সুখী মানুষের জামার খোঁজে!
মানুষ সুখী হয় কিসে? সুখের সন্ধানে যুগ যুগান্তর ধরে তপস্যা চলছে মানবজাতির। কেউ কেউ সহজেই খুঁজে পায় কাঙ্ক্ষিত সুখের অনুভূতি আবার কারো কাছে সারাজীবন অলীক হয়েই থেকে যায় সুখ নামের বস্তুটি। টানা ষষ্ঠবারের মতো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় শীর্ষে থাকা ফিনল্যান্ডের দিকে তাকিয়ে মনে পড়লো বিখ্যাত সেই অসুখী রাজার গল্প!
একবার রাজার হলো খুব অসুখ। কী করে সেই অসুখ সারানো যায় তা নিয়ে চিন্তায় গোটা রাজ্য। দূর দূরান্তের সব রাজ্যের নামকরা ডাক্তার, ওঝা, বৈদ্য কেউ বাদ গেলো না রাজার চিকিৎসায়। কিন্তু সেই রোগের মিলছিল না কোনো প্রতিকার । অবশেষে রাজার রোগ মুক্তির উপায় বাতলে দিলেন এক চিকিৎসক। কোনো সুখী মানুষের জামা পরতে পারলেই অসুখ সেরে যাবে তার। রাজ্য জুড়ে তখন খোঁজ পড়লো সুখী মানুষের। কিন্তু প্রকৃত সুখী মানুষ খুঁজে পাওয়া কি এত সহজ! কী করে চেনা যাবে তাকে! রাজার অসুখ দূর করতে সুখী মানুষের জামা খুঁজে আনা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই।
এখন প্রশ্ন জাগে এ সময়ের দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষের দেশ ফিনল্যান্ডবাসীদের কথা।
সুদীর্ঘ শীতকাল, তীব্র ঠান্ডা আবহাওয়া এমনকি বছরের অনেকটা সময় কোনো সূর্যালোক না পাওয়া সত্ত্বেও স্ক্যান্ডিনেভিয় এই দেশটি জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে শীর্ষস্থান দখল করছে বারবার। যেখানে উন্নত বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ১৫তম। তালিকার ১৩৭টি দেশের মধ্যে এবছর বাংলাদেশের অবস্থান ১১৮তম।
জলবায়ুগত বৈরি অবস্থা থাকার পরও ফিনল্যান্ডের নাগরিক জীবনে সন্তুষ্টি বজায় থাকার অসংখ্য কারণ রয়েছে বলে মনে করেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। প্রায় বিনামূল্যে শিক্ষাব্যবস্থা, পর্যাপ্ত অবসর সময়, নিশ্চিত স্বাস্থ্যসেবা সেখানকার জীবনযাপন তুলনামূলক সহজ হওয়ার অন্যতম কারণ।
জনসংখ্যা অনেক কম হওয়ায় অনেক বিষয়ই সেখানে সহজতর। ৩ লাখ ৩৮ হাজার ৪৫৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের দেশটির জনসংখ্যা মাত্র ৫৫ লাখের মতো। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যাই এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
ফিনিশ নাগরিকদের প্রচলিত বিশ্বাস ও জীবনযাপনের অভ্যাসও তাদের সুখী দেশের তালিকার শীর্ষে থাকতে সাহায্য করে সবসময়।
অনুভূতি নিয়ে লুকোচুরি করার প্রবণতা কম
আমাদের দেশ কিংবা বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলেই যদি 'কেমন আছো?' প্রশ্ন করা হয়, তাহলে উত্তরে 'ভালো আছি' শোনারই আশা করে সবাই। কারণ দৈনন্দিন জীবনের নানান ঝুট-ঝামেলা বা হতাশার গল্প বাইরের কারো কাছে জানাতে আমরা নিজেরাও যেমন সংকোচ বোধ করি তেমনি অপরপক্ষও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।
কিন্তু ফিনল্যান্ডের সংস্কৃতিতে ব্যক্তিগত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ করা খুবই সাধারণ বিষয়। বাধ্যতামূলকভাবে সবার সামনে ভালো থাকার ভান করতে হয় না সেখানে।
ফিনল্যান্ডের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সংগঠন এমআইইএলআই-এর কৌশলগত বিষয়াবলীর পরিচালক মেরি লারিভারা বলেন, "'কিছুই ঠিক নেই' বা 'আমার ভালো লাগছে না' ধরনের উত্তরের ক্ষেত্রে এখানে অনেক সহনশীলতা দেখানো হয়।"
যুক্তরাষ্ট্র ও ফিনল্যান্ড উভয় দেশে বসবাসের পর তার পর্যবেক্ষণ থেকে এই মন্তব্য করেন লারিভারা। মানবিক আবেগের বহিঃপ্রকাশে এই সততাই হয়তো ফিনল্যান্ডের সামগ্রিকভাবে সুখী রাষ্ট্র হওয়ায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
আবেগ দমিয়ে রাখা যে কোনো ভালো ফল বয়ে আনে না তা তো আমাদের সকলেরই জানা। গবেষণা বলছে কাছের মানুষদের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি, সামাজিক দূরত্ব বৃদ্ধিসহ অকাল মৃত্যুর কারণও হতে পারে এটি।
কর্মজীবনের ভারসাম্যে অগ্রাধিকার
ফিনল্যান্ডের নাগরিকেরা কর্মক্ষেত্রে বেশ পরিশ্রমী হলেও তাদের কর্মঘণ্টা থাকে পরিমিত। তাই বেশিরভাগ নাগরিকেরই কর্মজীবন থাকে ভারসাম্যপূর্ণ।
"এটি দৈনন্দিন জীবনে আপনাকে অবসর কাটানোর সুযোগ দেয়, পাশাপাশি নিজের যত্ন নেওয়ারও সুযোগ করে দেয়," বলেন লারিভারা।
দিনশেষে কর্মক্ষেত্রের বাইরেও অনেক ধরনের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকে জীবনে, যোগ করেন ইউনিভার্সিটি অভ উলু-র মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক মিরকা হিন্টসানেন।
ট্যামপেরে ইউনিভার্সিটির সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, জুহো সারির মতে, এখানে বেশিরভাগ মানুষেরই কাজের জন্য খুব বেশি দূরে যাতায়াত করতে হয় না। যেকারণে তাদের কাজের ক্ষেত্রেও আনন্দ বজায় থাকে, দৈনন্দিন জীবনে অবসর সময়ও বেশি থাকে।
প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ
ফিনল্যান্ডের বেশিরভাগ মানুষের জীবনে সুখী থাকার অন্যতম কারণ হিসেবে প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা বলেছেন উল্লিখিত তিনজন বিশেষজ্ঞই।
এমনকি, দেশটিতে 'এভরিম্যান'স রাইট' নামের প্রচলিত আইন অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকই প্রায় সকল বন, হ্রদ বা সমুদ্রতীরবর্তী জায়গা ব্যবহার করতে পারেন বিনামূল্যে। যার অর্থ পাবলিক প্লেসে ক্যাম্পিং, হাইকিং, সাঁতার কাটা, ঘোড়সওয়ার ইত্যাদি কাজগুলো করা যায় কোনো অর্থ ব্যয় না করেই।
হিন্টসানেন জানান, ফিনল্যান্ডের নাগরিকেরা সবসময় প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে পারেন। হোক সেটি বড় কোনো নগরী বা ছোট শহর "সেখানে সবজায়গায়ই আছে প্রকৃতি," বলেন হিন্টসানেন।
"গবেষণা অনুযায়ী প্রকৃতপক্ষেই মানসিক চাপ কমানোয় ভূমিকা রাখে প্রকৃতি, যা মানুষের সুখী হওয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কম চাপে থাকলে জীবনে সহজেই সুখী হওয়া যায়," হিন্টসানেন উল্লেখ করেন। তাই কাছাকাছি কোনো প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে স্বল্প সময়ের জন্য হেঁটে আসাও কর্মব্যস্ত জীবনে সুখের সঞ্চার করতে পারে।
নিত্যনতুন দক্ষতা অর্জনে অনুপ্রাণিত করা হয়
"আত্ম উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমরা খুবই আগ্রহী। নতুন দক্ষতা অর্জন মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী," বলেন লারিভারা। তবে দক্ষতা অর্জন মানেই নতুন কোনো ভাষা শেখা বা কর্মক্ষেত্রের নতুন কৌশল আয়ত্ত করার মতো গুরুগম্ভীর কিছু হতে হবে এমনটি নয়। নতুন কোনো রেসিপি রান্নার চেষ্টা করা বা সেলাই শেখার ক্লাস করার মতো সহজ কাজই গুরুত্বের সঙ্গে করা যায়।
সারি জানান, ফিনল্যান্ডে এমন অনেক সংঘ আছে যেখানে মানুষ একসঙ্গে শখের কাজ করতে পারে। যোগব্যায়াম থেকে শুরু করে মৃৎশিল্পের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি যেকোনো কিছু করা যায় সেখানে। এসব সংঘে যোগদান করার খরচও খুবই সামান্য।
পাশাপাশি নতুন নতুন জিনিস শিখতে পারলে অবসর সময়কে অনেক বেশি কার্যকরী মনে হয়। মাসখানেক বা বছরখানেক পর যখন বিগত সময়ের স্মৃতিচারণ করা হয় তখন ফেলে আসা দিনগুলো অর্থবহ হয়ে ধরা দেয় স্মৃতির পাতায়।
বিশ্বস্ত সমাজ
সারির মতে, ফিনল্যান্ডের সমাজে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের ক্ষেত্র অনেক বেশি। "এটা অনেক ছোট একটা দেশ। মানুষ এখানে নিজেদের মধ্যে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। যা তাদেরকে আরো বেশি শক্তিশালী করে তোলে," বলেন তিনি।
ফিনল্যান্ড অপেক্ষা বাংলাদেশের আয়তনে অর্ধেকের চেয়ে কম হলেও আমাদের দেশের জনসংখ্যা অনেক গুণ বেশি। তাই এই সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বিশ্বাস স্থাপন অনেকটাই কঠিন। তবুও চাইলেই আশেপাশের ভরসাযোগ্য মানুষদের নিয়ে গড়ে তোলা যায় কার্যকরী বিশ্বস্ত নেটওয়ার্ক।
যখন জীবনে পরিপূর্ণতার বিষয়টি বিবেচনা করা হয় তখন "নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পাওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম" হয়ে দাঁড়ায় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সুখের চেয়ে সন্তুষ্টির অনুভূতিকে বেশি প্রাধান্য দেয় তারা
বিশেষজ্ঞদের মতে, ফিনল্যান্ডের নাগরিকেরা সাময়িক সুখের তীব্র অনুভূতির চেয়ে পরিতৃপ্তির অনুভূতিকেই গুরুত্ব দেয় বেশি। নিজের জীবনকে নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী সন্তুষ্টি অর্জনে তারা সচেষ্ট।
সারি জানান, ফিনল্যান্ডের নাগরিকদের পরিতৃপ্তির অনুভূতি উচ্চমাত্রার। "ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে আসলে মানুষ সুখী কি-না তা জানতে চাওয়া হয় না, বরং জানতে চাওয়া হয় তারা পরিতৃপ্ত কি-না," বলেন তিনি।
তাই জীবনে আকাশ-কুসুম চাহিদা না রেখে যা আছে তা-ই নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারলেই মিলবে সুখের সন্ধান। কেউ যদি জীবনে সন্তুষ্ট হওয়ার চেষ্টা না করে তবে পৃথিবীর কোনো প্রান্তেই তার জন্য সুখ খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।
পরিশিষ্ট- এবার ফের সেই অসুখী রাজার গল্পে আসা যাক। সুখী মানুষের খোঁজে রাজ্য জুড়ে তল্লাশি চালিয়ে এক সুদর্শন যুবককে বের করলেন সেনাপতি। তার বেশ-ভূষা, চেহারার সৌন্দর্য দেখে সবাই ভাবলেন এ-ই আসল সুখী মানুষ। কিন্তু সুদর্শন যুবকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তার মানসিক অশান্তির বিবরণ। হতাশ হয়ে রাজার সেনাপতি অনুসন্ধান শুরু করলেন আবার। একে একে যে কয়জনকে বাইরে থেকে দেখে সুখী মানুষ বলে মনে করেছিলেন তারাই নিজেদের জীবনের অসন্তুষ্টির গল্প শুনিয়ে নিরাশ করেছিলেন সেনাপতিকে।
ক্লান্ত সেনাপতি একদিন বিশ্রাম নিতে গিয়েছিলেন নদীর ধারে। সেখানে এক লোককে দেখলেন মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে। লোকটির সঙ্গে কথা বলে জানলেন তার ঘর-বাড়ি নেই, নদীর ধারে গাছের নিচেই বসবাস। খিদে পেলে কুড়িয়ে পাওয়া ফলমূল আর পিপাসা পেলে নদীর পানি খেয়েই বেঁচে আছেন তিনি। কিন্তু জীবনে সুখের কোনো কমতি নেই তার।
প্রকৃত সুখী মানুষের সন্ধান পেয়ে উচ্ছ্বাসিত সেনাপতি লোকটির একটি জামা ধার চাইলেন রাজার জন্য। কিন্তু সেই সুখী মানুষের গায়ে কোনো জামা ছিল না। তিনি জানালেন তার কোনো জামা নেই। ভীষণ অবাক হলেন সেনাপতি, তাহলে তোমার এত সুখী হওয়ার কারণ কী? জিজ্ঞেস করলেন তাকে। উত্তরে লোকটি বললো, "সুখী হওয়ার কখনো জন্য জামা-কাপড়, বাড়ি-ঘর কিছুরই দরকার হয়নি আমার। নিজের যা আছে তা নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। এভাবেই সুখ খুঁজে পেয়েছি আমি।"
- তথ্যসূত্র: হাফপোস্ট