‘মাতারি’ আর ‘উদলা’ ছাড়া বরিশালের ভাষায় মজাদার আর কি কোন শব্দ ছিল না?
একটি পাবলিক অনুষ্ঠানে বরিশালের ভাষায় মজা করার জন্য "এই মাতারি তুমি এমন উদলা হইয়া দাঁড়ায়ে আছো কিললাইগা?" এই কথাটা অভিনেতা মীর সাব্বিরের মাথায় বা মনে এলো কেন? এই বাক্যটি ছাড়া কি বরিশালের ভাষায় আর কোন মজাদার শব্দ নাই? নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সাব্বিরের মনে 'মাতারি' এই 'উদলা' ব্যাপারটাই নাড়া দিয়েছে। কারণ তার সামনে উপস্থাপিকা যে আধুনিক পোশাকে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তা তার কাছে 'উদলা'ই লেগেছে এবং এটা তার মানসিকতার প্রতিফলন বলে ধরে নেওয়া যায়। নয়তো উনি মজা করে আঞ্চলিক ভাষায় অন্য কিছু বলতেন, এই অভব্য বাক্য বলতেন না।
যদিও মীর সাব্বির বলছেন, 'এটি শ্রেফ বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা। তাৎক্ষণিক এবং এর পেছনে কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। এটি আপত্তিকর শব্দও নয়। বুলিং ভারি শব্দ। আমি তা করিনি।' সাব্বির সাহেবকে বলতে চাই বুলিং কোন ভারি শব্দ নয়, খুব ছোট ছোট কথা ও আচরণ দিয়েও মানুষকে বুলি করা যায়। উনি বুলি করেছেন বলেই আজকে মানুষ উপস্থাপিকাকে উদ্দেশ্য উল্টাপাল্টা মন্তব্য করেই যাচ্ছেন।
সাব্বির বলেছেন, 'আমি কোনো অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করিনি। উদলা মানে উলঙ্গ নয়, শব্দটা আঞ্চলিক শব্দ, এটার অর্থ আকর্ষণীয়। মানে তাকে বলেছি তুমি আকর্ষণীয়ভাবে দাঁড়িয়ে আছো। আমার মনে হয় সে ভুল বুঝেছে অথবা তাকে ভুল বোঝানো হয়েছে। আমি মনে করি এটা কোনো আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারে না।"
কিন্তু আমরা জানি যে 'উদলা' মানে উলঙ্গ বা নগ্ন বা খালি গা, বরিশালেও সেই মানে বোঝায়। 'মাতারি' শব্দটাও সাধারণত মন্দভাবেই ব্যবহৃত হয় এই সমাজে। সবচেয়ে বড় কথা, যোগাযোগ বিদ্যা অনুযায়ী, কোন কথার মানে অর্থাৎ অর্থ রিসিভারের কাছে, সোর্স বা বক্তার কাছে নয়। শ্রোতা যেভাবে কথাটা গ্রহণ করবেন, সেটাই কথার মানে দাঁড়াবে।
সেই ফর্মুলা অনুযায়ী মীর সাব্বির যতোই নিরাপরাধভাবে এই মাতারি ও উদলা শব্দ দুটি বলতে চেয়েছেন, পাবলিক কিন্তু সেভাবে গ্রহণ করেননি। যেমন অনেকেই শব্দ দুটিকে আপত্তিকর বলে মনে করেছেন এবং ভেবেছেন সাব্বির ইচ্ছাকৃতভাবে উপস্থাপিকাকে অপমান করেছেন।
আর অধিকাংশ মানুষ ভেবেছেন সাব্বির যা বলেছেন, ঠিকই বলেছেন। কারণ ঐ মেয়ে একপ্রকার নগ্নই ছিল। কাজেই কোনভাবেই সাব্বির সাহেবের যুক্তি ধোপে টিকে না। এই নিউজের নিচে পাঠকদের সিংহভাগ যা নয়, তাই বলে উপস্থাপিকাকে নিন্দা-মন্দ করছেন। তারা বলছেন মেয়েটি বেহায়া বলেই সাব্বির এইসব বলেছেন। উপস্থাপিকার উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে, তাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া উচিৎ ইত্যাদি ইত্যাদি।
অনেকেই বলছেন, উপস্থাপিকা এরকম একটি পোশাক পরে এসেছেন বলেই সাব্বির এই কথা বলেছেন। তারা একবারও ভেবে দেখছেন না যে, অনুষ্ঠানটা কী উপলক্ষে ছিল, সাব্বির সেখানে কী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানটি ছিল বিবাহিত নারীদের নিয়ে আয়োজিত বিউটি কনটেস্ট 'মিসেস ইউনিভার্স বাংলাদেশ'-এর গ্র্যান্ড ফিনালের মঞ্চ। এখানে উপস্থাপিকা ছিলেন ইশরাত পায়েল ও বিচারক মীর সাব্বির।
এইসব জমকালো অনুষ্ঠানে প্রতিযোগী, অতিথি ও উপস্থাপক বা উপস্থাপিকারা সবাই আধুনিক পোশাক পরে থাকেন। এইসব পোশাককে কেউ কেউ অশ্লীল মনে করলেও, আদতে সেটা অশ্লীল হয়ে যায়না। যে অনুষ্ঠানের যেরকম ভাব, মানুষ সাধারণত সেভাবেই পোশাক নির্ধারণ করে। মিলাদ, ওয়াজ মহফিল, বিয়ে বাড়ি, মৃত্যু বাড়ি, জন্মদিন বা অন্য কোন পার্টিও ড্রেস কখনোই একরকম হবেনা।
সেই হিসেবে উপস্থাপিকার পোশাককে কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত করার দরকার ছিল না। তাও আবার কে করলেন? করলেন সেই অনুষ্ঠানেরই একজন বিচারক। বিচারক মহাদয়ের চোখে বা মগজে যদি এই পোশাককে উদলা মনে হয়, তাহলে উনি সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিচারক না হয়ে ধর্মীয় কোন অনুষ্ঠানের বিচারকমণ্ডলীর আসন অলংকৃত করতে পারতেন।
অবশ্য উপস্থাপিকা নিজেও মে সাব্বির এর মন্তব্য শুনে প্রথমে হেসে গড়িয়ে পড়েছিলেন। দর্শকরাও সেটাই করেছেন। প্রথমে কারো কাছেই এই বাক্যটিকে অশালীন মনে হয়নি। পরে উপস্থাপিকা অনলাইনে এসে এই কথার বিরোধিতা করেছেন। কোন ঘটনা ঘটার পর অনেকেই প্রথমে তব্দা লেগে যায় এবং বুঝতেই পারেন না যে কী কথা উনি শুনলেন এবং এর জবাবে তাকে কী বলতে হবে। যাক তাও যে শেষপর্যন্ত উনি বুঝতে পেরেছেন উক্তিটি অসম্মানজনক ছিল।
আচ্ছা যদি কোন নারীকে আঞ্চলিক ভাষায় একটি সংলাপ বলতে অনুরোধ করা হতো, তাহলে কি উনিও এই জাতীয় কোন উক্তি করতেন? শুধু নারীর কথা বলছি কেন, একজন পুরুষ, যিনি নারীকে সম্মান করেন, তিনিও নারীর পোশাককে কটাক্ষ করে কোন সংলাপ আওরাতেন না আমি নিশ্চিত।
এদিকে উপস্থাপিকা ইশরাত পায়েল ভাইরাল হওয়ার জন্য মীর সাব্বিরকে পুঁজি করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন অভিনেতা ও উপস্থাপক শাহরিয়ার নাজিম জয়। সহকর্মীকে সমর্থন করতে গিয়ে তিনি শুধু একথা বলেই থামেননি, জয় নিজেও খুব অভব্য মন্তব্য করেছেন। তিনি উপস্থাপিকাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, 'আপনার যদি এতই আলোচনায় আসতে ইচ্ছে হয়, আপনি আমার কাছে আসেন।' এই 'আমার কাছে আসেন' এর মানেটা কী? যথারীতি মানুষ এ মন্তব্যকেও খুব অশ্লীল মানে করছেন।
ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে জয় লিখেছেন, 'ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে মীর সাব্বির যখন বিবাহিত বলেছেন, তখন আপনার মন খুব খারাপ হয়েছে। তাই আপনি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মীর সাব্বির সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলছেন।' বুঝতেই পারলাম না এখানে সাব্বির বিবাহিত হওয়ার ও সেটা শুনে উপস্থাপিকার মন খারাপ হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে আনলেন কেন জয়? এটা কি কোন নাটকের মঞ্চ? নাকি ব্যক্তিগত মান অভিমানের ব্যাপার? এটা এমন একটা অনুষ্ঠানের মঞ্চ, যেখানে সাব্বির বিচারক ও পায়েল উপস্থাপিকা। এখানে কে বিবাহিত, কে অবিবাহিত, কে তালাকপ্রাপ্ত এই আলোচনা অবান্তর।
এইসব খবরের নিচে অসংখ্য মানুষের নোংরা, অসভ্য, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য পড়ে কেবলই মনে হয়েছে সমাজটা অভব্য হয়ে উঠেছে। উপস্থাপিকার পক্ষে আপনারা নাই থাকতে পারেন, কিন্তু তাই বলে, তাকে যাতা বলে অপমান করবেন কেন? বিভিন্ন ধরণের অবদমন এইসব মানুষের মনকে বিষাক্ত করে তুলেছে। সেই বিষ তারা এভাবেই উগরে দিচ্ছে। এইসব অজ্ঞানতার অন্ধকারে বসবাস করা লোকেদের উদ্দেশ্যে কোন যুক্তি দিয়ে লাভ নাই।
নারীকে যারা অপমান ও অপদস্ত করে, এমনকি যৌন হয়রানি করে, তাদের পক্ষে প্রচলিত ধারণা বা কুযুক্তি বা মিথগুলো হচ্ছে- নারীরা সবসময় তাদের প্রতি যৌন হয়রানি ও অন্যান্য হয়রানি করা নিয়ে মিথ্যাচার করে, কারণ তারা আলোচিত হতে চায়। যেমনটি বলা হচ্ছে পায়েলকে। আসলে এটা ভিকটিমকেই দোষী সাব্যস্ত করার একটি হাতিয়ার।
প্রসঙ্গক্রমে গবেষণায় উঠে আসা আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে দেশীয় ভাবধারায় নির্মিত কুরুচিপূর্ণ এবং নিম্নমানের পর্ণ বাংলাদেশিরা বেশি পছন্দ করছেন। আর বাংলাদেশের পর্ণ মুভির কনটেন্টই ঠিক করে দিচ্ছে --- এই সমাজে কে 'ভাল মেয়ে', আর কে 'মন্দ মেয়ে'। এই 'ভালো' বা 'মন্দ' নারীর সাথে সমাজ কী আচরণ করবে সেটাও নির্ধারণ করছে এই পর্ণগ্রাফি। অর্থাৎ পর্ণগ্রাফির জগৎটি সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে একধরনের মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুধু এইটুকুতে থামলেও কথা ছিল। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশে একটা বড় অংশ দেশীয় পর্ণগ্রাফি দেখে শুধু অশ্লীলতা আস্বাদনের জন্য নয়। এর চাইতেও বেশি দেখে নারীকে নিন্দা, নির্যাতন ও অপমান করার জন্য। নারীকে নিপীড়ণের উপায় খুঁজে বের করার এবং নারীর পিঠে 'মন্দ মেয়ের তকমা' লাগানোর জন্য। এ ভয়াবহ তথ্যটি উঠে এসেছে 'বাংলাদেশে ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফির সহজ বিস্তার এবং নারীর প্রতি সহিংসতা' শীর্ষক একটি গবেষণা থেকে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, নারীর প্রতি অবমাননাকর, নারীর অশালীন দেহ প্রদর্শন, যৌন আবেদনময় ও পর্নোগ্রফিক কনটেন্ট বা আধেয় বাড়ছে। প্রচুর সংখ্যক কিশোর, যুবক ও পরিণত পুরুষ নারীর প্রতি অবমাননাকর কনটেন্ট নিয়মিত দেখে থাকে বলে গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ৮১ ভাগ উত্তরদাতা মনে করে।
গবেষণা বলছে, একটি মেয়ে যখন খোলামেলা বা পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক পরে, নিজের পছন্দমতো আচরণ করে, স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও মেলামেশা করে, সেই মেয়েদের নানাভাবে হেয় করা হয় ও তাদের প্রতি অপমানজনক আচরণ করা হয়। অবাক করা তথ্য হচ্ছে, এর পাশাপাশি শতকরা ৬৪ জন মানুষ মনে করে স্বাধীনচেতা নারীর প্রতি কটুক্তি, সমালোচনা, তির্যক মন্তব্য ও অপমানজনক আচরণ করাই যায়।
সবচেয়ে বিপদজনক হলো, এইসব পর্ণে নারীর প্রতি অবমাননাকর যে ইমেজ দেখানো হয়, তা সমাজে প্রচলিত 'মন্দ মেয়ে'র ইমেজকে আরো শক্তিশালী করে। আর তাই অনলাইনে দেখানো সেইসব 'মন্দ মেয়ে'র মতো আচরণ যারা করে, তাদের সেটা থেকে বিরত রাখার জন্য তাকে হেয় করা, মন্দ বলা ও তাদের প্রতি অপমানজনক আচরণ করা সমাজের জন্য উপকারী বলে মনে করেন শতকরা ৪৪ জন উত্তরদাতা।
এই সমাজে এখনো সেক্সিজম হচ্ছে 'মন্দ মেয়েদের' শায়েস্তা করার একটা হাতিয়ার। তাই মীর সাব্বিরের সংলাপের প্রতিবাদ করায় উপস্থাপিকা পায়েলকে এখন যেভাবে হেনস্থা হতে ও বাজে মন্তব্যের শিকার হতে হচ্ছে, তা আমাদের সামনে গবেষণার ফলাফলের সত্যতাই প্রমাণ করছে।
এই যে আমরা বারবার নারী স্বাধীনতার কথা বলি, নারীর পাশে থাকার কথা বলি, নারীকে মর্যাদা দেয়া কথা বলি, এর ফলাফল কী? আমাদের অর্জন কতটুকু? অর্জন হলো এটাই যে, সমাজে নারী বিদ্বেষ বাড়ছে। অধিকাংশ মানুষ এখনো নারীবিদ্বেষী। নারীর প্রতি পক্ষপাতে দেশ পেছনেই হাঁটছে ।
- লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন