সরকারের ৯-৬ সুদনীতি এসএমই খাতের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে কি!
পৃথিবীর উন্নত ও উন্নয়নশীলসহ সব দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে সেই দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বা এসএমই খাত—এ কথা সর্বজনগ্রাহ্য। আমরা আমাদের চারপাশে যেসব বড় ব্যবসা দেখি সেগুলো একদিনে বড় হয়নি। তাদের চলা শুরু হয়েছিল মূলত ছোট আকারে। আস্তে আস্তে তারা বড় হয়েছে। কোনো দেশের সার্বিক ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে এসএমই ও এমএসএমই খাতকে অগ্রাহ্য করার কোনো সুযোগ নেই। যারা কম গুরুত্বের সাথে এই খাতকে নেবে তারা মূলত নিজেদের উন্নয়নের পথকে নিজেরাই রুদ্ধ করবে।
আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারতে তাদের মোট আয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ এবং চীনে প্রায় ৭০ শতাংশ আসে এসএমই খাত থেকে। সেই হিসেবে বাংলাদেশে এ শিল্পের অবদান অন্য দেশের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে কম। এই খাত থেকে কত আয় আমরা পাই তার সঠিক তথ্য না জানলেও আমরা বিভিন্ন সূত্র থেকে জানি যে বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শিল্প খাতের অবদান ৩৭.০৭ শতাংশ, যেখানে এসএমই খাতের অবদান প্রায় ২৭-২৮ শতাংশ এবং এ খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে।
বাংলাদেশের সামনে আছে এসডিজি-২০৩০ ও ভিশন ২০৪১-এর সফল বাস্তবায়নের লক্ষ্য। আর এজন্য এমএসএমই খাতের উন্নয়ন নিবিড় মনোযোগ দাবি করে, কারণ অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও টেকসই শিল্পায়নের মূল চাবিকাঠি আমাদের এমএসএমই খাত। সেজন্য বাংলাদেশ সরকার এসএমই খাতকে সুরক্ষা দেয়ার চেষ্টা করেছে যখন করোনার আঘাতে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
আমরা জানি করোনা পরিস্থিতিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত দ্বিতীয় দফায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় এসএমই ফাউন্ডেশনের ঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে এসএমই উদ্যোক্তাদের অনুকূলে ৩০০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল এবং এসএমই খাতের জন্য প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ৪০ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে যাতে এসএমইরা সহজে ঋণ পেতে পারেন, সে লক্ষ্যে গাইডলাইন প্রস্তুতপূর্বক বিতরণ করা হয়েছে।
তাছাড়া দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত সুরক্ষার মাধ্যমে সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার জাতীয় শিল্পনীতি ২০১৬-তে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতকে শিল্প উন্নয়নের প্রধান মাধ্যম হিসাবে ঘোষণা করেছে। দেশের ও বৈশ্বিক বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনা দলিল, যেমন জাতীয় শিল্পনীতি ২০১৬, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, ২০২৬ সাল নাগাদ সফলভাবে এলডিসি থেকে উত্তরণ, এসডিজি ২০৩০ এবং রূপকল্প ২০৪১-এ প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জনে এসএমই খাতের উন্নয়ন সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বিধায় সরকার এ খাতকে গতিশীল করার জন্য বিভিন্ন সময়ে সাযুজ্যপূর্ণ নীতি প্রণয়ন করেছে। বর্তমান এসএমই খাতকে শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে এসএমই নীতিমালা-২০১৯ প্রণয়ন করা হয়েছে। জাতীয় শিল্পনীতি-২০১৬ সংশোধনপূর্বক আরও এসএমইবান্ধব করার লক্ষ্যে শিল্প মন্ত্রণালয় কর্তৃক জাতীয় শিল্পনীতি-২০২২ প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। এসএমই নীতিমালা-২০১৯-এ এসএমই সংশ্লিষ্ট আইন, বিধিবিধান এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম সহজীকরণের মাধ্যমে এসএমই খাতে সবার জন্য সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক গৃহীতব্য কর্মকৌশলগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সরকারের উন্নয়ন রূপকল্পগুলো বাস্তবায়নের
অংশ হিসাবে ২০২৪-এর মধ্যে জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান বিদ্যমান ৩২ শতাংশে উন্নীতকরণ এসএমই নীতিমালা ২০১৯-এর মূল লক্ষ্য।
এতক্ষণের আলোচনায় আমরা গুরুত্বের সাথে লক্ষ করি যে সরকার চায় এসএমই খাতের উন্নয়ন এবং সেজন্য সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের আন্তরিকতা আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল এবং খুব আন্তরিক। কিন্তু ২০২১ সালের এপ্রিলে নেয়া বাংলাদেশ সরকারের ৯/৬ সুদনীতি আপাত দৃষ্টিতে খুব ভাল একটি সিদ্ধান্ত হলেও তা এসএমই খাতের জন্য কতটা ভাল ফল বয়ে নিয়ে আসবে তা বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয় কোনোভাবেই।
এই সুদনীতি প্রধানত তিন ক্ষেত্রে তিন ধরনের প্রভাব ফেলেছে।
এক, যারা ব্যাংকে টাকা জমা রেখে সুদ বা মুনাফা আয়ের উপর নির্ভর করে সংসার চালাতেন তারা বিপদে পড়েছেন। কারণ একদিকে তাদের আয় কমে গেছে কম সুদ হারের জন্য, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতিজনিত কারণে তাদের প্রকৃত আয়ও কমে গেছে। ফলে তাদের জীবনমান অনেক নিচে নেমে গেছে। অনেকে মূল টাকা ভেঙ্গে সংসার চালাচ্ছেন।
দুই, ব্যাঙ্কগুলো বড়, পরিচিত ও পরিক্ষিত গ্রাহককে ঋণ দিতে যতটা স্বস্তি বোধ করে ছোট গ্রাহকদেরকে ঋণ দিতে ততটা স্বস্তি বোধ করে না। তার নানাবিধ কারণ আছে। ব্যাংক যেহেতু অন্যের টাকা নিয়ে ব্যবসা করে, তাই তারা চায় টাকা যেন সহজে ফেরত আসে, আবার ঋণ প্রক্রিয়ায় যেন খরচ কম হয়। ফলে দিনে দিনে বড় গ্রাহকদের হাতে বেশি পুঁজি পুঞ্জীভূত হচ্ছে। এই ঋণ খানিকটা 'সব ডিম এক বাক্সে রাখা'র মতো অবস্থা তৈরি করছে যা অনেক ব্যাংকার হয়তো খেয়াল করছেন না। তাঁরা অন্যের সঞ্চিত পুঁজির নিশ্চয়তা বিধান করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোকে নিজেদের অজান্তেই বেশি ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছেন। আমরা জানি আমাদের দেশে এসএমই খাতের চেয়ে কয়েকশত গুণ বেশি ঋণ অনাদায়ী আছে বড় ঋণগুলোর ক্ষেত্রে। শুধু ৯ শতাংশ সুদহার থাকার কারণে বড় ব্যবসায়ীরা ইজি ঋণ ফাঁদে নিজেদের আটকে ফেলছেন, তা বুঝে হোক বা না বুঝেই হোক। সরকারে যারা এইসব বিষয় বোঝেন, তাদেরকে এবং বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংককে বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে। আমরা কি জানি না, শুধু যদি উপরের ১০ জন গ্রাহক ব্যাংকের টাকা ফেরত না দেয় তাহলে ব্যাংকিং ব্যবস্থা ধসে যাবে!
তিন, ঋণের ৯ শতাংশ সুদহার বেঁধে দেওয়ার কারণে দিনে দিনে এসএমই খাতে ঋণের প্রবাহ কমছে। কারণ এই খাতে ঋণ দিতে ব্যাংকের অনেক বেশি অপারেশনাল খরচ পড়ে, ঝক্কিঝামেলা বেশি হয়, আবার ঋণ আদায় না হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। তাছাড়া অনেক গ্রাহকের জামানত দেয়ার মতো জমিজমা থাকে না। সব মিলিয়ে ব্যাংক তাদের ঋণ দিতে অনাগ্রহী হবে এটাই বাস্তব। বিশেষ করে বর্তমান বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনীতির এই বিপদসংকুল সময়ে কেন ব্যাংক এসএমইকে ঋণ দেবে? ফল: দিনে দিনে অনেক ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান পুঁজির অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনেক মানুষ বেকার হচ্ছে। অনেকেই বেঁচে থাকার তাগিদে পেশা পরিবর্তন করছেন। দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। জিডিপিতে তার অবদান কমছে। এই প্রভাব পড়বে সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে। সরকারের এসডিজি-২০৩০ ও ভিশন ২০৪১-এর সফল বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, যেহেতু এসএমই খাতের বিকাশ আমাদের জিডিপিকে সমৃদ্ধ করবে, নিয়োগ বাড়াবে উল্লেখযোগ্য হারে, তাই এই খাতকে অবহেলা করা—পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ যেভাবেই হোক—কোনোভাবেই ঠিক হবে না। তাদের ঋণে অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন—টাকা তাদের বেশি প্রয়োজন। তাদের যেহেতু লাভ বা মুনাফা বেশি, তাই কম সুদ হার তাদের অতটা প্রয়োজন নয় যতটা প্রয়োজন ব্যবসা পরিচালনার জন্য ঋণ। ঋণ এখন তাদের অধিকার। সরকারের উচ্চপর্যায়কে গভীরভাবে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে এবং সেই অনুযায়ী বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের ব্যবসার মূলধারাকে বাদ দিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কল্যাণকর উন্নয়ন আদৌ সম্ভব নয়।
- সাইফুল হোসেন: কলাম লেখক, অর্থনীতি বিশ্লেষক ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট