‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’: বিপন্ন মানুষের গল্প
অহরহ মিথ্যা উদযাপন করবার একটি সময়ে আমরা কি বাস করছি না? অথবা ক্রমাগত অস্বীকারের এক প্রবল শৈত্য আমাদের কি আঁকড়ে ধরছে না? অনেক সময় মিথ্যে এবং অস্বীকারের মধ্য দিয়ে- আমাদের মধ্যবিত্ত মন কি বিন্দুমাত্র স্বস্তি পেতে চায় না? – এই সকল প্রশ্ন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারে কোনো কোনো বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র।
তেমন চলচ্চিত্রের অত্যন্ত অল্পকিছু নামের তালিকায় একটি নতুন সংযোজন– মুহাম্মদ কাইউম পরিচালিত 'কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া'। এমন এক চলচ্চিত্র, যাতে কাহিনী আর তথ্য উল-বোনার ধরনে মিশে গেছে। এখানে প্রযুক্তি এমন জায়গায় গিয়েছে- কোনো পরিচালক চাইলেই একটি নয়নসুখকর ছবি নির্মাণ করতে পারেন। কিন্তু, এই পরিচালকের শুধুমাত্র দৃষ্টির বা শিল্পের নন্দনে বিশ্বাস নেই। তার মূল লক্ষ্য, একটি জনপদের মানুষ ও তার জীবনযাপনের প্রকৃত সত্য ধারণ করা। এমন এক জনপদ যেখানে জল থই থই করে এবং মানুষকে বিপন্নতার চোরাবালিতে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে পারে। যতদূর চোখ যায়- ততদূর বিস্তীর্ণ জল।
ছবির শুরুতেই দেখি দূরের অঞ্চল– নেত্রকোনা থেকে জীবনধারণের পথ অনুসন্ধানের নিমিত্তে হাওর অঞ্চলে কাজের সন্ধানে এসেছে মাতৃহারা, উশকোখুশকো চুলের সুলতান। সুলতান-প্রকৃত এই সুলতান; যদিও চলচ্চিত্রের মূল নায়ক এখানে বিশদ দৃষ্টিঅধ্যুষিত হাওর অঞ্চল– তবুও সুলতানকে দিয়েই এই স্থানচ্যুতির ইতিহাসের শুরু।
মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই আমরা ক্রমাগত আমাদের জন্ম এলাকা থেকে সরে সরে যাই যোজন যোজন দূরে। একটি পরিবারে সুলতানের আশ্রয়। সেই পরিবারে অন্তরে ও বাইরে প্রবল ভাঙচুর। কোনমতে মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িঘর। হাওরে মাছ ধরতে গিয়ে মরে যাওয়া ছেলের বউ আর বাচ্চাদের নিয়ে এক প্রজ্ঞাবান দার্শনিক বৃদ্ধ- এই ক'জনের সংসার। এখানে দূরের পাহাড় থেকে ঢল নেমে প্রকৃতি তাদের কোনোমতে নাক ভাসিয়ে বেঁচে থাকাটুকুও বিপন্ন করে।
আছে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ, যথা- ঋণের দুষ্ট চক্র, ইজারাদার। এমনই সে ঋণ, চাষের গরু ও ঘরের চাল বিলুপ্ত হয়ে যায় আর ইজারাদার আরো এক খাঁটি সরেস, ফসল ঘরে তোলার আগেই যদি ধানের জমি হয়ে পড়ে সমুদ্রপ্রতিম; তবে এমনকি মাছ ধরেও কোনোমতে বেঁচে থাকার অধিকার নেই তাদের। কেন না সেসব ইজারাদারদের দখলে।
ছোট্ট মেয়ে রুকুর দাদা তাই এক চিরসত্য উচ্চারণ করে- আকাশের কোনো সীমানা নেই, মানুষ কেবল জমির সীমানা দিতে চায়! একটি জনপদের লৌকিক বিশ্বাস, সংস্কার- এখানে বহুরঙা ছবির মত উজ্জ্বল। যেমন- ধানের শীষ যখন পুষ্ট হয়ে আসে, তখন তেলসুন্দি পুজো যাতে পরমা দেবী শস্যভাণ্ডার দেখেশুনে রাখেন। আছে মন্ত্র বিশ্বাসী সন্ন্যাসী, মন্ত্র পড়তে পড়তে সে আল ধরে হেঁটে যায়, ফসল ভালো হলে কিছু অর্থের প্রতিশ্রুতিতে।
চলচ্চিত্রটির একটি বিশেষ সৌন্দর্য হচ্ছে, জীবনের সত্য দেখাতে গিয়ে কখনো কখনো শিল্পের সত্য থেকে বিচ্যুত হতে চলচ্চিত্রটি দ্বিধায় ভোগেন। মধ্যবিত্তের প্রথাগত রুচি যেমন চটুল রসিকতা, হালকা হাসিতে চলচ্চিত্রটিতে কোন সত্য আবৃত হয়নি। মাজাহারুল রাজুর ক্যামেরা দেখেছে- কাদামাটির মানুষ, মানুষের কাদামাটি আর ঋতুর নানান সময়ে জলের চরিত্র।
মাত্রই দুটি গান আছে। এবং দুটিই নতুন করে লিখিয়ে নেয়া গান নয়। হেমাঙ্গ বিশ্বাস আর রাধারমণের গান। দর্শক আকৃষ্ট করবার সুরবিকৃতির লোভ পরিচালককে ( এবং প্রযোজক-ও বটে) পেয়ে বসেনি। এই প্রসঙ্গে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের তরফে বলা হয়েছে - 'কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া- চলচ্চিত্রে সাধক লোককবি রাধারমণ দত্ত বিরচিত একটি অল্প শ্রুত ধামাইল গান ব্যবহৃত হয়েছে বিয়ের সিকোয়েন্সে। এই গান সংযোজনের মাধ্যমে বাংলা লোকসংগীতের পুরোধা এবং ধামাইল গানের স্রষ্টা রাধারমণ দত্তের প্রতি আমরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেছি।' এবং তারপর ধামাইল গান সম্পর্কে আমাদের জানাচ্ছেন-
বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহের হাওর জনপদে ধামাইল গান ও নাচ মূলত বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে, ধর্মীয় উৎসবে, জন্ম ও বিবাহ অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়। মহিলারা সামনে পিছনে-এগিয়ে অথবা বৃত্তের মতো ঘুরে ঘুরে হাততালি সহযোগে পরিবেশন করেন। সংগীতের লয় রক্ষা করা হয়- হাততালি বা 'থাপড়ি' দিয়ে আর নাচের গতি ও তাল রক্ষা করা হয়- ডান ও বাঁ পায়ের আগু-পিছু মুদ্রায়। ধীর লয়ে শুরু হলেও- ধীরে ধীরে গতি বৃদ্ধি পেয়ে, ক্রমান্বয়ে অতিদ্রুত লয়ে এর সমাপ্তি ঘটে'।
শেকড়ের সংস্কৃতি থেকে অনেকটাই দূরে সরে যাওয়া- নতুন প্রজন্মের কাছে 'কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া' আশীর্বাদ হয়ে এসেছে বলে মনে করি। এই চলচ্চিত্র সত্যিকার অর্থে– এক স্বাধীন নির্মাতার নির্মাণ– কেন না পরিচালক সচেতনভাবে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, সরকারি অনুদানের দ্বারস্থ হননি। এই সাহসও বিরল নয়কি? অতিশয়োক্তির ঝুঁকি নিয়েই বলতে চাই, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ভূরাজনীতি কোনোদিন আমাদের হাওর অঞ্চলকে ধ্বংস করে দিলে– এই চলচ্চিত্র দেখে আমরা আবার সেটি গড়ে নিতে পারব।