এই ‘পা টেপা সংস্কৃতি’ নিয়া আমরা কী করিব?
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হকের 'পা টেপানোর' ছবিটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর, সেই ছবি প্রসঙ্গে কঠিন মন্তব্য করেছেন আরেক ছাত্রলীগ নেতা। তিনি বলেছেনম "ছাত্রলীগের পদ পেতে এসব করতে হয়।" তার এই মন্তব্য ছাত্র রাজনীতির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কেমন যেন বিবমিষা তৈরি করে। একজন মধ্যবয়স্ক ছাত্রনেতার পা টেপার মতো এই ন্যাক্কারজনক কাজটি ঘুরেফিরে বারবার সাধারণ মানুষের আলোচনায় আসছে। শুধু কি তাই! ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সংগঠনটির নেতা-কর্মীরাই।
একজন ছাত্রনেতা কতদিন তার গদিতে আসীন থাকতে পারেন, এরও নিশ্চয়ই একটি নিয়ম আছে। এর আগে আমরা দেখেছি ছাত্র নেতারা ছাত্রত্ব শেষ করে বিয়ে করে ফেলেছেন, তাও তারা ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল করেই চলেছেন। এসব নিয়ে হাসাহাসি, ঠাট্টা-তামাশা কম হয়নি। কিন্তু রাজনীতি করতে গিয়ে যেহেতু তারা লজ্জাকে বিসর্জন দিয়েছেন, কাজেই তাদের বয়সের কোনো গাছপাথর ছিল না বা বয়সের কোনো হিসাব ছিল না।
কিন্তু সভাপতি রেজাউল সাহেবের ছবিটি সেইসব দিনের ইতিহাসকেও ছাড়িয়ে গেছে। সভাপতি বিছানায় শুয়ে মুঠোফোন দেখছেন, আর তার দুই পাশে বসে পা টিপছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের উপকর্মসূচি ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক ও উপক্রীড়া সম্পাদক। এই পা টেপার ছবি ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে তাদের দুজনের ইজ্জত-সম্মানও যে যথেষ্ট পরিমাণে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
সভাপতি রেজাউল হক, আদু ভাইকেও হার মানিয়ে দিয়ে বহুবছর যাবত নেতা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে আরাম-আয়েশ করছেন। তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী স্কুলেই ভর্তি হননি। তাঁর সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও বয়সের ফারাক অনেক।
রেজাউল হক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হন প্রায় ১৭ বছর আগে, ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে। রেজাউলের অকল্পনীয় এই ক্ষমতার উৎস কোথায়? সাধারণ ছাত্র এবং ছাত্রলীগের বহু নেতার আপত্তি ও অনাস্থা সত্ত্বেও কার মদদে তিনি ১৭ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়ে গেলেন?
রেজাউলের পা টেপার ছবিটি ফেইসবুকে শেয়ার করে যিনি চরম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তার ভবিষ্যত নিয়ে অনেকেই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে অনেকেই মতপ্রকাশ করেছেন যে, এই ছবির মাধ্যমে ছাত্রলীগের রাজনীতির যে দুর্দশা ফুটে উঠেছে, এর দিকে জাতীয় নেতাদের দৃষ্টি ফেরানো উচিত। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ, আওয়ামীলীগের জেনারেল সেক্রেটারি, শিক্ষা মন্ত্রী, বিশ্ববিদ্যালয় ও হল কর্তৃপক্ষের।
২০২১ সালে আওয়ামীলীগ সরকারের টানা এক যুগ পূর্তি হয়েছে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার কিছুদিন পর প্রথম আলো পত্রিকা একটি নিউজ করেছিল, যার হেডলাইন ছিল 'শেখ হাসিনা ছাত্রলীগকে সামলান'। নিউজটি দেখে সেইসময় খুবই বিরক্তি লেগেছিল। একটি দল ক্ষমতায় আসতে না আসতেই এরকম একটি নিউজ করার কী দরকার! পরবর্তীতে ছাত্রলীগের দোর্দন্ড প্রতাপ ও প্রতিপত্তি এবং লাগামছাড়া কর্মকাণ্ড দেখে নিজেই অনুধাবন করেছি, প্রথম আলো ঠিক ছিল, আমার ধারণা ভুল ছিল।
গত ১৪ বছরে ছাত্রলীগের নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। তাদের কর্মীদের হাতে খুন ও নির্যাতনের অনেক ঘটনা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বার বার সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। যারা এরকম ঘটনার শিকার হয়েছেন তাদের মধ্যে সাধারণ শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ এবং নিজের দলের অনেক নেতা-কর্মীও রয়েছেন।
সুখের বিষয় 'পা টেপার' ছবিটি নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতারাও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদেরই একজন মুখপাত্র বলেছেন, "পা টেপা দু'জন কমিটিতে পদ পেয়েছেন। অনেক যোগ্য ব্যক্তি পাননি। এতে বোঝা গেল, ছাত্রলীগের পদে আসতে হলে এ ধরনের তেলবাজির কাজ করে আসতে হয়।"
দলের ভেতর থেকে এরকম মন্তব্য শুনে সহজেই বোঝা যাচ্ছে, এত বড় ও প্রাচীন একটি ছাত্র সংগঠন কীভাবে বিব্রতকর অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে এবং এই ঘটনা সংগঠনের ভাবমূর্তিকে কতটা ক্ষুণ্ণ করেছে।
এরকম বা এর চাইতেও বড় অপরাধমূলক কাজের অভিযোগ আসছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। জানিনা সরকার এবং আওয়ামীলীগ কেনো ছাত্রলীগের বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে মুখ বন্ধ করে আছেন, কেনো তাদের নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে একেবারে উদাসীন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ফাও খাওয়া, নিয়োগ-বাণিজ্য, শিক্ষকদের ওপরে চাপ দেওয়ার অভিযোগ আসছেই ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে যে শিক্ষক, কর্মচারী ও ছাত্রলীগের সমন্বয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘবদ্ধ নিয়োগ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেটের হাত ধরেই মেধার পরিবর্তে ঘুষ ও তদবির কাজ করছে।
গত কয়েক মাসের মধ্যে পর পর খবর প্রকাশিত হয়েছে, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগের জন্য ছাত্রলীগ নানা ধরনের চাপ প্রয়োগ, ভাংচুর, তালা দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপর এভাবে প্রতিনিয়ত চাপ সৃষ্টি করার মাধ্যমে বোঝা যায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা চরম অধঃপতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা অংশ দলীয় রাজনীতি ও ক্ষমতার মোহে ছাত্র সংগঠনের আজ্ঞাবহ হয়ে উঠেছেন। শিরদাঁড়া সোজা করে এইসব দুর্বিনীত নেতাকর্মীদের কিছু বলতেও পারেন না। এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদটিও এখন নানাভাবে সমালোচিত হচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, প্রক্টর পদগুলো এখন আর শিক্ষাবিদদের কোনো পদ নয়, বরং দলীয় কর্মীর পদে পরিণত হয়েছে।
এদিকে, পিছিয়ে নেই ছাত্রলীগের নারী সংগঠনের নেত্রীরাও। কিছুদিন আগে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) এর কতিপয় ছাত্রলীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের প্রথম বর্ষের অনাবাসিক ছাত্রী ফুলপরী খাতুনের অভিযোগের ভয়াবহতা আমরা দেখেছি। তিনি বলেছেন, কীভাবে ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তাবাসসুম ইসলাম ও তাদের সহযোগীদের হাতে তিনি নির্যাতিত হয়েছেন। নির্যাতনের একপর্যায়ে তাকে বিবস্ত্র করে ভিডিওধারণ করা হয়। ফুলপরী লিখিত অভিযোগে বলেছেন, "বিবস্ত্র করে ভিডিওধারণের সময় হুমকি দেওয়া হয়। বলা হয়, এই কথা কাউকে জানালে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হবে। সানজিদা, তাবাসসুম আপুরা মারার সময় বলছিল, মুখে মারিস না, গায়ে মার যেন কাউকে দেখাতে না পারে।"
কাজেই ফুলপরীকে শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ও যৌন নির্যাতনও করা করেছে। এর আগেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনা ঘটেছে, পার্থক্য হচ্ছে এবার ফুলপরী মুখ খুলেছেন। এর আগে কেউ ফুলপরীর মতো সাহস করে কথা বলেননি। ফুলপরীকে অনুসরণ করে ইতোমধ্যেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও ৪ জন শিক্ষার্থী তদন্ত কমিটির কাছে নির্যাতনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে ছাত্রছাত্রীরা যদি রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের কোপানলে পড়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি পদলেহনকারীর মতো আচরণ করে, তাহলে সেই কর্তৃপক্ষের কোনো অধিকার নেই ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবক হওয়ার। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য এভাবে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে ওঠেন, তাহলে একদিন এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন যে তাদের টুঁটি চেপে ধরবে না, এ নিশ্চয়তা কে দিতে পারে?
ইবি'র ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ছাত্রলীগ নেত্রীর 'খারাপ আচরণে'র প্রতিবাদ করায় রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজের এক ছাত্রীকে স্টাম্প দিয়ে পেটানোর অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির ছাত্রলীগের এক নেত্রীর বিরুদ্ধে। পেটানোর পর তার চুল ছিঁড়ে ফেলেছে এবং বটি নিয়েও তাকে ধাওয়া করেছে ওই নেত্রী। অভিযুক্ত ওই নেত্রীর নাম নুজহাত ফারিয়া রোকসানা। তিনি ইডেনের ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি। এর আগেও রোকসানার বিরুদ্ধে কলেজের আরেক নেত্রীকে মারধর, সিট দখল ও শিক্ষার্থী নির্যাতনের অভিযোগ এসেছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমেও সংবাদ প্রচার করা হয়েছে।
শুধু এইবারই নয়, আমরা এর আগেও ইডেনের ছাত্রীদের দলীয় কোন্দল, মারামারি, ভাগ-বাটোয়ারার সংবাদ দেখতে পেয়েছি। তবে গত কয়েক বছরে কলেজ ক্যাম্পাস ও ছাত্রীনিবাসে যে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা ছিল ভয়াবহ। গত আগস্টেও নির্যাতনের সময় ২ শিক্ষার্থীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠেছিল সভানেত্রীর বিরুদ্ধে।
'এক পায়ে পাড়া দিমু, আরেক পা টাইনা ছিঁড়ে ফেলবো'- এই কথার অডিও রেকর্ড ফাঁস করার অভিযোগ তুলে ইডেন কলেজের ২ শিক্ষার্থীকে সাড়ে ৬ ঘণ্টা রুমে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে। এইসব অপরাধ হচ্ছে, এই কথা কি কলেজ কর্তৃপক্ষ ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ জানতেন না? যখন জেনেছেন, তখন কি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন?
ছাত্রলীগের বিভিন্ন অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমে সমালোচনা-বিতর্ক হলেও দায়ীদের খুব কম ক্ষেত্রেই বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। আর সেই কারণেই ছাত্রলীগের অনেকেই নিজেদের সকল আইনের ঊর্ধ্বে বলে মনে করেন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সিনিয়র ও সাবেক নেতারাও ছাত্রলীগের বেপরোয়া কাজকর্মে মাঝেমধ্যে বিব্রতবোধ করেন।
তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ সভাপতির পা টেপার এই ঘটনার মাধ্যমে একটি বার্তা আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়েছে যে, তেলবাজি করতে করতে ছাত্রছাত্রীদের কারো কারো নূন্যতম আত্মর্মাদাবোধটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। দলে থাকার জন্য এরা যা খুশি তাই করতে পারেন, অর্থাৎ এরা সবাই হুকুমের দাস। এরাই জাতীয় রাজনীতিতে গিয়ে তেল দেবেন। আর এদের মতো আত্মমর্যাদাহীন মানুষ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করার পরও কারো না কারো 'পা টিপে' দেবেন অথবা 'তেলবাজি' করবেন।
- লেখক: যোগাযোগকর্মী