের কিছু বেশি থাকলেও গত বছর তা বেড়ে ২,৬০০ ইউএস ডলারে পৌঁছে।
জীবনযাত্রার প্রকৃত মান, মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে ক্রয়ক্ষমতার সামঞ্জস্যে ভারত এখনও ৪ শতাংশ হারে এগিয়ে থাকলেও এই ব্যবধান অনেক কমেছে। ২০১৩ সালে ঢাকায় রানাপ্লাজা ধসে যখন ১,১০০ জনের বেশি গার্মেন্টস শ্রমিক নিহত হয় তখন এই ব্যবধান ছিল ১১ শতাংশ।
কোন বিষয়টি বাংলাদেশের পক্ষে ছিল? স্বল্প-দক্ষতার তৈরি পোশাক রপ্তানি খাতে বাংলাদেশ তার কর্মক্ষম জনশক্তির বিরাট একটি অংশ কাজে লাগিয়ে রপ্তানি আয়ে উন্নতি লাভ করে। অন্যদিকে ভারত উচ্চ-দক্ষতার বিভিন্ন খাত যেমন সফটওয়্যার, আউটসোর্সিং এর দিকে ঝুঁকে যার ফলে দেশটির ১০০ কোটি জনশক্তির বেশ ক্ষুদ্র অংশ উপকৃত হয়। ২০২০ সালে পেনসিলভেনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ সৌমিত্র চ্যাটার্জি এবং ভারতের সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রামানিয়ানের প্রকাশিত এক গবেষণায় উঠে আসে এসব তথ্য।
বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ অমিত বাসোলের নতুন গবেষণায় দুই দেশের এই দুধরনের পদক্ষেপের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশ প্রতি এক শতাংশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভারতের চেয়ে তিনগুণ বেশি কর্মসংস্থান তৈরি করেছে।
বিগত তিন দশকে উভয় দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে কৃষকদের সংখ্যা কমেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ সফলতা পেয়েছে।
বাসোলের মতে পরবর্তীতে যা ঘটবে তা আরও গুরুত্বপূর্ণ। এখন এই উদ্বৃত্ত শ্রম কি কৃষিখাত থেকে বেরিয়ে উচ্চ উত্পাদনশীল ও বাড়তি মজুরি খাতের আধুনিক কোনো পেশায় যুক্ত হয়? নাকি এই শ্রমিকরা ভারতের মতো খামারের কাজ থেকে অবকাঠামো নির্মাণের মতো অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানে যোগ দেয়?
এখানে বাংলাদেশের রেকর্ড কিছুটা ভালো। আর ভালো বলেই সম্ভবত বাংলাদেশের কর্মখাতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। যদিও তা এখন পর্যন্ত মাত্র ৩৫ শতাংশ। তবে ভারতে নারীদের কর্মখাতে অংশগ্রহণের হার মাত্র ২১ শতাংশ, যা দিন দিন আরও কমছে।
ঢাকা-ভিত্তিক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ব্লুমবার্গ নিউজকে বলেন, আইএমএফকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ উপকৃত হতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের এই সুযোগ নেওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে যে শিক্ষা নিতে হবে তা হলো ব্রড-বেজড ওয়েজ গ্রোথের দিকেও নজর দেওয়া।
১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি থেকে টেক্সটাইল রপ্তানিতে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের জন্য বিশ্বের দরিদ্রতম দেশের কাতার থেকে ওঠে আসা অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ। কিন্তু এখন আসুন কঠিন বিষয়টিতে। উচ্চ-মধ্যম আয়ের মর্যাদা পেতে, প্রত্যেক বাংলাদেশির আয় আরও ৬০ শতাংশ বাড়াতে হবে। এর জন্য শিল্প ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে ঋণের প্রয়োজন হবে।
কিন্তু সমস্যা এই যে দেশের আর্থিক খাত এখনও অনুন্নত। সরকারি ব্যাংকগুলোর ১৪ ট্রিলিয়ন টাকার সম্পদ দেশের মোট দেশজ আয়ের মাত্র ৪০ শতাংশের সমতুল্য। এর চেয়েও খারাপ বিষয় হলো প্রায় ৪০ শতাংশ ব্যাংকিং সম্পদ ০.৫ শতাংশের কম রিটার্ন অর্জন করছে। অর্থাৎ, মূলধনগুলো ভুল জায়গায় বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। ভারত দীর্ঘদিন এই বিষয়ে মাথা ঘামায়নি। বাংলাদেশ যেন সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি না করে।