‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ ছবির কলকাতা বিজয়!
২৮তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার 'ইনোভেশন ইন মুভিং ইমেজ' ক্যাটাগরিতে আলেহান্দ্রো রোজাসের আপন এন্ট্রি চলচ্চিত্রের সঙ্গে যৌথভাবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশের মুহাম্মদ কাইউম পরিচালিত চলচ্চিত্র কুড়া পক্ষীর শুন্যে উড়া। এ প্রায় এক বিস্ময়কর ঘটনা। কুড়া পক্ষীর শুন্যে উড়া ছবি মেইনস্ট্রিম কোনো ছবি না। সম্পূর্ণ স্বাধীন এক ছবি। আর পরিচালকও প্রায় অখ্যাত। ছবির জগতে তো বটেই।
'অযান্ত্রিক' পত্রিকাটির কথা আপনাদের মনে আছে? শাহবাগের বইয়ের দোকানগুলোতে এক সময় কিছু সংখ্যা এসেছিল। অযান্ত্রিক প্রকাশিত হয় ওপার বাংলার হুগলীর উত্তরপাড়া থেকে। তাঁরা আন্দ্রেই তারকোভস্কি, লুই বুনুয়েল নিয়ে যেমন সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন, তেমনি বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র মেঘে ঢাকা তারা-কে নিয়েও বেশ সমৃদ্ধ সংখ্যা আমাদের উপহার দেন। এতই সমাদৃত হয়েছিল যে বাংলাদেশের নালন্দা (যারা সত্যজিৎ রায় রচনাবলির জন্যে খ্যাত) অনুমতি না নিয়ে এই সংখ্যা বই হিসেবে প্রকাশ করে—কপি পেস্ট করে।
তো, ধান ভানতে এই শিবের গীত গাওয়ার কারণ হলো, পত্রিকাটির সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য প্রায় এক যুগ কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব বর্জন করেছিলেন। বামফ্রন্টের আমলে চলচ্চিত্রের রথী-মহারথীরা আসতেন; গ্রিক মহাত্মা পরিচালক থিওডোরাস অ্যানজেলোপোলুসের মতো মানুষ এসেছিলেন একদা এ উৎসবে। এখনেও উৎসবে বাণিজ্যিক প্রবণতাই বেশি দেখা যায়। সর্বত্র শীর্ষ সরকারি নেতার ছবি, বলিউডের ব্যবসাসফল অভিনেতাদের আগমন, চলচ্চিত্র নির্বাচনে আগের সেই প্রাণ না থাকায় পুরোনো দিনের অনেক চলচ্চিত্র অনুরাগীই আর আসেন না উৎসবে। দীপঙ্কর ভট্টাচার্য এইবার মাত্র দুটি চলচ্চিত্র দেখেছেন। আর তার একটি কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া।
২
কে এই মুহাম্মদ কাইউম? ২০০২ সালে প্রথমবার শাহবাগের বইয়ের দোকানে যাই, আমার মনে আছে। একজন সৌম্যদর্শন সাদা চুলের মানুষ কাউন্টারে বসেছিলেন। একুশে পাবলিকেশন নামের এক বইদোকানে, দোকানের বই নির্বাচন দেখে কচিমন অভিভূত হয়েছিল। তখন চট্টগ্রামে ঐতিহ্যবাহী কারেন্ট বুক সেন্টার থাকলেও এত নির্বাচিত বইয়ের সংগ্রহ ছিল না। কিংবদন্তী 'বইঘর' দোকান ও প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেছে কয়েক বছর আগে। সেদিন মানুষটি অল্প একটু তাকালেন, বয়স কম, বইপত্র নিয়ে ফিরেছি মিরপুর, মামার বাসায়। এটা প্রথম এনকাউন্টার। মনে আছে, একুশে পাবলিকেশনের বুকমার্ক সুদৃশ্য ছিল।
নয় বছর পেরিয়ে গেল। চট্টগ্রামে সাজ সাজ রব। বাংলাদেশের এক শীর্ষ পত্রিকার প্রকাশনা চট্টগ্রামে তাদের আউটলেট খুলবে, বইদোকান। ইন্টারভিউ বোর্ডে তাঁকে আবার দেখলাম। তখন তিনি আমার সরাসরি বস। কিন্তু যাকে বলে 'বসিং' করেন না। ওখানকার আতিপাতি লোকদেরও যেভাবে মিলিটারি জেনারেল ধরনের হম্বিতম্বি দেখতাম, সেই তুলনায় তাঁকে দেখি, বিরল ধরনের চুপচাপ মানুষ। একদিন শুনি তিনি আর থাকবেন না—ছেড়ে দিচ্ছেন প্রতিষ্ঠান।
খুব মন খারাপ হলো। দুপুরের দিকে বলেছিলেন, যদ্দূর মনে পড়ে। আমি অন ডিউটির পিণ্ডি চটকে বেরিয়ে পড়ে অনেক পরে ফিরলাম। পুরো বাঙালি কবির 'তোমার চোখ এতো লাল কেন' কেস। তিনি আমায় শান্ত করে ঢাকায় ফিরলেন। কিছুদিন পর আমারও আর থাকা হলো না। কিন্তু এক অসম বয়সী বন্ধুত্ব হলো। এই সেকেন্ড এনকাউন্টার, মুহাম্মদ কাইউমের সঙ্গে।
রাজনীতি, বই, সিনেমা, জীবন নিয়ে আমার আর তাঁর প্রচুর আড্ডা হতে থাকলো তারপর। কিন্তু সামনাসামনি দেখা হতে পেরিয়ে গেল আরও দশ বছর। ২০১৭ সালের দিকে সিনেমাটার কথা প্রথম শুনি। তখনো নাম ঠিক হয়নি। তাঁর ভ্রমণের একটা অভ্যাস ছিল, ছাত্রবয়স থেকেই। হাওর অঞ্চলে গিয়েছেন একাধিকবার। সেখানে বন্যায় ফসল ধ্বংস হওয়ার ঘটনা তাঁকে রীতিমত তাড়া করতে থাকে। হাওর অঞ্চলের মানুষের শ্রমের ফসল নিশ্চিত নয়, পাহাড়ি ঢলের আসা না আসার ওপর নির্ভরশীল। আমাকে যখন এসব কথা বলতেন, মনে হতো একজন কৃষক বলছেন তাঁর সংবৎসরের খাবার জলের তলায় হারানোর কথা।
প্রায় বিশ-একুশ বছর ধরে মাথায় ঘুরছে তাঁর গল্প। এমন এক অবাণিজ্যিক প্রকল্পের টাকা ঢালার তো কেউ নেই। তাই টাকাটা সংগ্রহে অনেক সময় লেগে গেল। এমন কী এক পর্যায়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের বাসনা থেকে সরে আসেন। এসব পরিকল্পনা তিনি ভাগ করতেন আরেক কিনোখ্যাপা মুহাম্মদ খসরুর সাথে। বাংলাদেশের সৎ চলচ্চিত্র আন্দোলনের পিতৃপ্রতিম এই মানুষ তৎকালীন তরুণ কাইউমকে ব্যাপক উৎসাহ দিতেন। বলে রাখি এই স্মৃতিতে কুড়াপক্ষীর শূন্যে উড়া ছবিটি উৎসর্গ তাঁকেই। বছর কয়েক আগে হাওর অঞ্চলে বিপুল বন্যায় অপরিসীম ক্ষতি হলো ফসলের, জনজীবনের। এবার ষাট ছুঁইছুঁই কাইউম আক্রান্ত হলেন, এই চলচ্চিত্র তাঁকে নির্মাণ করতেই হবে।
এই থেমে যাওয়া, আবার আস্তে আস্তে সব গুছিয়ে আনা; এই নানা রকম পর্যায়গুলোর আমি শ্রোতা। বিনাতারে ভেসে আসে তাঁর বেদনা, চাপা দুঃখ। অতিমারি নেমে এল এক সময়। অল্প কয়েক মিনিটের শুট বাকি। ফাঁকি দিয়ে ছবিটার কাজ শেষ করে ফেলা সম্ভব ছিল। কিন্তু ইহা মুহম্মদ কাইউম। পারফেকশনিস্ট, সেই প্রকাশক যখন ছিলেন তখন থেকেই।
আমরা অনেকেই জানি না, বাংলা ভাষায় কমলকুমার মজুমদার চর্চার প্রথম পূর্ণাঙ্গ বই রফিক কায়সার প্রণীত কমলপুরাণ-এর প্রকাশক মুহাম্মদ কাইউম। তো আমাদের পরিচালক পাঁচ-সাত মিনিটের সিকোয়েন্সের জন্যে অপেক্ষা করলেন গোটা এক বছর, ঐ বিশেষ ঋতুর জন্যে। বড় পরিচালকরা এমন করে থাকেন। যেমন, একজন ভিনদেশী পরিচালকের কথা জানি যিনি জানতেন ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে পতঙ্গেরা ভিন্ন ভিন্ন শব্দ করে। তিনি ঐ নির্দিষ্ট শব্দের জন্যে নির্দিষ্ট ঋতুর অপেক্ষায় থাকতেন। অথচ প্রযুক্তি বলবান! স্টক সাউন্ড আমাদের হাতের নাগালে। কুইজ হচ্ছে, বলতে হবে এই পরিচালক কে?
৩
ছবি তোলা শেষ হল। পোস্ট প্রডাকশন ওপার বাংলায়। অর্ঘ্যকমল মিত্র, সুকান্ত মজুমদার আর সাত্যকি বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মানুষ এই ছবির সাথে যুক্ত। ফেরার সময় কাইউম ভাই নিয়ে এলেন পরিচয়ের 'ফ্যাসীবিরোধী কবিতা সংকলন'। ব্রোশিওরের টেক্সট আমাকে লিখতে বলেছিলেন। তখন আমার নিজের জীবনে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস সব একসাথে। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি নইলে বারান্দায় বসে থাকি চুপচাপ। পারিনি লিখতে।
ছবিটার প্রিমিয়ারের দিনেও পরিচালক জানতেন না, হল পাবেন কী না! আমিও বিশেষভাবে আমন্ত্রিত ছিলাম। বিচ্ছিরি ব্যাকপেইন রাজধানী পর্যন্ত যাত্রার সক্ষমতা দেয়নি। ফলে দেখা হয়নি। আমার শহরে মুক্তি যখন নিশ্চিত হলো আমি সর্বসাধ্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। দু একজন বন্ধু, অনুজকে নিয়ে। যেমন সাদিয়া মেহজাবিন আর আমি পোস্টার লাগালাম শহরে। আমাদের এক অনলাইন পত্রিকা আছে- মাদুর। বন্ধুদের লেখা চেয়ে নিয়ে বিশেষ আয়োজন করলাম। নিজেও লিখলাম একাধিক লেখা, প্রিয় বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অনলাইনেও।
সুগন্ধা আমাদের ঐতিহ্যবাহী হল, পূর্ব নাম ঝুমুর। প্রথম দিন যা কিছু দর্শক হলো। তারপর আর নেই তেমন। কাইউম ভাই এলেন দুদিনের জন্যে। আমার পাওনা আড্ডাটুকুন। একজন পরিচালকের সাথে বসে খুঁটিনাটি জানার সৌভাগ্য তো সবার হয় না।
আমি শুরু থেকেই বলেছিলাম, এই চলচ্চিত্র স্রষ্টাকে অমরত্ব দেওয়ার ছবি। পরিচালক এসব শুনে হেসেই উড়িয়ে দেন। যখন ছবি নিয়ে গেলেন সীমান্তের অন্য দিকে—বলেছিলাম, খালি হাতে ফিরবেন না। একাধিকবার। একটা বিশ্বাস ছিল। শিল্পের প্রতি। শুভবোধের প্রতি।
এখন আমার অনেক আনন্দ হচ্ছে। আমি আমার এই অগ্রজ বন্ধুকে নতজানু অভিবাদন জানাই। পুরস্কার না পেলেও অবশ্যি কিছু যেত আসত না। একটাই সুবিধা হলো, পরের ছবিতে এত প্রতিবন্ধকতা থাকবে না বলেই আশা করা যায়। আমার কাইউম ভাই খানিকটা নিশ্চিন্তে পরের ছবিতে হাত দিতে পারবেন। এবং বাংলাদেশের, আমার শহরের নাক উঁচু দর্শকেরা, এখন অন্তত চলচ্চিত্রটি দেখতে যাবেন।
৪
১৫ ডিসেম্বর কলকাতার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল আট দিনব্যাপী ২৮তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের। আজ পুরস্কার ঘোষণার মধ্যে দিয়ে পর্দা নামল তার।
হাওরের ধানকাটা কৃষক পরিবারের জীবনসংগ্রামের আলেখ্য কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া। বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশে বৈষম্য ও বঞ্চনার মাঝে টিকে থাকা প্রান্তিক মানুষের লড়াইয়ের গল্প এ সিনেমায় বিধৃত হয়েছে হাওরের জল ও কাদায় মিশে থাকা লোকজ ঐতিহ্যের আবহে।
ছবিটিতে অভিনয় করেছেন জয়িতা মহলানবীশ, উজ্জ্বল কবির হিমু, সুমি ইসলাম, সামিয়া আক্তার বৃষ্টি, বাদল শহীদ, মাহমুদ আলম, আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ। বাংলাদেশে গত ৪ নভেম্বর মুক্তি পেয়েছিল এটি।