গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংস্কার না করলে সংকট কখনই কাটবে না
না, তেমন কিছু ঘটেনি। স্বস্তি মিলেছে, মানুষ হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। সেই রাজা রানির গল্পের মতন। আসছে আসছে! অবশেষে দেখা গেল হাতির পিঠে চড়ে বিড়াল আসলো। গত দুই মাস টান টান উত্তেজনা। দেশের নানা প্রান্তে বক্তৃতা, গণজমায়েত, সমাবেশ, মহাসমাবেশ। সরকার পতনের দিনক্ষণ নির্ধারণ। সরকার পতনের পর দেশ কীভাবে চলবে তাও নির্দিষ্ট করে দেওয়া। ওদিকে সরকার পক্ষের নানা হুঙ্কার, কৌশল, কূটকৌশল সবমিলে পরিস্থিতি এক ভয়াল রূপ ধারণ করে। অবশেষে ১০ তারিখ গোলাপবাগ মাঠে সবকিছুর আপাত পরিসমাপ্তি ঘটে। দেশের মানুষের উদ্বেগ খানিকটা কাটে। কিন্তু সমগ্র ঘটনার মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি স্পষ্ট হলো তাতে নাগরিকের উৎকণ্ঠা আর কাটল না।
বিএনপির জোরালো দাবি, এই নয়াপল্টন পার্টি অফিসের সামনে বহু বছর ধরে নির্ধারিত, অনির্ধারিত অসংখ্য সমাবেশ তারা করছে। পুলিশ অনুমতিও দিয়েছে। তাহলে এবার নয় কেন? পুলিশ অবশ্য 'জনদুর্ভোগ' ও এত কম জায়গায় এত বেশি লোকসমাগমের জন্য 'উপযুক্ত' নয় উল্লেখ করে বিএনপির আবেদন খারিজ করে দেয়। আমরা প্রথমদিকে পুলিশের এই যুক্তির কথা জানলেও পরে ধারণা করা যায় পুলিশের কাছে হয়তো কোনো গোয়েন্দা তথ্য ছিল। অর্থাৎ বিএনপি নয়াপল্টনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচির পরিকল্পনা করেছে, যা শাপলা চত্বরে হেফাজতের অবস্থান কর্মসূচির মতই। সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত তা চলতে থাকবে। পুলিশের এই আগাম ধারণা হালে পানি পায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে ১৬০ বস্তা চাল-ডাল, বোতলজাত পানি ও কথিত বোমা উদ্ধারের কাহিনী প্রচারের পরে। যদিও ১৬০ বস্তা চাল সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা ওই অফিসে ছিল কি না তাও একটি প্রশ্ন।
সমাবেশের অনুমতি নিয়ে জল কম ঘোলা হয়নি। বিএনপি সত্যি যদি লাগাতার অবস্থান কর্মসূচির দিকে যেত তাহলে পুলিশকে বল প্রয়োগ করতে হত। হেফাজতের শাপলা চত্বর কাহিনির পুনরাবৃত্তি সরকার খুব সংগত কারণেই চায়নি। অন্যদিকে প্রায় একযুগ ধরে হামলা, মামলা গ্রেফতারে কোণঠাসা বিএনপি তার বিভাগীয় সমাবেশগুলো করার পর বেশ চাঙ্গা এবং আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছিল।
নেতাদের বক্তৃতা ও হুংকারে মনে হয়েছে ১০ তারিখের সমাবেশে তারা এমন অবস্থার সৃষ্টি করবে যেন সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, তেমন কিছুই ঘটেনি। এখন সর্বত্র জোর আলোচনা, কারা হারল, কারা জিতল। হারজিতের এই আলোচনা হয়তো আরও কিছুদিন চলবে। কিন্তু সুস্থ ও গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির যে পরাজয় ঘটেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সমাবেশকে ঘিরে পুলিশ যে জনদুর্ভোগের দোহাই দিয়েছিল, পুলিশের ব্যবস্থা সেই দুর্ভোগ বিন্দুমাত্র কমাতে পারেনি, বরং বেড়েছে বহুগুণ। কোনো পরিবহন ধর্মঘট ছিল না, কিন্তু তারপরও গাড়ি চলেনি। আমরা হরতাল ধর্মঘট দেখতে অভ্যস্ত। এরকম শুনসান রাস্তা-ঘাট হরতাল, ধর্মঘট দূরে থাক, করোনা লকডাউনের সময় হয়তো দেখেছি। ঢাকায় প্রবেশের সবগুলো পথে তল্লাশি চৌকি স্থাপন করা হয় কয়েকদিন আগে থেকে। ঢাকার সব আবাসিক হোটেল ও রেঁস্তোরাগুলোকে কড়া নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। কেবল ঢাকা নয়, আশেপাশের জেলাগুলোতেও কোনো পরিবহন চলেনি।
গত দুইদিন ধরে যে খবর সকলকে উদ্বিগ্ন করেছে তা হলো, পুলিশের তল্লাশি চৌকিগুলোতে পুলিশের পাশাপাশি সরকার দলীয় ব্যক্তিরা সাধারণ মানুষের মোবাইল ফোন নিয়ে 'চেক' করে দেখেছে তারা বিএনপি করে কি না। ফোনের কললিস্ট এবং ছবি দেখে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে।
মানুষের গোপনীয়তার অধিকার তার মৌলিক মানবাধিকারের অংশ। আদালতের অনুমোদন ছাড়া পুলিশও কোনো ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। আমাদের পুলিশকে মানুষের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার বা উচ্চ আদালতের কোনো নির্দেশনা উপেক্ষা করতে হরহামেশাই দেখা যায়। তার সাথে এবার যুক্ত হলো সরকার দলীয় ব্যক্তিরা।
বিএনপি তার বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে খুব স্পষ্ট করেই জানিয়েছিল ১০ তারিখের সমাবেশের পর সরকার পতনের একদফার আন্দোলন শুরু হবে। যদিও গোলাপবাগের সমাবেশে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি ১০ দফা দাবি উপস্থাপন করেছে, তবে দাবিগুলোর মধ্যে কোনো নতুনত্ব নেই। বিগত দুটি নির্বাচনের আগেও এই একই ধরনের দাবি উল্লেখ করা হয়েছিল।
প্রথম তিনটি দাবি হলো- এই সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রণয়ন ও নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা। এরপর ছিল খালেদা জিয়াসহ রাজনৈতিক সকল বন্দির মুক্তি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সকল নিবর্তনমূলক আইনের বিলোপ করার দাবি। গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানিসহ সেবাখাতের মূল্য বৃদ্ধি বাতিল করা। বিদেশে টাকা পাচার রোধ করে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা। গুম-খুনের বিচার এবং পুলিশ, প্রশাসন ও বিচারবিভাগে সরকারের হস্তক্ষেপ বন্ধ করা। এর একটিও নতুন কোনো দাবি নয়। আসলে এই সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্ববধায়ক সরকার গঠনই প্রধান দাবি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আমাদের দেশে গত তিন দশক ধরে চলা আন্দোলন, সংঘাত, আলাপ আলোচনা, মানুষের জীবনদান কম হয়নি। কিন্তু প্রশ্নটির পরিপূর্ণ মীমাংসা করা হয়নি। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে শুধু দল নিরপেক্ষ তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থার পাশাপাশি রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচন ব্যবস্থার পরিবর্তনও যে জরুরি তা কখনো আলোচনায় আসে না। ফলে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচন ব্যবস্থার কাঙ্খিত উন্নয়ন ব্যতিরেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের যৌক্তিকতার প্রশ্নটি বারবার সামনে আসছে।
প্রধান দুই দলই যখন ক্ষমতায় থাকছেন বা থেকেছেন তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নটি অস্বীকার করছেন বা করেছেন। এই অস্বীকার আমাদের বিভক্ত করেছে। এই বিভক্তি আমাদের বহু জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে দুরে রেখেছে এবং উন্নয়ন অগ্রযাত্রা ব্যাহত করেছে। আসলে এ সমস্ত বিতর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে যদি আমরা রাষ্ট্র কাঠামো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংস্কার না করি তাহলে আমরা কখনোই এই বিতর্কের বাইরে আসতে পারবো না।
দশ তারিখ সমাবেশের পরে রাজনৈতিক সমঝোতার রাস্তা খুলবে বলেই মনে করা হয়েছিল, কিন্তু গত কয়েকদিন যাবত বিএনপির নানান পর্যায়ের নেতাকর্মীদেরকে আবার গ্রেফতার করা শুরু হয়েছে। দেশে গায়েবী মামলা, পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার করার যে পুলিশি প্রক্রিয়া চালু আছে তা কখনোই একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিকাশের সহায়ক নয়। পুলিশের মামলা গ্রহণ, মামলা প্রত্যাহার বা মামলা প্রদান সবকিছুরই একটি জবাবদিহিতা থাকা দরকার। এ সমস্ত কর্মসূচি ঘিরে মাঝে মাঝেই পুলিশের অতি উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়। মধ্যরাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে গ্রেপ্তার দেখানো নতুন কোনো ঘটনা নয়। অথচ আইন অনুসারে বিনা ওয়ারেন্টে কাউকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে না। রিমান্ড হেফাজত নিয়েও ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে বেশ কিছু আইনি সংস্কার করা হয়েছে। সেখানেও সেগুলো অনুসরণ করা হচ্ছে। আমাদের দেশে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতৃত্বকে রিমান্ডে নেওয়া গণতান্ত্রিক সমঝোতার পক্ষে কতটুকু সহায়ক তা অবশ্যই ভাবতে হবে।