জলবায়ু শরণার্থী সম্পর্কিত প্রস্তুতিতে বাংলাদেশ বিশ্বে পথিকৃৎ
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্থানীয় মানুষেরা। বাংলাদেশে জলবায়ু শরণার্থীদেরকে সহায়তা করতে ইতোমধ্যে পাইলট প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। স্ক্রল ডটইন-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে স্থানীয় পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশকে পথিকৃৎ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন ও গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশন-এর সিইও প্যাট্রিক ভার্কুইজেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের বহু অঞ্চল বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। অনেক পরিবার ঘর ও বসবাসের জায়গা হারাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের ধারণা অনুযায়ী, আগামী ২৫ বছরের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বে ২০ কোটিরও বেশি মানুষ নিজ বাড়ি ছেড়ে দেশের মধ্যেই অন্য স্থানে যেতে বাধ্য হবে। এ স্থানান্তর করতে গিয়ে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই উন্নত জীবন ও চাকরির নিশ্চয়তা রয়েছে এমন জায়গার খোঁজ করবেন। তবে এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সমস্যাগুলোর স্থায়ী কোনো সমাধান তৈরি হবে না।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে স্থানান্তর ভবিষ্যতের কোনো সমস্যা নয়। বরং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর স্থানান্তর ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। জাতিসংঘের রিফিউজি এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানের উদ্বাস্তু ও বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর শতকরা ৭০ ভাগই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তীব্র ঝুঁকির মধ্যে থাকা অঞ্চলের। এ অবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত শরণার্থীরা জনবহুল শহরগুলোতে স্থানান্তর হলে সেই ক্রমবর্ধমান চাপ কীভাবে মানিয়ে নেওয়া যাবে সেটিও একটি চিন্তার কারণ।
জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা হলেও এর নেতিবাচক প্রভাব স্থানীয় পর্যায়েই সবচেয়ে বেশি। তাই এ বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানে স্থানীয় পর্যায়েও কাজ করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে স্থানীয় পর্যায়ের ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীদের নিয়ে কাজ করা খুব সহজ নয়। কিন্তু বাংলাদেশ এক্ষেত্রে সফলতার পরিচয় দিচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে জলবায়ুগত পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে যৌক্তিক সমাধান বের করা এবং এর ফলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীদের জন্য তহবিল প্রদানের মাধ্যমে এ কাজ করা হচ্ছে। মূলত মাঝারি আকারের শহরে 'বটম টু টপ' কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট সংকট মোকাবেলায় দ্রুত ইতিবাচক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
জলবায়ু সহনশীল শহর তৈরিতে দ্য গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশন এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ এনজিও ব্র্যাক বাংলাদেশের মংলায় একটি পাইলট প্রোগ্রাম চালু করেছে।
মংলা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর। ইতোমধ্যেই অঞ্চলটির মাটিতে লবণাক্ততার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ব্যবহারযোগ্য পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় দ্য গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশন এবং ব্র্যাক স্থানীয় সরকারের সঙ্গে মিলে স্থানীয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শরণার্থী হওয়া মানুষদের জন্য 'পিপল'স ক্লাইমেট অ্যাডাপটেশন প্ল্যান' গ্রহণ করেছে।
প্ল্যানটি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে পরামর্শ করে আলোচনার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা হবে। একই সঙ্গে মংলায় জলবায়ুর কারণে ক্ষতিগ্রস্থ জনগোষ্ঠীর চাকরি ও সরকারি সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়া হবে।
ইতোমধ্যেই মংলা অঞ্চলটি একটি শিল্পকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এ প্ল্যানের অধীনে ঐ এলাকার লোকজনকে একদিকে আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের জন্য দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। অন্যদিকে বিকল্পভাবে যাতে তারা আয় করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন, সেজন্যও প্রস্তুত করা হবে। এছাড়া মংলা সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে অঞ্চলটিকে পরিবর্তনশীল জলবায়ুর বিবেচনায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সক্ষম সহনশীল একটি শহর হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় স্থানীয় পর্যায়ে গ্রহণ করা প্রকল্পগুলো খুবই কার্যকরী এবং এর ফলে জলবায়ু ও উন্নয়ন সংক্রান্ত কাজে অনিচ্ছাকৃত ফলাফল কমিয়ে আনা যায়।
তবে সমস্যা হচ্ছে, স্থানীয় পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় কাজ করতে গেলে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান কষ্টসাধ্য। যার ফলে গৃহীত প্রজেক্টগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব বেশি সুবিধা করতে পারে না।
এছাড়াও পরিবর্তনশীল জলবায়ু সহনশীল কৃষি ব্যবস্থা তৈরি এবং বন্য ও খরার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর বাড়িঘরের অবকাঠামোগত উন্নয়নের মতো কাজগুলো করতে গেলে স্থানীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সম্যক ধারণা দিতে পারবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার জনগণ।
ইতোমধ্যে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বাংলাদেশের পিপল'স ক্লাইমেট অ্যাডাপটেশন প্ল্যান এ ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের তহবিল দিয়েছে। যদি এ পরিকল্পনার কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়, তবে দেশের আরও দুই ডজেনের মতো শহরে একই উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। যার ফলে বাংলাদেশ ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সম্ভাব্য ১.৩ কোটি উদ্বাস্তু নাগরিকের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারবে।
এ সেকেন্ডারি শহরগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সম্ভাব্য ক্ষতি কমাতে প্রাথমিক প্রতিরক্ষা স্তর হিসেবে কাজ করবে। গৃহীত পরিকল্পনাটি যদি ঠিকঠাক কাজ করে, তবে তা জলবায়ু পরিবর্তনে বিপুল সংখ্যক ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে ঢাকামুখী হওয়া থেকে বিরত রাখবে। এমনিতেই ঢাকায় বর্তমানে প্রায় দুই কোটি ২০ লাখের মতো মানুষ বাস করেন। এরপর যদি ঢাকার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আরও বাড়তি জনসংখ্যার চাপ পড়ে, তাহলে তা রাজধানীটির জন্য খুবই শোচনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।
পরিবর্তনশীল জলবায়ুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে এ সমস্যা সমাধানে কাজ করা পথিকৃৎ দেশ বাংলাদেশ। আর তাই গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশন ঢাকায় এ সংক্রান্ত একটি বৈশ্বিক হাব তৈরি করেছে। এটি যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মধ্যে থাকা বাংলাদেশের লাখ লাখ জনগোষ্ঠীকে সহযোগিতার জন্য কাজ করবে, একই সঙ্গে একটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিবর্তনশীল জলবায়ুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সক্ষম করে তুলবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর বহু জায়গা বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে এবং ঐসব অঞ্চলের জনগোষ্ঠী জলবায়ু সহিষ্ণু এ শহরগুলোতে ভিড়তে থাকবে। প্ল্যাটফর্মটি মূলত তখন ঐসব ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করার পাশাপাশি পরিবর্তনশীল জলবায়ুর বাস্তবতায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোকে আর্থিকভাবে সচ্ছল করার চেষ্টা করবে।