আমাদের সন্তান প্রতিদিন একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে
বাবা মায়ের কোল আলো করে যে সন্তান আজকে ভূমিষ্ঠ হচ্ছে, কাল থেকেই সেই সন্তানকে বাবা মা নিজের অজান্তে বিষ খাওয়াতে বাধ্য হচ্ছেন, কথাটা ভাবতেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে, আতংক হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও চারিদিক থেকে সেই কথাগুলোই শুনতে পাচ্ছি এবং সেটাই সত্য।
সন্তানকে খাবারের মাধ্যমে শুধু কি বিষ খাওয়াচ্ছি? আমাদের শিশুরা বাংলাদেশের ভয়াবহ দূষিত বাতাসে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, ঘরের ভিতরে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে, তাদের খেলা-দৌঁড়ানো-গল্প শোনা সব বন্ধ। শিশুর হাতে মোবাইল, সামনে টিভি, কানে হেডফোন, পিঠে বইয়ের বোঝা। গোপনে হাতে তুলে দিচ্ছে মাদক, পর্ণোগ্রাফি ও অপরাধ শিক্ষা। সন্তানের শৈশব-কৈশোরকে হত্যা করছি আমরা। আমাদের সন্তান, প্রতিদিন একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে।
আর দেশের অগণিত দরিদ্র ও পথশিশুদের যেহেতু কিছুই নেই, তাই তাদের শরীর ও মন থাকলেও, জীবন বলে কিছু থাকে না। কারণ এদের জীবনতো গড়েই উঠতে পারেনা মানবেতর অবস্থায় জন্মানো ও বেড়ে ওঠার কারণে।
আজকে শিশু স্বাস্থ্য ও মৃত্যু নিয়ে কথা বলছি একারণে যে, সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে শুধু বাংলাদেশেই সাড়ে তিন কোটি শিশুর রক্তে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় সীসা আছে বা তারা সীসার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত। অর্থাৎ দেশের শতভাগ শিশুর শরীরে সীসার উপস্থিতি দেখা গেছে। আইসিডিডিআরবি ও আইইডিসিআর যৌথভাবে এই ভয়াবহ তথ্য উপস্থাপন করেছে।
ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিক্স ইভাল্যুয়েশন (আইএইচএমই) মতে, সীসার কারণে বাংলাদেশে মৃত্যুহার বিশ্বে চতুর্থ।
একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন কারো ঘরেই শিশুরা টানা কয়েকদিন সুস্থ থাকতে পারছে না। রোগ-ব্যধি লেগেই আছে। বাবা-মা যতোটুকু পারছেন বাচ্চা নিয়ে ছুটোছুটি করছেন। সবচেয়ে আশংকাজনক ব্যাপার হচ্ছে বিভিন্ন দূষণের কারণে রোগে ভুগতে ভুগতেই শিশুরা বড় হচ্ছে। মুষ্টিমেয় যে কজন শিশু ভালো পথ্য পাচ্ছে, নিয়মিত ওষুধ ও সেবা পাচ্ছে, তারা কোনভাবে উৎরে গেলেও অধিকাংশ বাচ্চা শরীরে অসুখ নিয়ে বেড়ে উঠছে।
আজকাল দেখা যায়, আমাদের অনেকেই কোন কারণ ছাড়াই হাঁচি, কাশি, শুকনো কাশি, জ্বর, নিঃশ্বাসে কষ্ট, এসিডিটি, তলপেটে ব্যথা, বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য, ক্লান্তি, অবসাদ দুর্বলতা, মাথাব্যথা, খাবারে অরুচি, হাতে-পায়ে ব্যথায় ভুগছি। এমনকী স্মৃতিশক্তিও কমে যাচ্ছে।
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই অভিযোগগুলো আরো বেশি। যারা পারছে তারা গাদা গাদা টাকা খরচ করে ভালো থাকার ও বাচ্চাকে ভালো রাখার চেষ্টা করছেন, যারা পারছেন না তারা সৃষ্টিকর্তার উপরে সব ছেড়ে বসে আছেন। কিন্তু ফলাফল সেই একই, কোন শিশুই সেইভাবে ভাল থাকছে না। আমরা বড়রাও সুস্থ থাকতে পারছি না। কারণ আমাদের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে বিষাক্ত সীসাসহ আরো নানাধরণের উপাদানে। এছাড়া ধুলাবালি, ভেজাল খাবার আমাদের শিশুদের সব শক্তি কেড়ে নিচ্ছে।
সীসাকে ধাতু হিসেবে এবং এক ধরনের মাদক হিসেবেই জানতাম। গ্রামেগঞ্জে হুক্কাতে সীসার ব্যবহার ছিল। বিশ্বের কোন কোন দেশে ঐতিহ্য ও ফ্যাশান করে হুক্কার মাধ্যমে সীসাগ্রহণ চলে। ঢাকাতেও কোন কোন হোটেল-রেঁস্তোরায় এইটা টানার চল চলু আছে। কিছু স্থানীয় প্রসাধনী, সস্তা আয়ুর্বেদিক ওষুধ, খেলনা, অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি পাতিল, তাবিজ ও গয়নায় সীসার ব্যবহার হতে দেখেছি। কিন্তু জানতামই না যে এটা এত মারাত্মক ধাতু।
সীসা ধাতুটি শিশু ও বড় মানুষ সবার ক্ষতি করে। বিশেষ করে এটা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মস্তিকের ক্ষতি করে বলে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মনে করেন। তারা বলছেন, শরীরে জমা সীসা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। স্নায়ুবিক ও দেহগত বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। পাইলস, ফিসচুলা, গ্যাস্ট্রিকের বা আলসার, লিভার বা কিডনির রোগ বাড়াবে। প্রায় সবধরণের অসুখের কথাই জানতে পারছি সীসার অতি ব্যবহার থেকে।
তবে সবচেয়ে ভয়ের কথা গর্ভবতী নারী ও গর্ভের ভ্রূণের জন্য মোটেও নিরাপদ নয় এটি। তা ছাড়া গর্ভবতী নারীর রক্তে অতিরিক্ত সীসা অপরিণত শিশু জন্মের কারণ হতে পারে। লক্ষ্য করলে দেখবো যে বেশ কয়েকবছর থেকেই অসুস্থ, অপরিণত, প্রতিবন্ধী বা অটিস্টিক বচ্চা জন্ম নেয়ার হার বাড়ছে।
আমাদের শরীরে পুষ্টির অভাব, দূষিত পরিবেশ এবং সীসার কুপ্রভাব বিষয়ে অজ্ঞনতা সীসা দূষণকে আরও ত্বরান্বিত করছে। বাংলাদেশ সবচেয়ে মারাত্মকভাবে সীসা-প্রভাবিত দেশগুলির মধ্যে একটি, যেখানে লাখ লাখ শিশু শিশু সীসার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত। সীসার সমস্যা হলো এটা শরীরে ঢুকলে শরীর থেকে বের হয়ে যায় না, সারা জীবনই এটা শরীরে জমা হতে থাকে। জমে জমে একসময় সেটা কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সীসা আমাদের একশো ভাগ শিশুর শরীরে ঢুকছে কেমন করে? গবেষণায় বলা হয়েছে শিশুরা সীসামিশ্রিত জিনিস ধরে এবং সরাসরি মুখে হাত দেয়। গুড়া হলুদে সীসা দেয় রং উজ্জ্বল করার জন্য। বিভিন্ন খাবারেও কৃত্রিম রং ব্যবহার করে। এই রং সরাসরি শরীরে ঢুকে যাচ্ছে। আমাদের মতো দেশগুলোতে সীসার আর একটি বড় উৎস হচ্ছে লিড এসিড ব্যাটারি। লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশে যেকোন নিষিদ্ধ জিনিস অনিয়নন্ত্রিতভাবে বাজারে ঢুকে পড়ে এবং পুরো বাজার দখল করে নেয়। সীসাও ঠিক তেমনি একটি পদার্থ।
এইতো কয়েকবছর আগে থেকে নতুন ভবনে সোলার প্যানেল বসাতে বাধ্য করা হলো। সাথে ব্যাটারি কিনতে হলো বিল্ডিং এর জন্য। কিন্তু সেই প্রজেক্ট আরো অনেক প্রজেক্টের মতোই ব্যর্থ হলো। যেহেতু প্রয়োজনের সময় এগুলো থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না, তাই শহরের সব দালানে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে গ্রাহকের লক্ষ লক্ষ টাকার সোলার সিস্টেম, নষ্ট হচ্ছে সোলার প্যানেল, ব্যাটারী পঁচে দুষিত হচ্ছে প্রকৃতি।
সীসার ব্যবহারটা কীভাবে এলো, ১৯২১ সালে আমেরিকার ডেয়টোন মেটাল ও ফোর্ড মোটর কোম্পানি জোট বেধে হয়ে গবেষণা শুরু করে গাড়ির ইঞ্জিনের কমপ্রেশন বাড়ানো ও কমবাশন সাইকেল সঠিক করার উপায় বের করার জন্য। গাড়ির ইঞ্জিনের সুরক্ষা ও পারফরমেন্স বাড়ানোর জন্য ১৯২৫ থেকে পেট্রোলে মেশানো শুরু হয় সীসা।
পাঁচ ভাগ বিজ্ঞানী এর কিছু বিরোধিতা করলেও, বাকী ৯৫ ভাগ বিজ্ঞানী, পরবর্তী ৫০ বছর প্রমাণ করতে চেষ্টা করে যে লেড বা সীসার কোন ক্ষতিকর প্রভাব নেই। শুধু একজন বিজ্ঞানী নানা রকম অর্থলোভ জয় করে, ভয়-ভীতি ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ২০ বছরের প্রচেষ্টায় আদালতে প্রমাণ করতে সমর্থ হন যে প্রাণী দেহে ও সাগরের পানিতে সীসা জমে থাকে, সেটা ক্ষয়ে যায় না। যা প্রাণী স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। পরবর্তীতে উন্নত বিশ্বে পেট্রোলে লিড মেশানো বন্ধ হয়। (তথ্যসূত্র: সিরাজুল হোসেন)
কিন্তু বাংলাদেশসহ অন্যান্য নিম্ন আয়ের দেশের শিল্পকারখানাগুলোয় সীসার ব্যবহার বাড়ছেই। যেহেতু তেমন কোন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নাই, তাই সরাসরি পৌঁছে যায় বাতাসে। দেশজুড়ে বেড়েছে ব্যাটারিচালিত রিক্সার চলাচল। ২০২১ সালে অবৈধ ব্যাটারি চালিত সব ইজিবাইক চিহ্নিত করে অপসারণ করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। কিন্তু এরপরেও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে চলেছে ব্যাটারি চালিত অবৈধ ইজিবাইক আমদানি এবং বেড়েছে দেশে তৈরি ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক।
তাছাড়া শিল্পক্ষেত্রেও অ্যাসিড ব্যাটারির রিসাইকেল হচ্ছে। "সঠিক ও নিরাপদ সীসা ব্যবস্থাপনা" বলে আমাদের দেশে কোন কথা নেই। এইসব ব্যাটারি নষ্ট হয়ে গেলে সেগুলো ফেলে দেওয়া হয় যত্রতত্র। সেই সীসা মিশে যায় বাতাসে, মাটিতে ও প্রকৃতিতে।
আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যে শতকরা প্রায় শতভাগ মানুষ জানেনা সীসা দূষণের উৎসগুলো কী কী এবং উৎস থেকে দূষণ কিভাবে দ্রুত ছড়াচ্ছে। অবশ্য আমাদের দোষও নেই, বিভিন্ন সময় বিজ্ঞান গবেষক, চিকিৎসক, গণমাধ্যম এই দূষণ নিয়ে কথা বললেও কোন ক্যাম্পেইন চলেনি। আর্সেনিক, এইডস এইসব নিয়ে যে প্রচার-প্রচারণা চলেছে, এর এক অংশও চলেনি সীসার ব্যবহার নিয়ে। নেই সেইভাবে কোন গবেষণা। তাই সাম্প্রতিক এই গবেষণা এবং শতভাগ শিশুর সীসা আক্রান্ত হওয়ার খবর আমাদের অস্থির করে তুলছে।
বেসরকরি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন প্রায় ২০ বছর ধরে কাজ করেছে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিয়ে। কাজ করতে গিয়ে দেখেছে শ্রমজীবি শিশুদের একটা বড় অংশ কাজ করে ব্যবহৃত সীসা অ্যাসিড ব্যাটারি রিসাইক্লিং এর গ্যারেজে। গ্যারেজের অন্যান্য কাজও খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এই রিসাইক্লিং খাতে এক চতুর্থাংশই শিশুশ্রমিক। এরাই দু'মুঠো খাবারের জন্য কাজ করে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশায়, হিউম্যান হলারে। এক্ষেত্রেও আইন আছে, আবার আইন অমান্য করার উদাহরণও প্রচুর।
দেশে যে রং ব্যবহৃত হচ্ছে, সেই রঙেও মাত্রাছাড়া সীসার ব্যবহার নিষিদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে দেশে যে পরিমাণ রং বিক্রি হয়, এর ৩০ শতাংশের ভেতর নির্ধারিত মানদন্ডের চেয়ে বেশি সীসা পাওয়া যায়। এই রঙ করার কাজেও শিশুসহ অনেক মানুষ জড়িত। রং ফেলা হয় যেখানে সেখানে, বিশেষ করে পানিতে।
ইউনিসেফসহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, মানুষ সাধারণত পেশাগত ও পরিবেশগত কারণে সিসা দূষণের শিকার হয়। বহু দশক থেকে সিসাযুক্ত ফসিল জ্বালানি ব্যবহার, সিসা মেশানো রং আর পানির পাইপে সিসার অস্তিত্ব আজকের এ দুরবস্থার কারণ। এর সঙ্গে আছে জনস্বাস্থ্য প্রশাসনের দৃষ্টি এড়িয়ে অননুমোদিত স্থানে কোনো রকম সুরক্ষা কিংবা সতর্কতা ছাড়াই মোটরগাড়িতে ব্যবহৃত পুরোনো সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারি রিসাইকেলিং করা এবং সে কারণে সিসা গলানো হয়। ফলে আশপাশের পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হয়। (প্রথম আলো)
জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ২০১৮ সালে করা গবেষণায় দেখা গেছে কলকাতার বাতাসের মাত্রাতিরিক্ত সীসায় দূষিত হচ্ছে রাস্তার পাশের এবং রেষ্টুরেন্টের সব খাবার, খোলা বাজারের চাল, ডাল, মশলা, কাঁচা সবজি, মাছ, মাংস, কাঁচা সবজি, আঁশ ছাড়া মাছ, গুঁড়ো মশলা, বিস্কুট সবটাই। ধুলা, মাটি, পানি, জলাশয়ে ব্যাটারি শিল্পের সীসা মিশছে। শুধু বাইরের খাবার নয়, ঘরের খাবারেও সীসা ঢুকে যাচ্ছে বিভিন্নভাবে।
তাহলে শিশুকে বাঁচানোর উপায় কী হতে পারে? সরকার কি বিষয়টি নিয়ে জোরালো কিছু ভাববেন? শুধু আইন করে ছেড়ে দিলে কি হবে? জনসাধারণকে সচেতন করতে হবে, ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নই সব নয়। রাজনীতি, অর্থনীতি, যোগাযোগ, উন্নয়ন, শিক্ষা সবই ব্যর্থ হয়ে যাবে, যদি দেশের শিশুরা সুস্থ না থাকে। ধনীদের ধনও মূল্যহীন হয়ে যাবে, যদি সন্তানের মেধা ও শরীরের বৃদ্ধি দুইই অপূর্ণাঙ্গ থেকে যায়।
লেখক মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর