উপমহাদেশের প্রতিটি দেশের রাষ্ট্রনায়কদেরকে আততায়ীর বুলেট কেন খুঁজে ফেরে?
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2022/11/05/monwarul_huq_1.jpg)
অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। বৃহস্পতিবার পাঞ্জাবের এক জনসভায় তিনি আততায়ীর গুলিবর্ষণের শিকার হন। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ইমরান খানের সরকার সংসদে আস্থা ভোটের মুখোমুখি হলে ইমরান শাসনের অবসান হয়। যে কোয়ালিশনের উপর ইমরানের দল ও সরকার টিকে ছিল সেই শরিকরা সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে ইমরান পদত্যাগে বাধ্য হন।
পাকিস্তানের মুসলিম লীগের দুর্নীতি ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ইমরানের নেতৃত্বে দীর্ঘ আন্দোলনের ফল হিসেবে এই কোয়ালিশন সরকার গঠন হয় এবং ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হন। গত এপ্রিলে দেখা গেল সেই শরিকরা ইমরানকে হটিয়ে সেই মুসলিম লীগকেই ক্ষমতায় বসালো। ইমরানের এই ক্ষমতাচ্যুতির পিছনে বিশ্ব রাজনীতির একটি প্রবল ভূমিকা আছে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে ইমরান প্রথম থেকেই নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে।
ইমরান খানের নিজের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) ক্ষমতা হারানোর পর থেকেই বিভিন্ন প্রশ্নে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। পিটিআই একটি লংমার্চ পরিচালনা করছে যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইমরান খান নিজে। কেবল পাকিস্তানে নয়, এই উপমহাদেশের প্রতিটির দেশের রাষ্ট্রনায়কদেরকে আততায়ীর বুলেট কেন খুঁজে ফেরে? কেনই বা একের পর এক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়?
পারস্পরিক প্রচন্ড বৈরিতার মধ্য দিয়ে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও পরস্পরের মধ্যে সাযুজ্য অনেক। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর সার্বভৌম ও ধর্মনিরপেক্ষ যে রাষ্ট্র জন্ম নেয় এবং সেই রাষ্ট্রের জন্মের পিছনে সবচেয়ে যার বেশি ভূমিকা ছিল তিনি হচ্ছেন মহাত্মা গান্ধী। সেই মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করা হয়েছিল স্বাধীন ভারত প্রতিষ্ঠার এক বছরের মাথায়। হিন্দুত্ববাদী নাথুরাম ঘটিয়েছিল সেই হত্যাকাণ্ড। সময়কাল ১৯৪৮।
ভারতীয় উপমহাদেশের সদ্য প্রতিষ্ঠিত অপর রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান একটি রাজনৈতিক জনসভায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। ১৯৫১ সালের ১৬ই অক্টোবর। সেই একই ধারা চলছে অদ্যাবধি।
ভারতের রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে হত্যার শিকার হন ইন্দিরা গান্ধী ও তার তনয় রাজীব গান্ধী। পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রনায়ক জুলফিকার আলী ভুট্টোকে কারাগারে ফাঁসি দেওয়া হয়। জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বেই পাকিস্তানের সংবিধান রচিত হয়েছিল ১৯৭৩ সনে। এরপরে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসীন হয়েছিলেন জিয়াউল হক, ১৯৭৮ সালে। কথিত আছে পরিকল্পিত বিমান দুর্ঘটনার মাধ্যমে ১৯৮৮ সালে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে ভুট্টো তনয়া বেনজির রাওয়ালপিন্ডিতে এক মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। তখনো ক্ষমতায় ছিল পাকিস্তানের আরেক জেনারেল পারভেজ মোশারফ। আততায়ীর গুলিবর্ষণে বেনজির ভুট্টোর সাথে আরও একাধিক মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের জন্মের পরেও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড অব্যাহত থাকে। বাংলাদেশেও শুরু থেকেই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছিল। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার এই হত্যার শিকার হন। ঐ একই বছর জেলখানার অভ্যন্তরে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রীসভার আরও দুইমন্ত্রী। এরপর নিহত হন রাষ্ট্রপতির পদে থাকা জিয়াউর রহমান।
রাজনৈতিক হত্যা এবং হত্যা প্রচেষ্টা এই উপমহাদেশে থেমে নেই। বাংলাদেশের আজকের প্রধানমন্ত্রীকেও ২০০৪ সালে এক সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে লক্ষ্য করে উপর্যুপরি গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। আজকের প্রধানমন্ত্রী, তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও ২৫ জন নিহত হন ঐ হামলায়। কয়েকশত মানুষ আহত হয়েছিলেন।
বারবার কেন ঘটে এমনটি?
এমনটি ঘটার পিছনে অনেক কারণ থাকতে পারে, তবে বড় কারণটি হলো, এই তিনটি দেশের দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। দুর্বল গণতন্ত্রের জন্য এই ধরনের হত্যাকাণ্ডগুলো সংগঠিত হয়। ইতিহাসের পাতায় বহু দেশে এই ধরনের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড আমরা দেখতে পাই। সামাজিক ঐকমত ছাড়া এই অভিশাপ থেকে বেরিয়ে আসার পথ নেই। রাজনীতিতে ঘৃণা ও বিদ্বেষ যত অনুশীলন হবে, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের আশঙ্কা রাজনীতিতে তত বৃদ্ধি পাবে, এটিই স্বাভাবিক।
যদিও পৃথিবীর কোন সমাজে হত্যাকাণ্ডের প্রকাশ্য কোনো সমর্থক নেই।
ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ডের পরে প্রায় তিন হাজার শিখ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে। ১৯৭৫ সনে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে কিংবা ১৯৮১ সনের জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পরে দেশের অভ্যন্তরে কোন প্রতিহিংসা দেখা যায়নি। কিন্তু ক্রমান্বয়ে রাজনীতি এখন একটি জটিল পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হয়েছে। পত্রিকা খুললেই হিংসা- প্রতিহিংসার ভাষা দেখতে পাই আমরা। গত মাস দুয়েক যাবত প্রধান বিরোধীদল ও সরকারি দলের ভাষা, পারস্পরিক ঘৃণা, বিদ্বেষ সাধারণকে আতংকিত করে তুলছে। সামাজিক বিভেদ ক্রমান্বয়ে প্রকট হচ্ছে।
আমাদের আশেপাশের দেশগুলোর প্রায় সর্বত্রই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার সংগ্রাম চলমান। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা দ্রুতই জনগণের 'শাসকে' পরিণত হয়। জনগণের দাবি ও অধিকারকে উপেক্ষা করা, বিরোধী দলগুলোকে নির্মূলের নিমিত্তে এমন অবস্থা করা হয় যেন তারা আর কখনো ক্ষমতায় আসার দৌড়ে অংশ নিতে না পারে।
ক্ষমতাসীনরা জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে ভয় পেতে শুরু করে। সেকারণে তারা প্রথম চেষ্টা করে মানুষের ঐক্যের জায়গাটি ধ্বংস করতে। একাজের সবচেয়ে ধারালো অস্ত্রটি হলো ধর্ম। এই ধর্মকে দিয়েই সামাজিক বিভাজনের কাজটি সম্পন্ন করা হয়। যে কারণে এই অঞ্চলের বিরোধী দলগুলোর জন্য নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখে সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামটি সবসময়ই ওঠে।
পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা দেখা গেল। ইমরান খান ও তার দলের টিকে থাকাকেও ক্ষমতাসীনরা কঠিন করে তুলেছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও সামরিক গোয়েন্দা ইমরানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছে। ইমরান লড়াকু মানুষ তিনি চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেছেন।
পাকিস্তানের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও আশু নির্বাচনের দাবিতে পাকিস্তানের লাহোর থেকে ইসলামাবাদ অভিমুখে লং মার্চের ডাক দিয়েছে পিটিআই ও সমমনা কয়েকটি দল। ৭০ বছর বয়সী ইমরান এই লংমার্চের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এই মিছিলেই আততায়ী তাকে হত্যার চেষ্টা চালায়।
আমাদের পাশের দেশ ভারতের অবস্থাও অনুরূপ। ধর্মীয় বিভাজনে দেশটি জর্জরিত। সেখানকার গণতন্ত্রকামী মানুষ ও রাজনৈতিক দলসমূহ এক কঠিন সময় পার করছে। আমাদের দেশের অবস্থাও একই রকম। বিরোধীরা প্রতিনিয়ত সরকারকে 'টেনে হিঁচড়ে' ক্ষমতা থেকে নামানোর হুমকি দিচ্ছে। অন্যদিকে সরকারও বৈধ-অবৈধ সকল উপায়ে বিরোধী কণ্ঠ বন্ধ করার চেষ্টা করছে। গতকালকের পত্রিকার প্রধান শিরোনাম হচ্ছে, বিরোধীদের চলমান আন্দোলন না থামালে তাদের নেতাকে (নেত্রী) আবার জেলে যেতে হবে। বিরোধী দলের নেতাকে শর্তসাপেক্ষে মুক্ত করে দিয়ে সরকার যে সামাজিক সহনশীলতা সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি করেছিল সেটা আবার বিনষ্ট হওয়ার পথে। এই সহনশীলতার হাত ধরে যদি সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় তাহলেই কেবল সম্ভাব্য সংকট ও ধেয়ে আসা মন্দা মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। আসন্ন মন্দার প্রভাব নিয়ে যখন নানান তথ্য সামনে আসছে সংকট যখন অতি গভীর তখনো কেন সর্বস্তরের নেতা-নেত্রীদের কাছ থেকে এই আক্রমণাত্মক বক্তব্য আমরা দেখছি।