লাল-সবুজ জার্সির, পাহাড়ি মেয়ে যেন বলশয় ব্যালেরিনার নৃত্য মনে করিয়ে দেয়!
লাল-সবুজ জার্সি পরনে, পাহাড়ি মুখ-চোখের একটি মেয়ে যেন-বা বলশয় ব্যালেরিনার নৃত্য মুদ্রায় একটি বল ধরতে উড়ে যাচ্ছে উঁচুতে, এমন একটি ছবি শত শত বাংলাদেশীর সামাজিকমাধ্যমে প্রো-পিক বা কাভার ফটো হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে গত দু-তিন দিনে। প্রতিপক্ষের অনেককে পাশ কাটিয়ে দশ নম্বর জার্সিধারী খেলোয়াড় কৃষ্ণার সাফ ফাইনালে প্রতিপক্ষ নেপালের গোলবারে বিজয়সূচক পরপর দুটো গোলের দৃশ্য ফেসবুকে হাজার হাজার দর্শক, বিশেষত ছেলে দর্শকরাই শেয়ার করেছে বেশি, যেহেতু গড়পড়তা মেয়েরা আজও ফুটবলের খুঁটিনাটিতে অতটা হয়তো বিশেষজ্ঞ নয়। এটা সত্যি যে খেলোয়াড়দের সাফল্যে যত দ্রুতই উচ্ছ্বসিত হয় ভক্তরা, তাদের ব্যর্থতাতেও ততই দ্রুত নিরাশ হয় তারা।
আর জার্মান ফুটবল দলের তুর্কি বংশোদ্ভূত তারকা মেসুত ওজিল যেমন একবার বলেছিলেন, 'যতক্ষণ আমরা জিতি, ততক্ষণ আমি জার্মান আর যখন আমরা হারি, তখন আমি তুর্কি অভিবাসী!' অথবা আলজেরীয় বংশোদ্ভূত ফরাসি ফুটবল দলের অধিনায়ক জিনেদিন জিদানকে যেমন খোদ বিশ্বকাপের আসরে প্রতিপক্ষ ইতালির এক খেলোয়াড় 'সন্ত্রাসী মায়ের সন্তান' বলায় মেজাজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলেন জিদান এবং উত্তরে জুটেছিল লাল কার্ড, খেলার মাঠে দশজন নিয়ে খেলে হেরে যেতে হয়েছিল ফরাসি দলকে। জীবনের আর সব দিকের মতো ক্রীড়া ভুবনও লৈঙ্গিক, বর্ণ বা জাতিগত বিদ্বেষমুক্ত তো নয়।
কাজেই আজ যে সানজিদা-শামসুন্নাহার-রূপনা চাকমা-ঋতুপর্ণা চাকমা-কৃষ্ণা সরকার-আনাই মগিনী-মারিয়া মান্ডা-সোহাগী কিস্কুদের দল নিয়ে আমাদের এত বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস, সেই উচ্ছ্বাস কর্পুরের মতো মিলিয়ে যেতে কতক্ষণ? একে তো কঠোর দক্ষিণ এশীয় পিতৃতান্ত্রিক নিগড়ে বাঁধা আমাদের সমাজ যেখানে অধিকাংশ মধ্যবিত্ত মেয়ে বয়স এগারো-বারো হতে না হতেই স্কুলে যাওয়া-আসাটুকু ছাড়া খেলাধুলা, সামাজিক গতিশীলতা হারিয়ে ফেলে, তাতে সেই সমাজের 'মেয়ে' হয়ে সমাজ নির্ধারিত নারীর জন্য বেঁধে দেওয়া কঠোর 'পোশাক বিধি' উপেক্ষা করে, ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার মেঘালয় সীমান্তবর্তী গ্রাম ধোবাউড়ার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম কলসিন্দুর যেন বলিউডের আমির খানের সিনেমা 'লগান' বা 'চাক দে ইন্ডিয়া'র গল্পকেও হার মানাচ্ছে।
'লগান' বা 'চাক দে ইন্ডিয়া' যখন রুপালি পর্দার ইচ্ছাপূরণের রূপকথা হিসেবে পর্দাতেই থেকে গেছে, বাংলাদেশের 'কলসিন্দুর' গ্রাম রূপকথার চেয়েও বেশি কিছু হয়ে উঠেছে! এবং এখানে আখ্যানের মুখ্য চরিত্র কাদামাখা ভারতীয় ছেলেদের বদলে বাংলাদেশের কিছু বাঙালি ও আদিবাসী মেয়ে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তবর্তী ধোবাউড়ার কলসিন্দুর গ্রাম থেকেই এবারের সাফ জয়ী দলের এগারোজনের আটজন উঠে এসেছেন। তাঁরা হলেন: সানজিদা আক্তার, মারিয়া মান্দা, শিউলি আজিম, তহুরা খাতুন, শামসুন্নাহার সিনিয়র ও শামসুন্নাহার জুনিয়র, সাজেদা খাতুন ও মার্জিয়া আক্তার।
কলসিন্দুর গ্রামে বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম ছাড়াও আদিবাসী মান্দি বা গারো সম্প্রদায়ের বাস, যাদের কথা ফাইনালে খেলার আগের দিন মিডফিল্ডার সানজিদা আক্তার ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছিলেন—'পাহাড়ের কাছাকাছি স্থানে বাড়ি আমার। পাহাড়ি ভাই-বোনদের লড়াকু মানসিকতা, গ্রাম বাংলার দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষদের হার না মানা জীবনের প্রতি পরত খুব কাছাকাছি থেকে দেখা আমার। ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়ব এমন নয়, এগারোজনের যোদ্ধাদল মাঠে থাকবে, যে দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে।'
কেউ কি বিশ্বাস করবেন যে আজ যে সাফ ট্রফিতে চুম্বনরত মারিয়া মান্ডার ছবি আমরা দেখছি, তার মাকে অভাবে একসময় অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজও করতে হয়েছে? শৈশবে মারিয়াকেও করতে হয়েছে পরের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ। কিন্তু তারপর সেই কলসিন্দুর বিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক মফিজ স্যারের হাত ধরে প্রথমে ২০০৯ সালে কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেয়েদের নিয়ে ফজিলাতুন্নেছা কাপের জন্য দল গঠিত হওয়া, প্রথম দুবছর চ্যাম্পিয়ন হতে না পারা, পরে কঠোরতর পরিশ্রম ও অনুশীলনের মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া থেকে আজ হিমালয়ের কোল থেকে আঞ্চলিক প্রমীলা ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা নিয়ে বাড়ি ফেরা। অথবা দর্জি বাবার মেয়ে কৃষ্ণা যে বাতাবী লেবুতে লাথি মেরে আর ভাইদের সাথে সাইকেল চালিয়ে এবং ফুটবল খেলে শৈশবেই পাড়ায় বেশ 'বদনাম' অর্জন করেন। স্নেহময় পিতা মেয়েকে একটি সস্তার ফুটবল কিনে দিলেও পাড়ার লোকের কটুকথায় অস্থির মা একদিন ফুটবলটি কুচি কুচি করে কেটেও ফেলেছিলেন। তারপর ছোট্ট মেয়ের অবোধ কান্না দেখে মায়ের অনুতপ্ত হওয়া। সেই প্যাশনকে অবলম্বন করেই আজ আমাদের নারী ফুটবল দলের দশ নম্বর জার্সির এতটা পথ যাওয়া! সানজিদার অতি সাধারণ বাবা লিয়াকত আলী মেয়ের দলের নেপাল জয়ের পর পাড়া-পড়শির কাছে সুনাম অর্জন করে গর্বিত। সানজিদার যে মা মেয়েকে সবসময় দুমুঠো ভাত খাওয়াতে পারেননি বলে দুঃখ করেন, আজ সেই মেয়ের প্রশংসায় এলাকাবাসী উচ্ছ্বসিত। নারী ফুটবলার তহুরা খাতুনের বাবা ফিরোজ মিয়ারও একই রকম অনুভূতি।
'বাবুই পাখি' রাষ্ট্র বাংলাদেশ যা কিছু অর্জন করেছে এই সাফ ফাইনালে জয়ের মাধ্যমে
কিন্তু আমরা কি শুধু মেয়েদের সাফ ফাইনালের সোনাই জিতলাম? না, রাষ্ট্র হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের অনেক প্রত্যাশিত স্বপ্ন আমরা আজও পূরণ করতে না পারলেও, আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে সর্ব জাতিসত্তা ও ধর্মের খেলোয়াড়দের প্রতিনিধিত্ব কিন্তু আরো একটি শুভতার বার্তা বহন করছে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশে ওরা যে বার্তাটি দিতে পেরেছে সেটা হচ্ছে চাইলেই আমরা একটি 'বহুত্ববাদী' সমাজ খুব সুন্দরভাবেই নির্মাণ করতে পারি। ভারতের মতো দেশে যেখানে জাতীয় ক্রিকেট দলে উত্তর ভারত, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব বা দক্ষিণ ভারতের কোনো কোনো রাজ্যের খেলোয়াড় ছাড়া বহু রাজ্যের খেলোয়াড়দের প্রতিনিধিত্বই দেখতে পাবেন না, সেখানে আমরা কিন্তু এমন 'বহুস্বরবাদী' দল গঠন করতে পেরেছি! পাহাড়ি-বাঙালি সব নারী খেলোয়াড়ের প্রতি ভক্তদের বাঁধভাঙা ভালবাসা তারই প্রমাণ।
তবু জেগে থাকে পিতৃতন্ত্রের অমোঘ শেকল...
আঞ্চলিক নানা ফুটবল ম্যাচে বাংলাদেশের পুরুষ খেলোয়াড়দের লাগাতার ব্যর্থতা ও মেয়েদের সমানুপাতিক সাফল্যের ধারার পরেও ক্লাব ফুটবলে একজন শীর্ষ ঘরানার পুরুষ খেলোয়াড় যেখানে বছরে আয় করেন ৫০-৬০ লাখ টাকা, মেয়েরা সেখানে পান মাত্র ৩-৪ লাখ টাকা। 'এ' শ্রেণির নারী ফুটবল তারকাদের বেতন মাসে মাত্র দশ হাজার টাকা। এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য ইতোমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। এর আগেও নানা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে জিতেও লোকাল বাসে চড়ে আমাদের 'সোনার মেয়েদের' উল্টো নিগৃহীত হওয়ার ঘটনাও অজানা নয়।
সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে এবার নারী ফুটবলাদের প্রতি খোদ বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) এবং বাফুফে প্রধান ও একসময়ের নামী ফুটবল তারকা সালাউদ্দিনের নিস্পৃহ কিছু আচরণে। ভাবা যায় যে নেপালে স্থানীয় জনতার পুরো সমর্থনের বিপক্ষে আমাদের মেয়েরা যখন অসামান্য খেলে জিতছে, যখন বিদেশি ধারাভাষ্যকারের কণ্ঠে আমাদের গোলকীপার রুপনা চাকমার 'চৈনিক দেয়াল'সম প্রতিরোধকে 'আন্তর্জাতিক মানে'র খেলা বলে উচ্ছ্বসিত বন্দনা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, তখন বাফুফের ওয়েবসাইটে কিনা মহাখালীর একটি ফুটবল ম্যাচের খবর আপডেট হচ্ছে?
মেয়েরা জেতার পর প্রথম দু-ঘণ্টা বাফুফে প্রধান তাঁকে করা সাংবাদিকদের ফোনও রিসিভ করেননি। যদিও পরে তিনি বলেছেন যে, 'অত্যন্ত আনন্দিত' হবার কারণে তিনি 'ফোন রিসিভ করেননি।" ক্ষুব্ধ বাংলাদেশী তরুণেরা তাঁকে নিয়ে যে 'মিম' বানিয়েছে যে 'মেয়েদের পুরস্কার দিতে না পারলেও তাদের বিয়ের সময় সব খরচ বাফুফে বহন করবে', এখানেই বাংলাদেশের মেয়েরা প্রচণ্ডভাবে জিতে গেল! আজ লাখো লাখো বাংলাদেশি ভাইয়েরাও যে বোনদের আন্তর্জাতিক অর্জনে গর্বিত হচ্ছেন এবং তাদের প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদার প্রশ্নে মুখ খুলছেন, 'বিয়ে'ই পরম লক্ষ্য বলে সাধারণ কোনো হুজুরের বক্তব্য থেকে খেলার জগতেরই অনেকের অন্তর্নিহিত পিতৃতান্ত্রিকাতে ঠাট্টা করছেন, এটাই আমাদের পরম পাওয়া!
রবীন্দ্রনাথের 'অপরিচিতা'য় যে যৌতুকলোভী বরপক্ষ মেয়ের বাবা মেয়ের সোনার গয়নায় ওজনে ফাঁকি দিতে পারে, এমন সন্দেহ পোষণ করায় মেয়ের বাবা শেষমূহূর্তে বিয়ে দেন না যে এত নীচু মনের বরপক্ষের সাথে বিয়ে দেবেন না এবং বরপক্ষ খুব ক্ষেপে গিয়ে ভাবে যে 'দেখি মেয়ের বিয়ে দেন কেমন করিয়া', কিন্তু 'মেয়ের বিবাহ হইবে না এই ভয় যাহার নাই' তাঁর সাথে কি করা যাবে ভেবে উঠতে পারে না, তেমনই জনচিত্তের কিছু পরিবর্তনও লক্ষ করা গেল এবার। অবশ্য সমাজের প্রথা খুবই কঠিন। রবীন্দ্রনাথ অমন গল্প লিখলেও নিজেই মেয়েদের বাল্যবিবাহ দিয়েছেন যেখানে তাঁর বড় দাদা-দিদিদের মেয়েদের কারো সেই যুগে ২৬ বা ৩৩-এ বিয়ে হচ্ছে। অপদার্থ ও যৌতুকলোভী জামাতাদের কাছে তাঁর মতো কবিকেও অপমানিত হতে হয়েছে। তবু আজ বাংলাদেশে খুবই সাধারণ যে, মা বলছেন যে তাঁর মেয়েদের সাফল্যের প্রশ্নে স্বর্গ-নরকের দেখানো ভয়ে তিনি বিচলিত নন, সেটাই বড় অর্জন।
হুডখোলা ছাদে ফেরা হলো, তবু...
অবশেষে সানজিদার 'হুডখোলা' গাড়ির স্বপ্নকে সম্মান জানিয়ে মাননীয় ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী এক দিনের ভেতর হুডখোলা বাসের ব্যবস্থা করেছেন। অধ্যাপক জাফর ইকবাল বা নামী সাংবাদিকেরাসহ অনেকেই গোটা ঢাকাজুড়ে পুষ্প বৃষ্টিতে স্বাগত জানিয়েছে আমাদের মেয়েদের। অপরিকল্পিত নগরায়ণের বিলবোর্ডের খোঁচায় ঋতুপর্ণার আহত হওয়া মানা গেলেও এই জয়ের রূপকার বাংলাদেশ দলের কোচ (যাঁকে এতদিন 'মেয়েদের কোচ' বলে উপেক্ষা সইতে হয়েছে), অধিনায়কসহ দলের মেয়েরা সামনে বসার জায়গা পাননি। জায়গা পেয়েছেন বাফুফেকে ডুবিয়ে ফেলা কিছু অনড় আমলা। অথচ, ইউরো ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হবার পর ব্রিটিশ নারী টিমের 'প্রেস মিটে' শুধু খেলোয়াড়দেরই দেখা গেছে যেখানে কিনা আমাদের মারিয়াদের পাশের রুমে বসে ফেসবুক লাইভ করতে হয়েছে।
পত্রিকার খবরে সানজিদাদের লাগেজ থেকে মূল্যবান ডলারসহ আরো কিছু দামি জিনিস খোওয়া যাবার খবর পড়েও মন খারাপ লাগছে। তবে বাফুফে প্রধান এখন সব খেলোয়াড়কে দুই লাখ টাকা প্রদান করা হবে বলে বলেছেন। একদিনে সব প্রজন্মের সবার ভেতরের পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবসান হয়তো হবে না, তবু একটু একটু করে হলেও পরিস্থিতি বদলাবে বা বদলাচ্ছে এটাই আশার কথা।
আমাদের ঋতুপর্ণা তাঁর ফেসবুক পেজে চাকমা বর্ণমালায় সবাইকে শুভেচ্ছা জানান। সানজিদা সৃষ্টিকর্তার কাছে 'তৌফিক' চান বা কৃষ্ণা তাঁর 'উপাস্য দেবতা'র কথা বলেন। আর দিনশেষে সবাই বাংলাদেশের হয়ে খেলেন। আপাতত এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় জয়।
- লেখক: কথাসাহিত্যিক