আমদানি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে উত্তরণের পথ খোঁজার চেষ্টা করছে সরকার, সফল হবে?
কোভিড- ১৯ মহামারির পর পৃথিবীর গরিব দেশসমূহ যখন ধুঁকছে, যখন সংকট থেকে বেরিয়ে আশার রাস্তায় হাঁটার চেষ্টা করছে- তখনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষভাবে ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করে বিশ্বে নতুন অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে। খাদ্যশস্য, জ্বালানি তেল ও পরিবহন সবকিছুতেই এক চরম সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সবচেয়ে বেশি সংকটে আছে ইউরোপের দেশগুলো। ইউরোপের বৃহৎ অর্থনীতির দেশ জার্মানি এমন এক আশঙ্কায় ভুগছে যে, আসন্ন শীতে তাদের দেশের প্রচুর বৃদ্ধ মানুষ জীবন হারাবে জ্বালানির অভাবে। এখনই তারা জ্বালানি ব্যবহার সংকোচনের নানান ধরনের নীতি গ্রহণ করেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত ৭০ বছর যাবত পৃথিবীর নানান প্রান্তে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে যুদ্ধকে টিকিয়ে রেখেছে, যুদ্ধের বিস্তৃতি ঘটিয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই, তাদের ক্ষমতার সার্বভৌমত্ব আর ডলারের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখা। ১৯৪৪ সালে গড়ে ওঠা বিশ্বব্যাংক আর আইএমএফ গঠনের মাধ্যমে সারা বিশ্বে যে অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চালু করেছে- তা ধরে রাখার জন্যই সারা বিশ্বকে নানানভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে রাখে আমেরিকা।
তুরস্ক আর জাতিসংঘ পুতিনের সঙ্গে মিলে যখন ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রপ্তানির ব্যাপারে একটি সমঝোতার রাস্তায় গিয়েছে- তখনই আবার নতুন করে এশিয়াতে সেই যুদ্ধাবস্থা তৈরিতে কাজ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। চীনের সঙ্গে এক ধরনের বাণিজ্যিক লড়াই শুরু করেছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প; ধারণা করা হয়েছিল, ডেমোক্রেটিক দলের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুসৃত পথকে এড়িয়ে চলবেন। এখান থেকে বেরিয়ে আসবেন।কিন্তু তা ঘটেনি।
অতীতের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে তাকালে আমরা দেখব- ইতিহাস সাক্ষী দেয় রিপাবলিকান দলটি বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে সবসময়। ডেমোক্রেটিক পার্টিও ধোয়া তুলসী পাতা নয়। তবে যুদ্ধের হিসাব করলে দেখা যাবে রিপাবলিকানরাই অগ্রগামী। খুব সামান্য ভোটের ব্যবধানে জো বাইডেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হারালেও, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর অভ্যন্তরীণ যে সংকটগুলো ছিল তার তেমন সমাধান করতে পারেননি।
দেশটির অভ্যন্তরে বর্ণবাদ, ধর্মীয় বিভাজন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে বলেই মনে করা যায়। দীর্ঘকাল সমাজে যেসব বিষয় অনিষ্পন্ন ছিল- সেগুলি নানানভাবে ফেরত আসছে। যেমন নারীদের গর্ভপাত করার অধিকার। বিষয়টি ইতঃপূর্বে সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমেই নিস্পত্তি হয়েছিল বহুকাল আগে। আবার দলীয়ভাবে বিভাজিত রিপাবলিকান দলের নিয়ন্ত্রিত সুপ্রিমকোর্ট সেই বিষয়ে নতুন করে রায় দিয়ে নারীদের গর্ভপাতের অধিকারকে বাতিল করে দিয়েছেন। এমনই আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভাজিত অবস্থানকে কাটিয়ে উঠার জন্য এবং তাদের জাতীয় অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি- যুদ্ধকে অব্যাহত রাখার জন্য নতুন করে যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি করছে।
এশিয়াতে চীনের নেতৃত্বে যে অর্থনৈতিক বিবর্তন শুরু হয়েছে, তাকে আটকে দেওয়ার জন্য চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে নানানভাবে উস্কানি দিচ্ছে। এবং তাইওয়ানকে ব্যবহার করছে; দক্ষিণ চীন সাগরের ইস্যু নিয়ে চলছে যুদ্ধাবস্থা।
১৯৭১ সনে এক চীন নীতি মেনে নিয়ে কমিউনিস্ট চীনকে জাতিসংঘের পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ ও স্থায়ী সদস্য মর্যাদা দেওয়া হয়। এবং এতদিন আমেরিকা চীনের এক চীন নীতির দাবি অনুসরণ করে চলছিল বলা যায়। কিন্তু, বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদ (কংগ্রেস)-এর স্পিকারের দীর্ঘ ২৮ বছর পর- নিজ দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা হিসাবে তাইওয়ান সফর করেছেন এবং এর মাধ্যমে চীনকে উসকানি দেওয়া হয়েছে।
চীনের বিরুদ্ধে এই এলাকায় আমেরিকা আরো সঙ্গে পাচ্ছে জাপানসহ আরো দুই-একটি দেশকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিনীদের কাছে পরাজিত জাপান সবসময়ই চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে, কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ব সময়ে দীর্ঘদিন জাপান চীনের নানান অংশকে উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবসা তার প্রধান চালিকাশক্তি। এর বাইরে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে বিশ্বব্যাংকের মতন অর্থনৈতিক সংগঠন দিয়ে। আইএমএফ- এর শর্ত মেনে পৃথিবীর নানান দেশ তাদের কাছ থেকে ঋণ সাহায্য নিচ্ছে যা প্রকারান্তে মার্কিন নিয়ন্ত্রিত। এতে বিশ্বে বড় বড় অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশও বাধ্য হয়েছে সেই রাস্তায় হাঁটতে; অতি সাম্প্রতিককালের তেলের মূল্যবৃদ্ধি আইএমএফ-এর শর্ত অনুসারে হয়েছে। যার ফলে দেশ এক বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি পড়তে পারে। আমদানি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের ভেতর দিয়েও সমাধান খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে সরকার। কিন্তু বাস্তবে কি তা ঘটবে? বর্তমানে দেশের আমদানি ব্যয় মেটাতে বহুলাংশে প্রবাসী আয়ের ওপরও নির্ভর করতে হয়। রপ্তানি বাণিজ্যকে শক্তিশালী না করতে পারলে, এই অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটবে না। ঘুরে ফিরে এভাবে আইএমএফ কিংবা বিশ্বব্যাংক অথবা আর কোনো তৃতীয় পক্ষের দ্বারস্থই হতে হবে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।